আমার একাত্তর

১৯৭১ সালের ছবি অবলম্বনে কোলাজ করেছেন মনিরুল ইসলাম
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কেমনভাবে কেটেছে অবরুদ্ধ সারাধণ মানুষের দিনকাল? এই লেখায় আছে টুকরো টুকরো সেই সব ছবি।

আমরা চলছি, ঠিক বললাম কি? আমরা কি চলছি? না তো, আমরা পালাচ্ছি! ধানমন্ডি ১৪ নম্বর রোডের ৫৫১ বাড়িটি, যাকে বাবা নাম দিয়েছেন ‘রূপকথা’, সেটি ছেড়ে ছাই রঙের পেছনে খোলা পিকআপটা যখন বেরোল, আকাশটা তখন কালো মেঘে গুমট হয়ে আছে। ৮ নম্বর ব্রিজটা পেরিয়ে হাতের বাঁয়ে বাঁক নিয়ে ১৬ নম্বর রাস্তা ধরে পিকআপটা উঠল মিরপুর রোডে। সামনের সিটে বসা মা–বাবা আর চালক, যিনি মায়ের খালাতো ভাই ফারুক মামার সহকর্মী। মায়ের কোলজুড়ে বসেছে ভীষণ হৃষ্টপুষ্ট, গোলাপি গাল আর কটা চোখের আমাদের সবার মহা আদরের ছয় মাসের ছোট্ট ভাই রুশো, পিকআপের পেছনে, অর্থাৎ মাল টানার জায়গায় পা ছড়িয়ে বসেছি আমরা বাকি চার ভাইবোন—রুমি, রিমা, রিয়া, রিফি—ফুফাতো ভাই শামিম, জন্ম থেকে আমাদের দেখাশোনা করার আনজনি বু আর গৃহকর্মী শুকুর আলী। আকাশের পূর্বাভাস দেখে আমাদের যাত্রা প্রায় স্থগিত হতে বসেছিল। ফারুক মামা আমাদের খাবারের টেবিলে পাতা প্লাস্টিকটা কায়দা করে বেঁধে পিকআপের কিছুটা অংশ ঢেকে দিয়ে মাকে বললেন, ‘অলি আপা, চলেই যান।’

ঝড়–বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। আমার খুব প্রিয় ধানমন্ডি লেকটা যেন আমার দিকে কেমন করুণ চোখে তাকাচ্ছিল! বলছিল, ‘কেন যাচ্ছো? তোমরা চলে গেলে আমার গায়ে বসানো মাছ ধরার মাচাগুলোতে দৌড়ে এসে হল্লা করবে কারা? বাবা–মায়ের চোখ লুকিয়ে ছুটির দিনে আমার গায়ে আছড়ে পড়ে দাপাদাপি করবে কারা? আমার নিচ থেকে গুল্মলতা তুলে অ্যাকুয়ারিয়াম সাজাবে কারা? মাঝে মাঝেই আমার জলে ভেসে বেরিয়ে আমাকে গভীর আনন্দে আর সৌন্দর্যে ভরিয়ে রাখা তোমাদের হাঁসগুলো? ওদের রেখে যাচ্ছো কার কাছে?’লেকের পানিতে আমার চোখের দুফোঁটা জল মিশে গেল কি? আপন মনে বললাম, ‘আমাদের যে কোনো উপায় নেই, যেতেই হবে। তুমি তো দেখছ, তোমার লাগোয়া ওই কোনার বাড়িটায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প করেছে। কদিন আগেই সেখানে বোমা ফুটিয়েছে আমাদের দামাল ছেলেরা, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করেছে তারা। তুমি তো জানো, পাশের বাড়ির আমার মায়ের চাচারা পালিয়ে যাবার পর মাঝে মাঝে ওখানে আর্মি আসে। সে জন্য আমাদের ছাদে বা মাঠে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। দুই বাড়ির দেয়ালে তৈরি দরজাটা ছিল যখন–তখন চলাচলের পথ। এখন সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তোমার টলটলে জলে, সবুজ গালিচার মতো ঘাসে ঢাকা পাড়গুলোতে বা ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আমরা আর নিরাপদ নই।’

‘রেপ’ শব্দটার সাথেও পরিচয় হয়ে গেল এই কদিন আগে। ফোনে মা মেজো মামিকে জানাচ্ছিলেন, ১৩ বছরের কোন মেয়ের পরপর কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা রেপের খবর। ঢাকা মেডিকেলে সেই মেয়ে নাকি রক্তের বন্যায় ভাসছিল। আমার বয়স ১২ আর রিমার ১৩। মগজে গেঁথে গেল রেপ হবার ভয়। সে ভয় কিন্তু আমার বহু যুগ সাথে থেকেছে। ২৭ মার্চ বড় ফুফুর দুই ছেলে হুমায়ুন ও কমল ভাইকে নিয়ে যাচ্ছিল দখলদার বাহিনী। ফুফু উর্দুতে সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসারকে নিজ সন্তান বলে দাবি করে সুরা ইয়াসিন মুখস্থ বলে, হাতে–পায়ে ধরে রক্ষা করেছেন তাদের প্রাণ। ভোর হতে না হতেই তাঁর মেয়ে ১৪ বছরের নাজু আপাকে রেখে যান আমাদের বাড়ি। কিছু কিছু বিদেশি বাস করে বলে ধানমন্ডি নাকি এখনো খানিকটা নিরাপদ। আমাদের চাচা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, যুদ্ধের পক্ষে বিশ্বমত গড়ছেন আর তহবিল সংগ্রহ করছেন। ফলে ইস্কাটনে তাঁদের বাড়ি ‘রোজেনডেল’ এখন পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলে। বাড়ির সিন্দুকে থাকত বৃহত্তর পরিবারের গয়না।

পাকিস্তানি সেনারা আসছে বুঝতে পেয়ে কোনো এক কর্মচারী সিন্দুকটা ৬ বিঘার সে বাড়ির পুকুরটায় ডুবিয়ে দেন। সেনাবাহিনীর লোকেরা নাকি সেই সিন্দুকের খোঁজে আত্মীয়স্বজনের যোগাযোগ করছে। দুই ফুফুসহ আর সব আত্মীয়স্বজন ঠিক করে ফেলেন, তাঁরা গ্রামে চলে যাবেন। বাবাকেও (আশরাফ সিদ্দিকী) তা–ই করার পরামর্শ দিলেন। তাই তো মালবাহী পিকআপে করে মুরগির বাচ্চার মতো আমরা চলেছি গ্রামে।
পিএইচডি করে ফেরার সময় বাবা নীল রঙের একটা ডাটসান ব্লুবার্ড গাড়ি এনেছিলেন। সে গাড়িও আমাদের পরিবারেরই একজন যেন! সে গাড়ি নিয়ে যাওয়াই স্থির ছিল। কিন্তু দুধওয়ালার খবর ছিল, সাভারের নয়ার হাটের কাছে ব্রিজটা আমাদের মুক্তিসেনারা ভেঙে দিয়েছেন, সেখানে যে ডাইভার্সন করা হয়েছে, তাতে ট্রাক বা জিপ চলতে পারে, কিন্তু আমাদের এই গাড়ি কিছুতেই পার হতে পারবে না। ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন ফারুক মামা। তিনি তাঁর অফিসের পিকআপ আর সহকর্মীকে নিয়ে এলেন। সেই সহকর্মী বহু বছর পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেছেন। তাঁর স্ত্রী বেলুচিস্তানের। তিনি উর্দু, পশতুন, বালুচ—সব ভাষায় পারদর্শী। তিনিই নামিয়ে দেবেন আমাদের। আমাদের দেশে যেতে নামতে হয় কালিহাতী। কাদেরিয়া বাহিনী ষোলাকুরার ব্রিজ ভেঙে দিয়েছে বলে আমাদের তার আগেই নেমে যেতে হবে। তারপর হেঁটে যেতে হবে ১৬ মাইল।

‘রেপ’ শব্দটার সাথেও পরিচয় হয়ে গেল এই কদিন আগে। ফোনে মা মেজো মামিকে জানাচ্ছিলেন, ১৩ বছরের কোন মেয়ের পরপর কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা রেপের খবর। ঢাকা মেডিকেলে সেই মেয়ে নাকি রক্তের বন্যায় ভাসছিল। আমার বয়স ১২ আর রিমার ১৩। মগজে গেঁথে গেল রেপ হবার ভয়। সে ভয় কিন্তু আমার বহু যুগ সাথে থেকেছে। ২৭ মার্চ বড় ফুফুর দুই ছেলে হুমায়ুন ও কমল ভাইকে নিয়ে যাচ্ছিল দখলদার বাহিনী। ফুফু উর্দুতে সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসারকে নিজ সন্তান বলে দাবি করে সুরা ইয়াসিন মুখস্থ বলে, হাতে–পায়ে ধরে রক্ষা করেছেন তাদের প্রাণ। ভোর হতে না হতেই তাঁর মেয়ে ১৪ বছরের নাজু আপাকে রেখে যান আমাদের বাড়ি। কিছু কিছু বিদেশি বাস করে বলে ধানমন্ডি নাকি এখনো খানিকটা নিরাপদ।

পিকআপ চলছে। প্রথমে থামতে হলো একটি চেকপোস্টে। কয়েকজন সিপাহী এগিয়ে এসে চালকের জানালার দিকে ঝুঁকল। কাচ নামিয়ে মামার সহকর্মী প্রথমে উর্দু, পরে অপরিচিত এক ভাষায় কথা বললেন। একজন সরে এসে আমরা যেখানে বসে আছি, সেই ডেকটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল। সামনে দণ্ডায়মান ব্যক্তি পিকআপের ভেতরে মুখ গলিয়ে সব দেখে মায়ের ব্যাগটা দিতে বলল। মায়ের ব্যাগটা হাতে তুলে ওজন করে খুলতে চেষ্টা করল। পারল না। মা স্কুলে কাজ করেন বলে শক্ত ধাঁচের ব্যাগ ব্যবহার করেন। তাঁর ভাইয়েরা তাঁকে পাঠান সেসব ব্যাগ বিদেশ থেকে। মাকে ব্যাগটা ফেরত দিয়ে চোখের ইশারায় বলল, ‘খোল’। মা একঝটকায় ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে মোচড় দিয়ে ব্যাগটা খুলে দিলেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে আঁতিপাঁতি করে ব্যাগে সে কী খুঁজল, সে–ই জানে। তবে মায়ের ভারী চাবির গোছাটা দেখে আশ্বস্ত হলো। বোঝা গেল, ব্যাগটা কেন ভারী ছিল, তা–ই দেখা। হয়তোবা ভেবেছে গ্রেনেড!
আবার চলল আমাদের শকট। হঠাৎই সবার চোখ আটকে গেল রাস্তার দুপাশে। ও মা একি, রাস্তার দুপাশের গাছগুলো এমনভাবে ন্যাড়া হলো কী করে? শুধু কাণ্ড আর শাখাগুলো এলোমেলো ঝুলছে। কোনো পাতা নেই! কী বীভৎস দৃশ্য। যেন গাছেরা কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সাদা নয়, লাল টকটকে কঙ্কাল! পরে বাবা বললেন, মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করতে দখলদার পাকিস্তানি সেনারা সুপরিকল্পিতভাবে এসব করেছে। হঠাৎ করে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। টেবিলের ক্লথের নিচে গিয়ে ঢুকলাম সবাই।

কাল বৈশাখীর মৌসুম সমাগত, এই সময়ের দাপুটে হওয়ায় টালমাটাল বৃষ্টি কি কিছু মানে? কিছুক্ষণের মাঝেই ভিজে একশা! বেচারি মা, পেছনে ফিরে অসহায় চোখে আমাদের দেখছিলেন। হঠাৎ করে আমরা ভুলে গেলাম যে আমরা জীবন হাতে নিয়ে ছুটছি। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে যা কিছু। ভাইবোনেরা বৃষ্টিভেজার খেলায় মেতে উঠলাম। ঝাপসা বৃষ্টির মাঝে হঠাৎ দেখলাম, উল্টো দিক থেকে খুব কাছে কী যেন একটা ছুটে আসছে। শুধু দুটো হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। কাছাকাছি এসে অনবরত হর্ন বাজিয়ে রাস্তা ছাড়তে বলছিল বোধ হয়! আমাদের চালক যতটা পারলেন নেমে এলেন সাইড রোডে। সেই বিশাল দৈত্যকায় আর্মি ট্রাকটা তারপরও তাল সামলাতে পারল না। হাইওয়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে যেতে লাগল। একসময় প্রায় ৮ ফুট নিচে শস্যখেতে গিয়ে থামল। সাথে সাথে সেই ট্রাকের পেছন থেকে লাফিয়ে নামল ১৫–২০ জন জোয়ান/ সিপাহী। আমাদের পিকআপের দিকে বন্দুক তাক করে চিৎকার করতে থাকল, ‘রোক্ক, রোক্ক’। আমাদের চালক কিছুই বুঝতে না পেরে তাঁর মতো গাড়ি মূল রাস্তায় এনে চালাতে শুরু করেছিলেন। পেছন থেকে আমরা সবাই একসাথে গাড়ির বডিতে বাড়ি দিয়ে গাড়ি থামালাম। ততক্ষণে রাস্তাজুড়ে সব পজিশন নিয়ে নিয়েছে এবং ফাঁকা গুলিও ছোড়া হয়ে গেছে। অবস্থা সঙিন বুঝতে পেরে মামার সহকর্মী গাড়ি ব্যাক করে করে পেছনে আসতে থাকলেন। একেকটা মুহূর্ত যেন মনে হচ্ছিল একেক ঘণ্টা। শোয়া অবস্থা থেকে লাফ দিয়ে উঠে বন্দুক তাক করে রেখেই দৌড়ে এল খাকি পোশাকধারীরা। কাছাকাছি আসতেই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল তারা, ‘সাইড কিউ নেহি দিয়া? হামলোগকো মারনা চাহতে থে কেয়া?’

আমাদের গ্রামের বাড়ি। এখানেই ১৯৭১ সালে পালিয়েছিলাম আমরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মামার সহকর্মী দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হাতজোড় করে চোস্ত উর্দুতে বললেন, ‘সাইড তো দিয়া, হামারা কৌই কাসুর নাহি থা,’ ড্রাইভারটি তেড়ে মারতে এল, বলল, ‘মেরা কাসুর এহি থা জো ম্যায়নে তুমকো বাঁচায়া।’ বেশ কিছু সময় চলল তাদের অশ্রাব্য বচন। এই সময় ভীষণ সুপুরুষ এক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হাত তুলে তার সহকর্মীদের থামাল। তার বয়স কোনো অবস্থায়ই ১৯ বা ২০–এর বেশি হবে না। ওপর দিকে হাত তুলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বলল, ‘আল্লাহ বাঁচানেওয়ালা উনুনে সাবকো বাঁচা দিয়া।’ এদিকে হিংস্র সিপাহীগুলো উৎসুক চোখে খোলা গাড়িতে ভিজে চুপসানো আমাদের দেখছে। একলহমায় হিম হয়ে গেল হাত-পা। কানে বাজতে লাগল মেজো মামির সাথে মায়ের ফোনালাপ, ১৩ বছরের মেয়ের ওপর বর্বরদের হিংস্রতা। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট বলতে লাগল, ‘চালে যাও যাহা জানা হ্যায়।’

আবার ছুটল আমাদের পিকআপ। সবার মুখে ভয়ের রেখা। মৃত্যু যেন কাছে এসে পিঠ চাপড়ে আবার চলে গেল। বিড়ম্বনার শেষ কোথায়? টাঙ্গাইলের কাছাকাছি এসে যন্ত্রের যন্ত্রণা শুরু হলো। বিগড়ে গেল গাড়ি। বহু চেষ্টা করেও আর চালানো গেল না। ঠিক হলো বাকি পথ বাসে যেতে হবে। ভয়ে আমার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল। সকালে যখন ফারুক মামা আর তাঁর বন্ধু পিকআপ নিয়ে এলেন, দেখলাম গাড়ির ওপর কোনো মালামাল রাখতে হবে না। এর ডিগ্গিটা পেটের মাঝে। ট্রাঙ্ক ভরে যখন ডিগ্গি বন্ধ করা হলো, তখন বোঝাই গেল না যে এতে ডিগ্গি আছে। ব্যাপারটা দেখে আমার মনে হলো, কেউ যখন দেখতেই পারে না ডিগ্গি কোথায়, তবে আমি কেন আমার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এখানে রেখে যাব? ১৯৭০ সালের পিআইএর কালো ডায়েরিটা তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ওতে আমি এক বছর ধরে বঙ্গবন্ধু আর ছাত্রনেতা, যাঁদের তখন সবাই বলত চার খলিফা, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার অংশ আর ছবি সেঁটে রেখেছি।

এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কবিতা, বান্ধবীদের শুভেচ্ছা, সব আছে সে ডায়েরিতে। রয়েছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ থেকে শুরু করে আ স ম আবদুর রব বা শাজাহান সিরাজের ‘বাংলাদেশে শুধু জুঁই আর চামেলি ফোটে না, এ দেশে রক্তগোলাপ, কৃষ্ণচূড়া আর রক্তকরবীও ফোটে’ অথবা ‘ইয়াহিয়া তুমি বাংলা ছাড়ো, চৈত্রের কাঠফাটা রৌদ্রে এ দেশের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তখন সে মাটি পাথরের মতো শক্ত। এই মাটিতে হাঁটতে গেলে তুমি রক্তাক্ত হয়ে যাবে’—এগুলোও। আবার সে সময় সাবিনা, খুরশীদ আলম, আবদুল জব্বারের যে গানগুলো অনবরত টিভিতে দিত, যেমন ‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম, চলবে দিনরাত অবিরাম’, এগুলোও সব ওই ডায়েরিতে লেখা।

আমি সেই ডায়েরি একটা খালি গুঁড়া দুধের কৌটায় গোল করে পেঁচিয়ে ঢুকালাম। তার ওপর চুল বাঁধার স্কার্ফ, কলম আর বান্ধবী রিনার দেওয়া কমলা রঙের কানের দুলটা নিলাম। আস্তে করে সেটি একটা ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে দিলাম। এখন বাসে যেতে হলে সেটি তো ধরা পড়বে। দুই ঘণ্টা প্রায় বাসস্টপে বসা। ট্রাঙ্কটা দেখছি আর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি।

বাসস্টপ ভরা শুধু সৈন্য। একসময় ট্রাঙ্কগুলো তোলা হলো বাসের ছাদে। আমাদের প্রত্যেককে চেক করা হলো বাসের ওঠার আগে। ছাদের সব মালামাল চেক করা হবে। রুমি ভাই তাই চাবি নিয়ে ছাদে গেল ট্রাঙ্ক খুলে দেখাতে। রুমি ভাই কাপড়–জামা সরিয়ে সরিয়ে তল্লাশিকারীকে সহযোগিতা করছে। প্রথম ট্রাঙ্ক দেখার সময় সৈন্যটি আরেকজন তল্লাশিকারীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘ইয়ে লারকা তো বহত স্মার্ট দেখা যাতা হেয়।’ ততক্ষণে রুমি ভাই দ্বিতীয় ট্রাঙ্কের চাবি ঘোরাচ্ছে। সৈন্যটি বলে উঠল ‘ছোড় ইয়ার। তুমলোগ তো গার্নেট (গ্রেনেড) লে কার যাতে হো, ইসিলিয়ে তো চেক কারনা পারতা।’ রুমি ভাই নেমে এল। বাসটা চলতে শুরু করল। আর আমার? আমার ধড়ে প্রাণ এল!

আস্তে আস্তে একসময় পৌঁছে গেলাম ষোলাকুরা। বাসা থেকে নেমে তিন বোন চোখেমুখে উত্তেজনা চেপে দৌড়ালাম ব্রিজটার কাছে। দেখলাম, ব্রিজের উড়িয়ে দেওয়া জায়গাটা! বিজয়ের আনন্দে মনটা চনমনিয়ে উঠল। কাদেরিয়া বাহিনীর ভেঙে দেওয়া ব্রিজটাই যেন আমাদের বিজয়কেতন! ব্রিজের পাশ ঘেঁষে সবাই নেমে গেলাম নিচে। নৌকায় করে ওপারে গিয়ে তবে শুরু হবে ১৬ মাইল হাঁটা। ব্রিজ থেকে নেমে দেখি, কী অদ্ভুত সুন্দর সে জায়গাটা! নদীটার দুধারে বাতাসে দুলছে আমাদের পেটসমান উঁচু মৌরির ঘন সবুজ পাতা। চারদিক ম–ম করছে মৌরির সুবাসে। এত বছর পরও মৌরির ঘ্রাণের সাথে ফিরে আসে আমার একাত্তরে পালিয়ে যাবার সেই স্মৃতি।

হঠাৎ করে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। টেবিলের ক্লথের নিচে গিয়ে ঢুকলাম সবাই। কাল বৈশাখীর মৌসুম সমাগত, এই সময়ের দাপুটে হওয়ায় টালমাটাল বৃষ্টি কি কিছু মানে? কিছুক্ষণের মাঝেই ভিজে একশা! বেচারি মা, পেছনে ফিরে অসহায় চোখে আমাদের দেখছিলেন। হঠাৎ করে আমরা ভুলে গেলাম যে আমরা জীবন হাতে নিয়ে ছুটছি। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে যা কিছু। ভাইবোনেরা বৃষ্টিভেজার খেলায় মেতে উঠলাম। ঝাপসা বৃষ্টির মাঝে হঠাৎ দেখলাম, উল্টো দিক থেকে খুব কাছে কী যেন একটা ছুটে আসছে। শুধু দুটো হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। কাছাকাছি এসে অনবরত হর্ন বাজিয়ে রাস্তা ছাড়তে বলছিল বোধ হয়! আমাদের চালক যতটা পারলেন নেমে এলেন সাইড রোডে। সেই বিশাল দৈত্যকায় আর্মি ট্রাকটা তারপরও তাল সামলাতে পারল না। হাইওয়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে যেতে লাগল। একসময় প্রায় ৮ ফুট নিচে শস্যখেতে গিয়ে থামল। সাথে সাথে সেই ট্রাকের পেছন থেকে লাফিয়ে নামল ১৫–২০ জন জোয়ান/ সিপাহী। আমাদের পিকআপের দিকে বন্দুক তাক করে চিৎকার করতে থাকল, ‘রোক্ক, রোক্ক’।

আমাদের গ্রাম নাগবাড়িতে পৌঁছাতে বিকেল গড়াল। এ গ্রামের সব ঘরেরই কেউ না কেউ ঢাকা বা অন্য শহরে চাকুরে। ঈদের সময় সবাই গ্রামে চলে আসে। ঈদ ছাড়াই এবার ঘরে ঘরে মানুষ। তফাৎ শুধু এখানেই যে কারও মুখে হাসি নেই, কপালে আছে দুশ্চিন্তার ছাপ।

এ বছরের শুরুতে কোভিড-১৯–এর কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসীরা যেমন গ্রামমুখী হয়েছিলেন, যুদ্ধের সময়টার সাথে তার রয়েছে গভীর মিল। আমাদের মালামাল রয়ে গিয়েছিল চারান গ্রামে, বড় ফুফুর বাড়িতে। পরদিন সেগুলো এল। সাথে ফুফুও এলেন। বললেন, ‘রিয়া কোথায়?’ কাছে দৌড়ে যেতেই বিরাশি শিক্কার এক থাপ্পড়। ‘প্রাণের ভয়ে দেশে আসছি আর তুই আমাদের সক্কলের মরার ব্যবস্থা করছিলি। ব্যাদ্দপ মেয়ে! কোন আক্কেলে তুই এই ডায়রি আনসিস?’ মায়ের তো চক্ষু ছানাবড়া। প্রচুর গালমন্দ চলল কয়েক দিন!

মাসখানেক ছিলাম আমরা গ্রামে পালিয়ে। শহর থেকে যাওয়া আর গ্রামের সব ফুফাতো, চাচাতো ভাইবোনদের সাথে দিনভর শুধু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আর গল্প। কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বের গল্প তখন এলাকার অনেকেই জানে। ভারতে না গিয়েই যুদ্ধ করছে তাঁর দল। আমাদের গ্রামের কাছাকাছি সখীপুরের জঙ্গলে তাঁদের আস্তানা। মনে হতো ইশ্‌! গিয়ে যদি একবার দেখতে পারতাম মুক্তিসেনাদের সেই আস্তানা! অসুবিধা কী, কাদের সিদ্দিকী তো আমাদেরই চাচা! সমস্বরে অনেকগুলো ছড়া কাটতাম আমরা।

এই রাস্তা ধরেই মুচু মিয়ার সাইকেল চুরি করে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেত রিমা । আমরা দুবোনই এখন ষাটোর্দ্ধ। আর সেই কাঁচা রাস্তটি এখন পিচ ঢালা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

‘ইলিশ মাছের ৩০ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, টিক্কা শালা ভিক্ষা করে শেখ মুজিবের বাড়ি।’ বাবা পছন্দ করতেন পাঞ্জাবি কাটার গল্পটা। ডাক দিয়ে বলতেন, ‘এই কামার সামা, এই রিফিফ আয় তো, শোনা তো সেই দরজির গল্পটা। রিফিফ হতো দরজি আর কামার সামা পাকিস্তানি সৈন্য। পাকিস্তানি সৈন্য সেজে কামার সামা কল্পনার দরজায় টোকা দিয়ে বলত, ‘তুম আন্দার কেয়া করতা হ্যায়?’ দরজিরূপী রিফিফ বলত, ‘হাম পাঞ্জাবি কাটতা হ্যায়’, পাঠান সৈন্যরূপী কামার সামা, পাঞ্জাবি সৈন্য কাটা হচ্ছে শুনে ভোঁ দৌড়। দাদি, দাদির ছোট বোনও এসে শুনতেন আর ফোকলা দাঁতে ফিক ফিক করে হাসতেন। এসব গল্পের মধ্য দিয়েই যেন আমরা যুদ্ধজয়ের আনন্দ পেতাম।

কাসুন্দি আর টক লিচু মেখে দিতে দিতে সারু ফুফু শোনাতেন স্বদেশি আন্দোলনের কথা। চাঁদের আলোয় দেখাতেন সেই ব্রতচারী নৃত্য, যা তাঁরা সে সময় স্কুলে করতেন আর তার সাথে সেই কবিতা, ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই, মা যে তোদের দ্বীন–দুঃখিনি এর বেশি আর সাধ্য নাই।’ বলতে বাধা নেই, চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেও একধরনের মুক্তি ছিল। জেসমিন, লিখন, জেলি, বেলি, জবা—সবাই মিলে কাঁচা আম পাড়ছি। ভর্তা বানাচ্ছি, চিনি নেই, তো গুড় দিয়েই মাখাচ্ছি। তরতর করে গাছে চড়ছি। ভীতু জেসমিনটা গাছে চড়তে ভয় পায়। চালের গুদামের মটকার গা থেকে মই চুরি করে এনে তা–ই দিয়ে জেসমনিকে গাছে উঠাচ্ছি। ১০টা বাজতে না বাজতে পুকুরে দাপাচ্ছি। দাদির কাছ থেকে চাল–ডাল আর মুরগি নিয়ে জোলাভাতি খেলছি।

বড় চাচা দেশেই থাকতেন। চাচাতো ভাই শাহিনের কাণ্ডকীর্তি আমাদের মাতিয়ে রাখত। আমাদের বল্লার সন্দেশ বা রতনগঞ্জের বাদাম টানা খাওয়াবে বলে সে চাচার কাছে যখন–তখন টাকা চাইত। চাচা তাড়া করলে তরতর করে সুপারিগাছ বেয়ে বাড়ির টিনের চালে উঠে গ্রামের গোলাম আলী ফকিরের দরগাহর এক পাগলকে নকল করে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নাচত। ‘আপনের ট্যাকায় আমি মুতি’। বিভিন্ন গৃহস্থ বাড়ি ঘুরে ঘুরে কত কী শিখেছি। গমের শিষ দিয়ে শাড়ির পারের লাল–নীল রঙের সুতা তুলে পাখা বানানো শিখেছি। যুদ্ধের কারণে অনুষ্ঠান ছাড়াই আফরোজ কাক্কাকে বিয়ে করানো হয়েছিল। আমরাই চাচিকে সাজিয়েছি। রুসমত করেছি।

বাবা এসেছেন শুনে বিশাল বপু আর ততধিক বিশাল মধ্যদেশ নিয়ে মুচু মিয়া সাইকেলে করে দেখা করতে আসতেন। তাঁর পোশাকি নাম শামসুদ্দোহা সিদ্দিকী। তিনি আবু সাঈদ চৌধুরীদের এস্টেট দেখাশোনা করতেন। তিনি এলেই বেশ একটা হাসির রোল উঠত ছোটদের মাঝে। কারণ, এই বিশালদেহী মুচু মিয়ার গলাটি ছিল ভীষণ সরু। আমার পিঠাপিঠি বোন রিমাকে সবাই টমবয় ডাকত। উনি এলেই তাঁর সাইকেলটা নিয়ে গ্রামের কাঁচাপথ ধরে উধাও হয়ে যেত সে। মাঝে মাঝে আমাকেও নিত ডাবল রাইডিং করে। মুচু মিয়া বারবার উঠতে গিয়ে সাইকেলটা না পেয়ে লজ্জামিশ্রিত বিরক্তি নিয়ে বাধ্য হতেন আরও কিছুক্ষণ বসতে।

বড় খালার একটা ছোটা ট্রানজিস্টার রেডিও মায়ের কাছে রাখা ছিল। খবর শোনার জন্য মা সেটি সঙ্গে করে এনেছিলেন। রাত আটটায় উঠানে বেশ একটা জটলা হতো এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শোনার জন্য। পরদিন আবার যা শুনতাম, তার নাটক চলত। কেউ সৈন্য, কেউ স্থানীয় সহযোগী, কেউ মশা, কেউবা জোনাকি পোকা। গ্রামের পথ দিয়ে চলছে পাকিস্তানি সেনারা। মশার কামড়ে তারা ক্ষতবিক্ষত। স্থানীয় সহযোগী বিচলিত হয়ে বলল, ‘বাত্তিটা নিভাইয়া আগান, মশা তয় দেখতে পাইব না’। টর্চ নেভাতেই ছোটরা সব জোনাকির অভিনয় করত। তখন কাতর পাকিস্তানি সেনারা জোনাকি পোকার আলো দেখে বলছে, ‘মুক্তিবাহিনীর মতো এ দেশের মশারাও চালাক, নিজেরাই টর্চলাইট জ্বালিয়ে আমাদের কামড়াতে এসেছে।’ আমাদের কাছে মশারাও হয়ে যেত মুক্তিযোদ্ধা!

পাকিস্তানি সৈন্যরা নৌকা থেকে নেমে হেঁটে ভারী অস্ত্র নিয়ে সোজা গিয়ে দক্ষিণ বাড়ি, অর্থাৎ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়িতে উপস্থিত হলো। দীর্ঘ সময় ধরে শেল মেরে মেরে আবু সাঈদ চৌধুরীর বাবা আবদুল হামিদ চৌধুরীর তৈরি বিশাল অট্টালিকাটি ভাঙার চেষ্টা করল। ভাবটা যেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার উচিত শাস্তি তারা বিচারপতি ও তাঁর গ্রামবাসীকে দিয়ে গেল। বাড়িটির ব্যাপক ক্ষতি করতে পারলেও সেটি গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি। আজও বীরদর্পে স্বাধীনতার ইতিহাস বুকে করে দাঁড়িয়ে আছে সেই অট্টালিকা। তবে দালানবাড়ির আশপাশের কাঠ আর টিনের তৈরি আমাদের প্রিয় ঘোড়াশাল, হরিণের ঘর, ময়ূরের ঘর, গোয়লঘর, কাচারিঘর, অফিসঘর—সব কিছুতে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সেই সৈন্যরা। কদিন ধরে দাউ দাউ করে জ্বলল সব। গ্রামবাসী কচুরিপানার ভেতর থেকে সৈন্যদের প্রতি তীব্র ঘৃণায় দেখল সে আগুন। যাবার সময় নিঃস্বার্থ এস্টেট ম্যানেজার সেই বিশালদেহী মুচু মিয়াকে মূল দালানের সামনে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে রেখে গেল সৈন্যরা।

রুমি ভাই, শামিম ভাইরা রাত ১০টা পর্যন্ত জেগে থাকত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংবাদ পরিক্রমা’ শোনার জন্য। গ্রামে তো তখন বাতি নেই। সন্ধ্যার মাঝে খাওয়াদাওয়া শেষ। রাত ৮টা পর্যন্ত জেগে থাকাই কঠিন, সেখানে ১০টা তো মধ্যরাত! তারপরও ঢুলতে ঢুলতে অপেক্ষা করতাম। দেবদুলালের সেই ব্যঙ্গাত্মক কথাগুলো এখনো কানে বাজে, ‘কী বললেন সমিরনের মা? আপনার ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে। আপনার বাড়িতে আগুন দিয়েছে? আমাকে বলছেন আপনার কান্না বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেব? না না, তা কী করে হয়? এটা তো পাকিস্তানের ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার।’

শতচেষ্টা করেও ভাঙতে না পারা প্রয়াত চাচা বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরীর বাড়ি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমাদের আলো ভাই (নাট্যকার মামুনুর রশীদ), আমার বাবার আপন ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে যোগ দিয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতারে। তাঁর গর্বে আমরা সবাই তখন গর্বিত। হামিদপুরের কুমারদের চুল্লিতে রাখা পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রের খোঁজ কাদের সিদ্দিকীকে তিনিই দিয়েছিলেন। তা–ই দিয়ে শুরু হয়েছিল দেশের ভেতর থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নাগবাড়ি গ্রামের আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অনেকেই তখন মুক্তিযুদ্ধে। আলতু কাক্কা (আলতাফ সিদ্দিকী), তুলা ভাই (আলী আজগর সিদ্দিকী), বাবুল ভাই (বাবুল সিদ্দিকী) যুদ্ধ করছেন কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে। দাদার প্রিয় বর্গাচাষি এবং বাবার ছেলেবেলার বন্ধু টংকু মাতবরের ছেলে শাজাহান যুদ্ধ করছেন নবী নাওয়াজের দলে। এলাকার মুক্তিফৌজদের অর্থ ও খাবারের জোগানদাতা ছিল গ্রামের পরিবারগুলো। আমার দাদা আবদুস সাত্তার সিদ্দিকী তাঁদের একজন। যুদ্ধ শেষে যেবার প্রথম দেশে যাই, মনটা ভেঙে গিয়েছিল টংকু মাতবরের বুকফাটা আর্তনাদে, ‘মিয়া ভাই, আমার শাজাহান আর নাই। অ্যাকশনে ভুঞাপুরে শহীদ হইছে। তার লাশটাও পাওয়া যায় নাই।’

বাড়িভরা এত লোকের খাবার জোগানো ছিল বেশ কঠিন। মাছ–গোশতের পালা খুবই কম। নানা রকম সবজি আর ডালের ব্যঞ্জনের মাঝে একটা এখনো আমার জীবনে রয়ে গেছে, নাম বেগুন খাসি। লম্বা বেগুন আড়াই ইঞ্চি টুকরো করে দুই দিক থেকে ফুলের মতো করে কেটে তেঁতুল, গুড় আর পাঁচফোড়ন দিয়ে রাঁধা। বেগুন খাসি নামের জন্য প্রথমবার পাতে নিয়ে খাসির গোশতের টুকরো না পেয়ে খুবই আশাহত হয়েছিলাম!
যুদ্ধের আরেকটা ধাক্কা আমরা প্রায় রোজ অভিজ্ঞতা করতাম। সকাল থেকে ৫–৬ জন শুকনা মুখের তাঁতি গাট্টিতে করে তাঁদের শাড়ি নিয়ে আসতেন। হাতজোড় করে অনুরোধ করতেন কিছু শাড়ি কিনতে। এঁদের বেশির ভাগ হিন্দুধর্মাবলম্বী। তাঁরা এসব বিক্রি করে যা–ই পাবেন, তা–ই নিয়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যাবেন। দখলদার পাকিস্তানি সেনারা এলে তাঁদেরকেই তো মারবে সবার আগে। মা–ফুফুরা সহানুভূতির সাথে কিনতেন, তবে কত আর কেনা যায়। কে জানে, এঁদের কতজন সীমানা পেরোতে পেরেছিলেন! এর মাঝে খবর এল, ময়মনসিংহের বাবার স্কুলজীবনের প্রিয় বন্ধু নুরুল হুদাকে মেরে ফেলেছে বর্বর সৈন্যগুলো। সে কদিন বাবার ছটফটানি আর দেখা যাচ্ছিল না।

এই সময় সবার চাকরিতে যোগ দেবার নির্দেশ এল, অন্যথায় ব্যবস্থা নেয়া হবে। মা-বাবা দুজনকেই কাজে যোগ দিতে হবে। বৃহত্তর পরিবারে সবাই থেকে গেল, শুধু আমরা ফিরে এলাম ঢাকায়। নিরাপত্তার কারণে প্রথমে আমরা আমাদের ধানমন্ডির বাসায় গেলাম না। উঠলাম নানাবাড়ি, ৩৭ নাজিমুদ্দিন রোডে।

আমাদের ফেরার বেশ কিছুদিন পর আমাদের গ্রামে দখলদার বাহিনী ঢুকল। টাঙ্গাইলের পশ্চিম পাকিস্তানি এডিসির পরিবারকে কাদেরিয়া বাহিনী বন্দী করে আমার দাদির বাবার বাড়ি, অর্থাৎ আবু সাঈদ চৌধুরীদের বাড়িতে রেখেছিল। সেই সূত্র ধরে আমাদের গ্রামের লাগোয়া ভন্ডেশ্বরে এসে ভিড়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৌকা। আমার দাদা–দাদি, চাচি, ফুফু, বাচ্চাদেরসহ গ্রামবাসী গ্রামের পেছনে বিলে নেমে কচুরিপানার ভেতরে লুকিয়ে থাকলেন। যুদ্ধের পর গ্রামের এক চাচি ঠাট্টা করে বলতেন, ‘মিলেটারি আইসাল, আমরা দিনভর হেই বিলে। হেনুই পেচ্ছাব, হেনুই পায়খানা।’ আবু সাঈদ চৌধুরীর ফুফু হবার দায়ে দাদি ছেলেমেয়ে নিয়ে পালালেন ধানগড়া গ্রামে। চারান থেকে বড় ফুফুরা পালালেন আরও প্রত্যন্ত গ্রামে। একের পর এক পরিত্যক্ত বাড়ি পার হয়ে তাঁরা পালাচ্ছিলেন। আমার খেলার সাথি ফুফাতো বোন, নামটা নাহয় না–ই বললাম, কোনো এক জনমানবহীন বাড়ির অব্যবহৃত গ্রাম্য টয়লেটের পাটাতন ভেঙে পড়ে গিয়েছিল বিষ্ঠার পাগারে। স্মৃতি রোমন্থন করতে বসলে, তাকে সবাই কাঁদিয়ে ছাড়ত এই বলে ‘হোয় হোয়, যুদ্ধের সময় কে যেন কোথায় পড়ে গিয়েছিল?’

মুক্তিযুদ্ধের স্বাক্ষী হিসেবে রেখে দেওয়া পাক সৈন্যদের পোড়ানো কাচারি ঘরের ডোয়া। পাশর ছবিটি বলে দেয় এখানে কেমন কাচারি ঘর ছিল
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সে যা–ই হোক, পাকিস্তানি সৈন্যরা নৌকা থেকে নেমে হেঁটে ভারী অস্ত্র নিয়ে সোজা গিয়ে দক্ষিণ বাড়ি, অর্থাৎ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়িতে উপস্থিত হলো। দীর্ঘ সময় ধরে শেল মেরে মেরে আবু সাঈদ চৌধুরীর বাবা আবদুল হামিদ চৌধুরীর তৈরি বিশাল অট্টালিকাটি ভাঙার চেষ্টা করল। ভাবটা যেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার উচিত শাস্তি তারা বিচারপতি ও তাঁর গ্রামবাসীকে দিয়ে গেল। বাড়িটির ব্যাপক ক্ষতি করতে পারলেও সেটি গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি। আজও বীরদর্পে স্বাধীনতার ইতিহাস বুকে করে দাঁড়িয়ে আছে সেই অট্টালিকা। তবে দালানবাড়ির আশপাশের কাঠ আর টিনের তৈরি আমাদের প্রিয় ঘোড়াশাল, হরিণের ঘর, ময়ূরের ঘর, গোয়লঘর, কাচারিঘর, অফিসঘর—সব কিছুতে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সেই সৈন্যরা। কদিন ধরে দাউ দাউ করে জ্বলল সব। গ্রামবাসী কচুরিপানার ভেতর থেকে সৈন্যদের প্রতি তীব্র ঘৃণায় দেখল সে আগুন। যাবার সময় নিঃস্বার্থ এস্টেট ম্যানেজার সেই বিশালদেহী মুচু মিয়াকে মূল দালানের সামনে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে রেখে গেল সৈন্যরা। ভন্ডেশ্বরে মিলিটারি নেমেছে শোনামাত্র মুচু মিয়া নিজ হাতে চিঠি লিখে পাশের নয়াপারা গ্রামের হিন্দুসম্প্রদায়কে দ্রুত পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। চাইলেই তিনি নিজেও পালাতে পারতেন। কিন্তু দায়িত্ববোধ তাঁকে বিরত করেছিল বলেই শহীদ হলেন তিনি। রিমা আর কোনো দিন তাঁর সাইকেলটা চুরি করে, তাঁকে দাওয়ায় বসিয়ে রেখে কাঁচামাটির পথ ধরে ছুটতে পারেনি।

আমার একাত্তর একান্তই আমার। কখনো কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু এখন উপলব্ধি করছি, আমরা আমাদের গল্পগুলো তুলে ধরছি না বলে যুদ্ধের লিখিত অভিজ্ঞতাগুলোতে একই ধাঁচের গল্প উঠে আসছে। এর অসুবিধা হলো, আমাদের যুদ্ধের ডিসকোর্সটা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের গল্পগুলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একাত্তর সাধারণের। একাত্তর গণমানুষের। একাত্তর সবার। আমার মতো নাম না জানা এক স্কুলছাত্রীর। কচুরিপানায় লুকিয়ে থাকা আমার দাদির। প্রাণ বাজি রেখে সন্তান বাঁচানো আমার বড় ফুফুর। বিয়ের সমস্ত গয়না হারানো আমার ছোট ফুফুর। বিষ্ঠার পাগারে পড়ে যাওয়া আমার ফুফাতো বোনের। রতনগঞ্জ, বল্লা আর ভন্ডেশ্বরের তাঁতিদের। ছেলে হারানো বর্গাচাষি টংকু মাতবরের আর মুচু মিয়াদের।
একাত্তরের স্মৃতি এক অধ্যায়ে লিখে শেষ করা যায় না। আবার লিখব আমাদের যুদ্ধের না বলা গল্প।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]