অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রয়াণ

কবি অলোক দাশগুপ্ত সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

সমসাময়িক সময়ে ইউরোপে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার বাতিঘর কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত চলে গেলেন। তিনি থাকতেন দক্ষিণ–পশ্চিম জার্মানির শহর হাইডেলবার্গে। এই শহরেই কেটেছে তাঁর প্রায় ৫০টি বছর।

১৩৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জার্মানির প্রাচীনতম রুপ্রেশ্ট-কার্লস বিশ্ববিদ্যালয় এখানেই অবস্থিত। এই ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়েই আলেক্সান্ডার ফন হুমবোল্ট রিসার্চ ফেলোশিপ নিয়ে অলোকরঞ্জন কাজ শুরু করেছিলেন ১৯৭১ সালে। তিনি তখন তরুণ তুর্কি, টগবগে যুবক।

অনেক আগে থেকেই হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, অঙ্ক শাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়গুলোতে অধ্যয়নের জন্য জার্মানির সেরা বিদ্যায়তন হিসেবে পরিচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অধ্যয়ন করেছেন দার্শনিক জর্জ ভিলহেলম ফ্রিডরিশ হেগেল, সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার, রসায়নবিদ লোথার মায়ার, মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল জেসপার, রাষ্ট্রনীতি তত্ত্ববিদ হানা আরেন্ড, রাজনীতিবিদ হেলমুট কোল, পদার্থবিদ হারম্যান ফন হাইমহোলজ, কবি–লেখক গটফিল্ড কেলার, আইনজ্ঞ জর্জ ফন সিমেন্স, মেডিসিনার ভিক্টর ফন ভাইজকার প্রমুখ এ রকম অসংখ্য ব্যক্তিত্ব।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের জন্ম ১৯৩৩ সালে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ১৯৫৭ সাল থেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনার সময় ফেলোশিপ নিয়ে গ্যোয়টে-শিলারের দেশ জার্মানিতে আসেন। গ্যোয়টে মূল সাহিত্যকর্মের মূল রস অস্বাদন করতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জার্মান ভাষা শিখেছিলেন। অলোকরঞ্জন তা জানতেন, তাই তিনি দেরি না করে দ্রুত জার্মান ভাষা রপ্ত করেছিলেন।

ইউরোপ তথা জার্মানিতে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ছিলেন বাংলা সাহিত্যর অন্যতম ব্যক্তিত্ব। আমরা জার্মানিতে তাঁকে বলতাম ‘কবিদের কবি’। এটা আমাদের কথা নয়, প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমান অলোকরঞ্জনের কবিতার কথা বলতে গিয়ে কবির একান্ত নিজস্ব বাচনভঙ্গি, নতুন নতুন শব্দ বিন্যাসের তারিফ করে বলেছিলেন এই কথা।

জের কাব্য রচনা, ইউরোপীয় কবিদের কবিতার অনুবাদকর্ম, কথাসাহিত্যর মধ্যে নতুন এক ভাবধারা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। অলোকরঞ্জনের মুখের ভাষা ও বর্ণনা করার দক্ষতা ছিল অপূর্ব শ্রুতিমধুর। এই দক্ষতার ফলে যেকোনো আলোচনায় তিনি সহজেই মধ্যমণি হয়ে উঠতেন।

১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থটি ইউরোপের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আজ শত বছরের বেশি সময় পর বাংলা সাহিত্য–সংস্কৃতিকে ইউরোপের মূল ধারায় পরিচিত করার মতো দুরূহ কাজ করার মানুষের বড়ই অভাব। অলোকরঞ্জন তাঁর জায়গা থেকে সেই কাজটি করতেন।

মনে আছে, ২০০৮ সালে তিনি নবম বাংলাদেশ সম্মেলনে হানোভার এলেন। এখানে তিনি আলোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দর্শন, শিক্ষাভাবনা ও সাহিত্য নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের রচনা শুধু ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে অনুবাদ হচ্ছিল বলে মূলের যে মাধুর্য-মায়া সবটাই অনুবাদের তাত্ত্বিকতায় লু্প্ত হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসাধনা ইউরোপের বহু মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছিল এবং তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল কবির মানবিক মূল্যবোধ, প্রেম ও কল্যাণ কামনা।

কিন্তু এত দিন পর কজন মনে রেখেছে কবিগুরুকে। হাইডেলবার্গের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট কবিগুরুর সেই লুপ্ত মাধুর্যকে ফিরিয়ে আনছে। আমরা রবীন্দ্রনাথের শেষ দিকের কবিতা দিয়ে শুরু করেছি৷ যার নাম “স্প্যেটার ল্যিরিক” বা অন্ত-পর্যায়ের কবিতা। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এসব কাজ বাংলা সাহিত্যকে জার্মানিতে জায়গা করে দেবে।’ কথায় কথায় তিনি বলতেন, জার্মানির মহাকবি গ্যোয়েটের বিশ্বচৈতন্য থেকে রবীন্দ্রায়নে নিরন্তর সঞ্চরণের মধ্যে তিনি কোনো বিসংগতি দেখতে পান না।

অধ্যাপক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ১২টি কাব্যগ্রন্থ, বাংলা ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় বহুবিধ প্রবন্ধসংগ্রহ প্রণয়ন ছাড়াও ভারত সাহিত্য থেকে জার্মান ভাষায় ও ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে বাংলা ভাষায় অসংখ্য কবিতা, নাটক, কথাশিল্প তিনি অনুবাদ ও সংকলন করেছেন।

শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করেছিলেন। জার্মানিতে এত দিন থাকার পরও তাঁর চলনে-বলনে ছিল শান্তিনিকেতনি সংস্কৃতি। বেশির ভাগ সময়ে খদ্দরের ফতুয়া আর হাতকাটা কোট পরতেন, ঘাড়ে ঝুলত শান্তিনিকেতনি লম্বা ঝোলা। বন্ধুত্ব বিষয়ে তিনি জাতপাত বা দেশ ধর্ম বা বয়স নিয়ে ভাবতেন না। তাঁর ছিল অসংখ্য গুণগ্রাহী জার্মান বন্ধু আর আমরা বাঙালিরা তো ছিলামই। ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের বিখ্যাত বইমেলায় সহযোগী দেশ ছিল ভারত। আগেভাগেই ঠিক ছিল মেলায় অলোকদা আসবেন। আমি সুজিত চৌধুরী, গোলাম আবু জাকারিয়া তাঁর আসার দিন মেলাস্থলের অনতিদূরে ফ্রাঙ্কফুর্টের রেলওয়ে স্টেশনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গেলাম। তিনি এলেন, সঙ্গে কয়েকজন জার্মানি শিষ্যরা। তাঁদের একজন ক্রিশ্চিয়ান ভাইস, পরবর্তীকালে ‘ধ্রুপদী’ নামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। সেবার অলোকদাকে নিয়ে আমাদের অনেক আড্ডা হয়েছিল।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের স্ত্রী ট্রুডবার্টা ২০০৫ সালে মারা যান। তারপর তিনি বেশ একাকী হয়ে পড়েন। তবে তাঁর জার্মান বন্ধুকুল সব সময় তাঁকে দেখাশোনা করতেন।

হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটে আধুনিক দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হ্যান্স হার্ডার ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি বললেন, জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে–শোকে ভুগছিলেন। ১৭ নভেম্বর শেষ মুহূর্তে প্রশান্তিতেই তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। শেষের দিকে কবির দেখাশোনা করতেন কবির সুহৃদ এলিজাবেথ গুন্টার।

এই প্রয়াণে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে বাংলা কবিতার পাঠকেরা এবং আমরা প্রবাসী অনুরাগীরা শোকাভিভূত। কবি জয় গোস্বামী বলেছেন, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নেই মানে বাংলা কবিতাজগতের সামনে এক গুরুদশা উপস্থিত।


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]