আজও কেন জনপ্রিয় রুমি?

মৃত্যুর প্রায় হাজার বছর পর আজও জনপ্রিয় ফারসি ভাষার কবি জালাল উদ্দিন রুমি। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিভিন্ন ভাষায় ক্রমাগত অনুবাদ হচ্ছে তাঁর কবিতা। এ প্রজন্মের তরুণ–তরুণীরা হরহামেশা ফেসবুক–টুইটার–ইউটিউবে এখন শেয়ার করেন তাঁর পঙ্‌ক্তি। এই সুফি কবির প্রবল পাঠকপ্রিয়তার কারণ কী, তাঁর জনপ্রিয়তার উৎস কোথায়? আজ রুমির জন্মদিনে এ লেখায় থাকল তার তত্ত্বতালাশ।

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

৮১৩ বছর আগে ১২০৭ সালে ফারসি সুফি কবি জালাল উদ্দিন রুমির জন্ম। প্রাচ্যের এক অখ্যাত গ্রামে যাঁর জন্ম, সেই কবির শায়েরি সারা দুনিয়াজুড়ে বিক্রি হচ্ছে সমানতালে। তাঁর লিখিত কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়ার পর শুধু আমেরিকাতেই লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়ে চলেছে।

রুমির জীবনীকার ও ‘রুমিস সিক্রেট’ গ্রন্থের লেখক ব্র্যাড গুচের মতে, ‘রুমির ব্যক্তিত্ব শত বছর ধরে একই রকম জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয়।’ ব্র্যাড গুচ ফ্র্যাঙ্ক ও’হারা এবং ফ্ল্যানারি ও’কনোর এর জীবনীকার হিসেবেও বিখ্যাত। গুচ বলেন, ‘রুমির জীবনচিত্র আড়াই হাজার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত।’ রুমি তাঁর জন্মস্থান বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ থেকে সফর শুরু করেন। উজবেকিস্তানের সমরকন্দ হয়ে ইরান ও শামে কিছুকাল থিতু হন। বর্তমান সিরিয়ার দামেস্ক ও হালব শহরে যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করেন। পড়াশোনা করেন ধর্মতত্ত্ব নিয়ে।

তবে রুমি জীবনের শেষ পঞ্চাশটি বছর কাটিয়েছেন কোনিয়ায়। মোঙ্গল খুনিদের লক্ষ্যে পরিণত হওয়া এ আধ্যাত্মিক সুফি তুর্কিদের নিরাপত্তায় শায়িত আছেন এখানেই। বছরের একটি দিন তুরস্কের এ শহরে অবস্থিত তাঁর সমাধিকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার সব দরবেশ জড়ো হন আজও।

শিল্পীর চোখে জালাল উদ্দিন রুমি

১২৪৪ সালে রুমির জীবনে একটি মোড় ঘোরানো পরিবর্তন আসে। স্বাধীন চিন্তার অধিকারী আধ্যাত্মিক সুফিগুরু শামস তাবরিজের সঙ্গে রুমির মোলাকাত হয়। ৩৭ বছর বয়সের রুমি তখন পর্যন্ত ছিলেন একজন বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ও প্রচারক। রুমি ও তাবরিজের প্রেম-বন্ধুত্ব বা শাগরেদির বয়স মাত্র তিন বছর। এর মধ্যে রুমি একজন সুফিতে পরিণত হন। তিন বছর পর তাবরিজ গায়েব হয়ে যান। ঐতিহাসিকদের ধারণা, রুমির কোনো ঈর্ষান্বিত পুত্র তাবরিজকে খুন করে ফেলে। বিচ্ছেদের আগুনে পুড়তে থাকেন রুমি। এই বিচ্ছেদের দহন থেকে রুমি নিজেকে কবিতায় সঁপে দেন পুরোপুরি। ৩৭ থেকে ৬৭ বছর বয়সকালেই মূলত রুমির সব কবিতা লেখা। শাসম তাবরিজ, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও প্রভুকে নিয়ে লেখেন তিন হাজার ‘প্রেমসংগীত’। দুই হাজার রুবাইয়াত লিখেছেন। ছয় খণ্ডে লিখেছেন আধ্যাত্মিক মহাকাব্য ‘মসনবি’।

রুমি শায়েরি, সংগীত আর নৃত্যে ডুবে রইলেন। ব্র্যাড গুচের মতে, ‘রুমি যখন মুরাকাবায় (ধ্যানমগ্নতায়) যেতেন অথবা শায়েরি করতেন, তখন একধরনের নৃত্য করতেন আর ঘুরে ঘুরে কবিতা লেখাতেন।’ এই নৃত্যই পরবর্তীকালে সুফিনৃত্য হিসেবে পরিচিতি পায়। রুমি লিখেছেন, ‘আগে আমি প্রার্থনা করতাম। এখন শের, নজম ও গীত পাঠ করি।’

রুমির মৃত্যুর প্রায় হাজার বছর হতে চলল, আজও তাঁর লেখা দেদার পাঠ করা হচ্ছে। কবিতায় বাদ্যযন্ত্র বসিয়ে সৃষ্টি করা হচ্ছে নতুন নতুন সুর। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সংগীত ও চলচ্চিত্রে তাঁর জীবনচিন্তা আর শায়েরির ব্যবহার বেড়ে চলেছে। আধুনিক সময়ের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারে তাঁর কবিতার লাইন রোজ তুলে দিচ্ছেন অসংখ্য পাঠক। এত বছর পর কেন আজও জনপ্রিয় এই সুফি কবি? এত দীর্ঘ সময় পরও কীভাবে বেঁচে আছে রুমির কবিতা?

গুচ বলেন, ‘রুমি আনন্দ ও প্রেমের কবি। শামসের বিচ্ছেদ, স্রষ্টা ও মৃত্যুর স্মরণ তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে। রুমির বার্তা সব সীমাকে স্পর্শ করে, সংযোগ তৈরি করে। একবার গাড়ির গায়ে একটা স্টিকার দেখলাম। সেখানে রুমির একটি পঙ্‌ক্তি লেখা—ভুল আর শুদ্ধের মাঝখানে রয়েছে একটি খোলা প্রান্তর। তোমার সঙ্গে দেখা হবে সেখানে!’

ইংরেজিতে অনুবাদ করে রুমির কবিতা আমেরিকায় ‘বেস্টসেলার’ বানানোর অবদান যাঁর বলে ধরা হয়, সেই কোলম্যান বার্কস বলেন, ‘রুমির চিন্তার আশ্চর্য সজীবতা যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়, তাঁর জনপ্রিয়তার বড় কারণ তা–ই। তাঁর অনুভূতির সূক্ষ্ম কৌতুক ও খেলাচ্ছলে বলা কথাতেও লুকিয়ে থাকে গভীর চিন্তা আর বুদ্ধির ঝলক।’

আমেরিকার ‘পোয়েটস হাউস’ ও ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি সিরিজ অন রুমি’–এর কর্তা লি ব্রিসিটি রুমির গ্রহণযোগ্যতার রহস্য ভেদ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘স্থান, কাল ও সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে রুমির কবিতা তাঁর চিরন্তন গ্রাহ্যতা প্রমাণ করে। আমাদের নিজস্ব ভালোবাসা আর দৈনন্দিন জীবনের সুখের সন্ধান দেয় রুমির কবিতা।’ অনুরণন আর সৌন্দর্যের দিক দিয়ে লি রুমির কবিতাকে শেক্‌সপিয়ারের লেখার সঙ্গে তুলনা করেন।

ইংরেজিতে অনুবাদ করে রুমির কবিতা আমেরিকায় ‘বেস্টসেলার’ বানানোর অবদান যাঁর বলে ধরা হয়, সেই কোলম্যান বার্কস বলেন, ‘রুমির চিন্তার আশ্চর্য সজীবতা যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়, তাঁর জনপ্রিয়তার বড় কারণ তা–ই। তাঁর অনুভূতির সূক্ষ্ম কৌতুক ও খেলাচ্ছলে বলা কথাতেও লুকিয়ে থাকে গভীর চিন্তা আর বুদ্ধির ঝলক।’

১৯৭৬ সালে কবি রবার্ট ব্লেই কেমব্রিজের শিক্ষাবিদ এ জে আরবেরির অনুবাদটা কোলম্যান বার্কসের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, এই কবিতাগুলোকে খাঁচা থেকে মুক্ত করা দরকার। বার্কস সেই কবিতাগুলোকে একাডেমিক কাটখোট্টা ভাষা থেকে মুক্ত করে আমেরিকান কবিতার ধাঁচে ‘স্বাধীনভাবে’ অনুবাদ করে ফেললেন। তারপর থেকে অনুবাদের তেত্রিশ বছরে বার্কস ২২ খণ্ড রুমি প্রকাশ করেছেন। ২২ খণ্ডের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য এসেনশিয়াল রুমি’, ‘আ ইয়ার উইথ রুমি’, ‘রুমি: দ্য বিগ রেড বুক’, ‘দ্য স্পিরিচুয়াল ডায়েরি অব রুমিস ফাদার’। সব কটি বইয়ের প্রকাশক হার্পার ওয়ান। এ পর্যন্ত বিশ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। অনুবাদ হয়েছে বিশ্বের অন্তত ২৩টি ভাষায়।

১২৭৩ সালে রুমির জানাজায় অংশ নিতে প্রায় সব ধর্মের মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, রুমির কবিতা তাঁদের নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আরও গভীরভাবে বিশ্বাসী করে তুলেছে। রুমির কবিতার শক্তি এ জায়গাতেই। বিশ্বব্যাপী ধর্ম–বর্ণের যে বিরোধ আর সংঘাত, রুমির কবিতা তা মুছে দেয়।

কোলম্যান বার্কস, রুমির কবিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন যিনি
ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকার রুটগার্স ইউনিভার্সিটির প্রাচ্যসাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং রুমির পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক জাভেদ মুজাদ্দেদির মতে, রুমি ছিলেন ফারসি কবিদের মধ্যে নিরীক্ষাধর্মী কবি এবং প্রভাব বিস্তারকারী একজন সুফি দরবেশ। সুফিচিন্তাকে কবিতার ভাষায় দারুণভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতাই তাঁর জনপ্রিয়তার মূল রহস্য।

মুজাদ্দেদি বলেন, ‘রুমির চারটি ব্যতিক্রমী আবিষ্কারের একটি হলো পাঠককে তিনি সরাসরি সম্বোধন করেন। রুমির সময়ে এটি ছিল বিরল ব্যাপার। আমার মনে হয়, এখনকার পাঠকেরাও রুমির এই সম্বোধনের সঙ্গে নিজেদের ভালোভাবে মিলিয়ে নিতে পারেন।’

মুজাদ্দেদির মতে, রুমির জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় কারণ তাঁর কবিতায় থাকা শিক্ষামূলক বক্তব্য। অনুপ্রেরণামূলক সাহিত্যের (মোটিভেশনাল লিটারেচার) পাঠকেরা রুমির কবিতার প্রতি এ কারণে ভীষণভাবে আগ্রহী। তৃতীয় কারণ, মানুষের জীবনের রোজকার যে দৃশ্য, তা পাওয়া যায় রুমির কবিতায়। জনপ্রিয়তার চতুর্থ রহস্যটি হলো, রুমির গজলে থাকে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের গভীর আশাবাদ। আমাদের কবিতার ধারায় রয়েছে প্রিয়জনের নিষ্ঠুরতার বর্ণনা আর তার বিচ্ছেদের কথা। কিন্তু রুমি প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের আশাবাদকে উদ্‌যাপন করেন।

আজও রুমির কবিতার নতুন নতুন অনুবাদ আসছে দুনিয়াজুড়ে। এতে তাঁর কবিতার অনুরণন বেড়ে চলেছে আরও বেশি মাত্রায়। তাঁর জনপ্রিয়তা ও প্রভাব বাড়তে থাকবে আগামীতেও। রুমির শায়েরি আর গভীর অর্থী কথামালা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে কবিতা মিশে যায় জীবনের পরতে পরতে।
সূত্র: বিবিসি

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]