আমাদের হাসনাত ভাই

কোলাজমনিরুল ইসলাম
সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন ‘কালি ও কলম’ সম্পাদক আবুল হাসনাত। সাহিত্য সম্পাদনার নিজস্ব এক ধারা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

আমাদের হাসনাত ভাই বলতে আমি সেই প্রজন্মের তরুণদের কথা বলছি, যাদের সামনে হাসনাত ভাই কেবল আদর্শই নন, একই সঙ্গে ছিলেন প্রেরণার উৎস। হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬৯ সালে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে প্রবেশের পর। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন তত দিনে অনেকটাই স্তিমিত। আইয়ুব খানের বিদায়ের পর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর তখন দেওয়া হয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। আমরা ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সেই বন্ধ দুয়ারের মধ্যেও রাজনীতির স্বাদ পেতে পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সংস্পর্শে এসেছিলাম। সেই সূত্রে একসময় বকশীবাজারের হোসেনি দালান লেনে ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যালয়ে মাঝেমধ্যে যাওয়া-আসা করতাম। আমাদের সেই ছোট দলে আমার সঙ্গে আরও ছিল ল্যাবরেটরি স্কুলে আমার সহপাঠী কামাল আহমেদ এবং ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অল্প দিনে বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়া খান মোহাম্মদ ফারাবী। এ ছাড়া আমাদের এই দলে ছিল আরও দু-একজন।

তখন আমাদের সামনে রাজনীতির দুয়ার খুলে যাওয়া সেই জগৎটা ছিল বিস্ময়ে ভরা। সেখানেই একসময় পরিচয় ঘটে আবুল হাসনাত—হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে। কম কথা বলার মানুষ হাসনাত ভাই কেন যেন শুরু থেকেই আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন।

বিশেষত ফারাবী ও আমাকে সেই সময় থেকেই লেখালেখিতে উৎসাহ দিতে শুরু করেন তিনি।

হাসনাত ভাই তখনো ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীর দায়িত্ব নেননি। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার মধ্যে ছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও একুশের সংকলন সম্পাদনা করা। হাসনাত ভাই, মতি ভাই (মতিউর রহমান) তাঁদের সঙ্গে আমার অগ্রজ মফিদুল (মফিদুল হক) ভাইয়ের হাতের ছোঁয়ায় তখন যেসব একুশের সংকলন বের হতো, সেগুলো ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের। দেশের প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকদের লেখা এতে অন্তর্ভুক্ত থাকত। এর বাইরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনেও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও পারদর্শী। নিষিদ্ধ সেই সময়ে সঠিক বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন মঞ্চনাটক ও গানের অনুষ্ঠানকে। সেদিনের সেই উদ্দীপ্ত তারুণ্যের সাক্ষাৎ লাভ আমাদের জন্য ছিল যেন আচমকা কিছু পেয়ে যাওয়া। পরবর্তী জীবনে এসব কর্মকাণ্ড নানা দিকের দুয়ার আমাদের জন্য খুলে দিয়েছিল।

মনে পড়ে, ১৯৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির একুশের সংকলনের জন্য আমার একটি লেখা চেয়েছিলেন হাসনাত ভাই। লেখালেখির জগতে তখনো আমার প্রবেশ কেবল বাইরের দুয়ারে করাঘাত করার পর্যায়ে। সেই অবস্থায় খুবই কাঁচা হাতের লেখা একটি কবিতা হাসনাত ভাইকে দিয়েছিলাম আমি। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেটা তিনি ছেপেছিলেন একুশের সংকলনে। এর কারণ তখন ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি। তবে অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, তাঁর সেই বদান্যতা ছিল লেখালেখির জগতে আমার প্রবেশকে উৎসাহিত করার জন্য। এরপর থেকে মারা যাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগপর্যন্ত সেই চিরাচরিত অল্প কথায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার অনুরোধ হাসনাত ভাই আমাকে করে গেছেন এবং লেখার জন্য জায়গা করে দেওয়ার সেই মনোবৃত্তি সব সময় ধরে রেখেছেন। ফলে সৃজনশীল যেসব রচনা এ পর্যন্ত আমি লিখে উঠতে পেরেছি, তার সবটার পেছনে রয়েছে হাসনাত ভাইয়ের বিরাট বড় অবদান—এটা আমাকে বলতেই হবে। শুধু লেখাই কেন, জীবনের নানা অভিজ্ঞতা অর্জনেও সব সময় সহায়তার হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে একই দলভুক্ত হয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ হলেও যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে হাসনাত ভাইয়ের দেখা আমি পাইনি। জুলাই মাসে আগরতলায় উপস্থিত হয়ে জানতে পারি, দল ও সংগঠনের অনেক বড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি চলে গেছেন কলকাতায়। কলকাতায় থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আমাদের সংগ্রামের বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। সেই দায়িত্ব তিনি কেবল নিষ্ঠার সঙ্গে পালনই করেননি, বরং তা করতে পেরে একধরনের আনন্দও পেয়েছিলেন। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিম বাংলার লেখক-কবি-শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠেছিল নিবিড় এক সম্পর্ক।

যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার পর ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে জড়িত ছিলেন হাসনাত ভাই। সেই সূত্রে ১৯৭২-এর শুরুর দিকে ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্রসহ আরও কয়েকজন বিদ্বজ্জনকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার পেছনে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। এখানেও হঠাৎ একদিন আমাকে ডেকে তিনি বলেছিলেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আমি যেন সার্বক্ষণিক সাহচর্য দিই; অর্থাৎ ঢাকায় এই কবির ঘোরাঘুরি ও দেখভালের দায়িত্ব আমার মতো তরুণের হাতে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটা আমার জন্য ছিল হাতে চাঁদ পেয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। যাঁর কবিতা এত দিন মুগ্ধ হয়ে পড়েছি, তাঁকে কেবল কাছে থেকে দেখা নয়, তাঁর সার্বক্ষণিক সাহচর্য লাভ আমার জন্য ছিল অসম্ভব এক প্রাপ্তি। সুভাষদার সঙ্গে আমার সেই সংস্পর্শ তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বহাল ছিল। এমনকি আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়নের কাজে যখনই তিনি মস্কো গিয়েছেন, আমার খোঁজ করতে ভোলেননি।

একইভাবে দেবব্রত বিশ্বাসের দেখাশোনার দায়িত্বও কিছুদিন আমাকে পালন করতে হয়েছে হাসনাত ভাইয়ের অনুরোধে। গুরুতুল্য সেই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রিকশায় যেতে যেতে একদিন আমাকে বলেছিলেন, মায়ের জন্য কিছু অর্থ তিনি নিয়ে এসেছেন, সেগুলো কীভাবে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। কিছুটা অবাক হয়ে আমি জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর মা এখনো কি বাংলাদেশে বসবাস করেন? আমাকে অবাক করে দিয়ে বিশুদ্ধ পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় তিনি বলেছিলেন, ‘শোনো, আমার মা তো দুইটা। ওইখানে আছে সৎমা, আর এইখানে রইছে আসল মা।’ এরপরও কথাটা আমার বোধগম্য হলো না। অতঃপর তিনি খোলাসা করে বলেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে তাঁর সৎমা এবং বাংলাদেশ আসল মা। পরে আমি হাসনাত ভাইকে সে কথা বলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল এবং সেই সাক্ষাতে মায়ের চরণে তাঁর ভাষায় ‘সামান্য অবদান’ বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই শিল্পী। আজও যখনই দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসংগীত শুনি, আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাতৃভূমি মায়ের জন্য তাঁর সেই আকুতির কথা। বলা বাহুল্য, আমার জন্য এই সব অভিজ্ঞতার দুয়ার হাসনাত ভাই-ই উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

আবুল হাসনাত

১৯৭২-এর জুলাই মাসে দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের আপাতবিচ্যুতি ঘটেছিল বটে, তবে আশির দশকের শুরুতে দেশে ফিরে আসার পর তা আবার পুনঃস্থাপিত হতেও সময় লাগেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্দেশ্যে আমার দেশ ছেড়ে যাওয়ার সেই একই বছর হাসনাত ভাই কিছু সময়ের জন্য মস্কো গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার সে দফায় দেখা হয়নি। কারণ, সোভিয়েতজীবনের সেই প্রথম বছরটি আমার কেটেছিল মস্কো থেকে অনেক দূরে, কিয়েভে। এক বছর কিয়েভে ভাষাশিক্ষার কোর্স শেষ করে মস্কোয় চলে আসার পর সাত বছর আমি ছিলাম ওই শহরে। তবে সেই দীর্ঘ সময়ে হাসনাত ভাইয়ের মস্কো যাওয়া হয়নি। ফলে বিদেশে তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎ আমি সে সময় পাইনি।

মস্কোর জীবনে হঠাৎ ইতি টেনে দেশে ফিরে আসি ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে। সঙ্গে তখন আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী এবং সামনে অনিশ্চিত এক জীবন। সেই দিনগুলোতে হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ গড়ে উঠতে বিলম্ব হয়নি। হাসনাত ভাই তখন ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সম্পাদক। তাঁর নির্দেশনায় প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকী হয়ে উঠেছে অনন্য এক প্রকাশনা। সে সময়ই হাসনাত ভাই আমাকে অনুরোধ করেছিলেন রুশ সাহিত্য নিয়ে সাময়িকীর জন্য মাঝেমধ্যে কিছু কিছু লেখা যেন তাঁকে দিই। প্রথম যে লেখা আমি হাসনাত ভাইয়ের সাময়িকীর জন্য দিয়েছিলাম, সেটা ছিল আলেক্সান্দর ব্লকের একটি কবিতার অনুবাদ। এরপর একে একে আমার অনেক লেখাই সাহিত্য সাময়িকীতে ছেপেছেন হাসনাত ভাই। সেসবের মধ্যে শুধু অনুবাদ নয়, রুশ কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে লেখা মৌলিক কিছু রচনা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও কিছু লেখা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মনে পড়ে, লেখা দেওয়ার বিরতি দীর্ঘায়িত হলে হাসনাত ভাই যে কেবল টেলিফোনে তাগাদা দিতেন তা-ই নয়, এমনকি আমার স্ত্রীকেও বলতেন লেখার কথা আমাকে মনে করানোর জন্য। স্বভাবতই সেই সময়ে আমার লেখালেখির জগৎ পুরোটাই ছিল হাসনাত ভাইকেন্দ্রিক। এর ফলে বিভিন্ন দেশের কবিদের অনেক কবিতার অনুবাদসহ বিদেশি সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি। পরবর্তীকালে আমার জন্য এটা খুবই মূল্যবান অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজে লেগেছে।
হাসনাত ভাই সম্ভবত আমাদের দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি সাহিত্যের পাতায় আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি নিয়ে লেখার জায়গা করে দিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয় ধরতে পেরেছিলেন বিদেশের শিল্প-সাহিত্যের জগৎ নিয়ে লিখতে বা জানতে হলেও সেই সব দেশ ও ভূখণ্ডে ঠিক কী ঘটছে, সেটি আঁচ করতে পারা লেখক-পাঠক উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীতে সে রকম একটি সাপ্তাহিক কলাম তিনি শুরু করিয়েছিলেন আমার দীর্ঘদিনের সুহৃদ-বন্ধু হাসান ফেরদৌসকে দিয়ে, পরবর্তী সময়ে যার সঙ্গে আমিও যুক্ত হই।

আমাকে অবাক করে দিয়ে সেটা তিনি ছেপেছিলেন একুশে সংকলনে। এর কারণ তখন ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি। তবে অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, তাঁর সেই বদান্যতা ছিল লেখালেখির জগতে আমার প্রবেশকে উৎসাহিত করার জন্য। এরপর থেকে মারা যাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগপর্যন্ত সেই চিরাচরিত অল্প কথায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার অনুরোধ হাসনাত ভাই আমাকে করে গেছেন এবং লেখার জন্য জায়গা করে দেওয়ার সেই মনোবৃত্তি সব সময় ধরে রেখেছেন। ফলে সৃজনশীল যেসব রচনা এ পর্যন্ত আমি লিখে উঠতে পেরেছি, তার সবটার পেছনে রয়েছে হাসনাত ভাইয়ের বিরাট বড় অবদান—এটা আমাকে বলতেই হবে।

১৯৯০ সালের শেষ দিকে দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত বেশ কিছু লেখা আমি ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীর সেই আন্তর্জাতিক কলামের জন্য লিখেছি, যদিও বিদেশযাত্রা আমার সেই লেখায় ছেদ টানে। তবে হাসনাত ভাই কিন্তু তাঁর তাগাদার কলম থামিয়ে রাখেননি। লন্ডন থেকে বিভিন্ন বিষয়ে লেখার জন্য নিয়মিত তাগাদা তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন। এই বাস্তবতায় তাঁর প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘কবিতার বিদেশ’ নামে একটি অনিয়মিত কলাম আমি ‘সংবাদ’ সাময়িকীর জন্য লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার বিলেতে বসবাসের প্রায় পুরো সময় ধরেই সেটা অব্যাহত ছিল।

‘কবিতার বিদেশ’-এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কবিদের কয়েকটি কবিতার অনুবাদের পাশাপাশি তাঁদের সাহিত্যকর্ম ও জীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থাকত। পরে আমি লন্ডন থেকে জাপানে চলে আসার পর ব্যতিক্রমী সেই কলামে ছেদ পড়ল। কিন্তু সাহিত্য সাময়িকীর জন্য অন্য ধরনের কিছু লেখা মাঝেমধ্যেই আমি পাঠিয়েছি এবং হাসনাত ভাই যথা যত্নে সেগুলো পত্রস্থ করেছেন। তত দিনে অবশ্য মতি ভাই আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন—শুরুতে ‘ভোরের কাগজ’ এবং পরবর্তীকালে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায়।

ফলে তখন থেকে হাসনাত ভাইয়ের পাশাপাশি আমার লেখালেখির দ্বিমুখী অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক মতিউর রহমান। ‘সংবাদ’ ছেড়ে হাসনাত ভাই ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদনার হাল ধরলে আগের মতোই আমাকে অনুরোধ করেছেন সেখানে লেখার জন্য। আমার পক্ষে তাঁর অনুরোধ অমান্য করা তো সম্ভব নয়। তাই ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার শুরু থেকেই নানা বিষয়ে লিখে গেছি আমি। লিখেছি তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত অনন্য ত্রৈমাসিক ‘শিল্প ও শিল্পী’তেও। সবশেষে তিনটি দেশে আমার দীর্ঘ সময়ের প্রবাসজীবন কাটানোর ওপর স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করলে আমি হাসনাত ভাইকেই বেছে নিয়েছিলাম প্রথম খণ্ডের প্রকাশক হিসেবে। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে ব্যয়বহুল সেই বই খুবই যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করায় হাসনাত ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

শিল্পীদের আঁকা ছবির পাশাপাশি বইপত্রের প্রতি হাসনাত ভাইয়ের ছিল অসম্ভব টান আর গভীর ভালোবাসা। বই তিনি পড়তেন এবং ভালো বাঁধাই ও ছাপার কোনো বই হাতের কাছে পেলে পরম যত্নে তার পাতা উল্টে দেখতেন। তাঁর দুচোখজুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়ত এক ভিন্ন আলোর বিচ্ছুরণ, যেটা আমি দেখেছি মতি ভাইয়ের বেলায়ও।

ফলে প্রতিবার দেশে যাওয়ার সময় তাঁদের দুজনের জন্যই আমি চেষ্টা করেছি ভালো কিছু বই নিয়ে যেতে। মনে আছে, একবার হাসনাত ভাইয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম ‘ফ্রিদা কাহলোর ডায়েরি’। অত্যন্ত উন্নত মানের ছাপা ও বাঁধাইয়ের সেই বই পেয়ে হাসনাত ভাইয়ের আনন্দ আমাকে কম আনন্দ দেয়নি। একইভাবে বছর তিনেক আগে ডেরেক ওয়ালকটের কবিতার পাশাপাশি হল্যান্ডের সমকালীন এক বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবির বইটিও হাসনাত ভাইকে আনন্দ দিয়েছিল।

আমাদের সময়ের কিছু তরুণের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে হাসনাত ভাইয়ের যে অবদান, তা ভোলার মতো নয়। তিনি যে ভালো লেখা সহজেই ধরতে পারতেন, তা-ই শুধু নয়, কাকে কতটা ঘঁষেমেজে লেখার জগতে নিয়ে আসা যাবে, সেই দৃষ্টিও তাঁর ছিল প্রখর। এখন এর সবটাই হাসনাত ভাইয়ের বিদায়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এলেও হারিয়ে যায়নি। কারণ, যত দিন আমরা লেখালেখির মধ্যে থাকব, হাসনাত ভাইও তত দিন বেঁচে থাকবেন আমাদের সৃজনশীলতায়। এটুকুই হাসনাত ভাই! আপনার বিদায়ে চোখ সজল হয়ে এলেও যে পরিপূর্ণ জীবন আপনি কাটিয়ে গেছেন, সে কথা মনে হলে দুঃখিত হওয়ার অবকাশ থাকে না। তবু আপনার এই হঠাৎ চলে যাওয়া আমাদের ব্যথিত করে।

বুকে ব্যথা জাগে এ কারণে যে এরপর যখন দেশে যাব, আপনার সান্নিধ্য আর পাব না। আপনি ভালো থাকবেন পরপারের তারকাখচিত আকাশে নক্ষত্রের মেলায়!
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]