এ শহর এখন আরও বেশি ধূসর

আজ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন। এ উপলক্ষে তাঁর কাব্যগ্রন্থ আমার শহর ও অনুবাদ–উপন্যাস এক নারীর জীবন নামে দুটি বই বের করছে প্রথমা প্রকাশন। শিল্পী রফিকুন নবীর অলংকরণে আমার শহর কবিতার বইয়ে আছে শহর ঢাকার এক অনবদ্য কাব্যিক বয়ান, যার পরতে পরতে রয়েছে পুরোনো এ শহরের ঐতিহ্য ও ইতিহাস। এই বইয়ের একটি ভূমিকা লিখেছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। সৈয়দ হকের এ কাব্যে যেমন আছে, তাঁর রচনায়ও আছে হারিয়ে যাওয়া সেই ঢাকার জন্য হাহাকার।
সৈয়দ শামসুল হক। প্রতিকৃতি: রফিকুন নবী
সৈয়দ শামসুল হক। প্রতিকৃতি: রফিকুন নবী

প্রায় দেড় যুগ আগে সৈয়দ শামসুল হকের দীর্ঘ কবিতা ‘আমার শহর’ পড়ে ভীষণভাবে আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। এই কবিতার লাইনে লাইনে আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবন আর ঢাকা শহরের কত বিচিত্র চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়েছে, আমার হৃদয়ের গভীরে সেসব আজও অমলিন।

এই ‘আমার শহর’ কবিতাটি স্থান পেয়েছে তাঁর রজ্জুপথে চলেছি কাব্যগ্রন্থে। সব্যসাচী প্রকাশন থেকে বের হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। প্রকাশক ছিলেন তাঁর ভাই সৈয়দ রাজা হোসাইন। সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৭ সালের ৩১ জানুয়ারি—৩৮ দিন ধরে অব্যাহতভাবে লিখেছিলেন কবিতাটি। জানি না, কতবার শব্দ আর লাইনগুলো লিখেছেন, আবার নতুন করে সাজিয়েছেন আর কতবার শব্দগুলো বদলেছেন! জিজ্ঞাসাগুলোর কোনো জবাব পাব না আর। কিন্তু আজ সেটাই সবচেয়ে বেশি করে জানতে ইচ্ছে করে। কত কিছু যে এখন মনে পড়ে! সৈয়দ শামসুল হক ‘আমার শহর’ কবিতায় ঢাকা শহরকে নিয়ে তাঁর জীবনের দুঃখ, বেদনা, ভালোবাসা ও স্বপ্নের কথাগুলো বলেছেন। সে জন্যই কবিতাটি হয়ে উঠেছে ঢাকা শহরের স্মৃতি-বিস্মৃতির এক অনন্য উদাহরণ।

২৪ পৃষ্ঠার কবিতাটি পাঁচটি ভাগে বিন্যস্ত হয়েছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বসতি নামে। প্রতি ভাগে স্তবক রয়েছে যথাক্রমে ৭, ৪, ৩, ৪ ও ৭টি। এভাবে তাঁর পুরো জীবনের একটি বৃহৎ অংশ বা সারা জীবনের কথা আর কাজগুলো প্রথম বসতি থেকে পঞ্চম বসতিতে ভাগ করে অন্তরঙ্গভাবে দারুণ সৌন্দর্যের সঙ্গে বলে গেছেন।

‘আমার শহর’ কবিতাটিতে রয়েছে সেই সময়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, তরুণ রাজনীতিকের নাম। এর পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে স্থান পেয়েছে মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ। অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুবনেতা ইমাদউল্লাহ, শিল্পী জয়নুল আবেদিন আর কামরুল হাসান, কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও লায়লা আর্জুমান্দ বানু, কবি শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহসহ ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, অভিনয়শিল্পী এবং অনেক কবি, শিল্পী ও নাট্যকর্মীর নাম। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই ছিল আমাদের জানাশোনা আর আন্তরিক সম্পর্ক।

আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ, প্রায় ৪০ বছর কেটেছে পুরান ঢাকায়। আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে সেই সব নাম, প্রতিষ্ঠান বা রাস্তার সঙ্গে, যেগুলোর কথা রয়েছে ‘আমার শহর’ কবিতায়। আমাদের বাসস্থল ছিল পুরান ঢাকার বংশালে। পড়েছি নবাবপুর গভ. হাইস্কুলে। মনে পড়ে, শৈশবে এক বিকেলে একবার মোগলটুলী হয়ে তাঁতীবাজারের ভেতর দিয়ে ইসলামপুর পর্যন্ত গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। জনৈক ব্যক্তি আমাকে বাসে উঠিয়ে দিলেন, বাস আমাকে নিশাত সিনেমা হলের কাছাকাছি নবাবপুর রোডে নামিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম।

তখন সদরঘাট আর ইসলামপুর ছিল আমাদের কেনাকাটার প্রধান জায়গা। সাঁতার শিখতে গিয়েছিলাম ওয়াইজঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গায়। ১৯৫৬ সালের এক শুক্রবার সকালে আজিজ কাকা আমাদের তিন ভাইকে লায়ন সিনেমা হলে রোমান হলিডে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলাম হেঁটে, ফিরেছিলামও হেঁটে হেঁটেই।

সেই থেকেই নায়ক গ্রেগরি পেক আর নায়িকা অড্রে হেপবার্নের ভীষণ ভক্ত আমি। পরের সপ্তাহেই গুলিস্তান সিনেমায় দেখি সুচিত্রা-উত্তমের সবার উপরে। তারপর তো নাজ, নিশাত, মুকুল আর রূপমহলে দেখেছি দেশ-বিদেশের সেরা চলচ্চিত্রগুলো।

শৈশব থেকে যৌবনের বড় এক সময় কেটেছে পুরানা পল্টনের খেলার মাঠে মাঠে। এখন সেখানে কংক্রিটের স্টেডিয়াম আর দোকানপাট। ১৯৫৯ সালে আমি নবম শ্রেণির ছাত্র, নবাবপুরের ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টে প্রথম দেখেছিলাম কবি শহীদ কাদরীকে। তারপর বহু সময় কেটেছে দৈনিক সংবাদ অফিসে।

রফিকুন নবীর আঁকা আমার শহর–এর প্রচ্ছদ
রফিকুন নবীর আঁকা আমার শহর–এর প্রচ্ছদ

কবি ও লেখক সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের বিরল, বহুমুখী ও বিস্ময়কর এক প্রতিভার নাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় ৭০ বছরের সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতির পতন-অভ্যুদয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সক্রিয় এক দর্শক তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতায়, জীবনের পরতে পরতে যা কিছু সঞ্চিত হয়েছিল, তার সবই পাওয়া যায় তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদসহ সব রচনায়।

সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ষাটের দশকের শেষের দিকে। সত্তরের দশকের শেষে সচিত্র সন্ধানীতে কিছু সময় কাজ করার সুবাদে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আশির দশকে আরও একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আমাদের ওয়ারী আর লালমাটিয়ার বাসায় এসেছিলেন একাধিকবার। কবি শামসুর রাহমান উপস্থিত ছিলেন সেসব ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। পরে কবি শামসুর রাহমান, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে শিল্পিত কাব্যময় সময় কেটেছে অনেক। মৃত্যুর আগের দুই দশকে নানা কাজ ও নানা আয়োজন উপলক্ষে কত-না কথা আর গল্প হয়েছে তাঁর সঙ্গে। যত দিন গেছে, ততই বিস্ময়কর মনে হয়েছে তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি কথা, প্রতিটি লাইনকে। অবাক হয়ে শুনেছি আর ভেবেছি, একজন ব্যক্তিমানুষ কত কিছু করতে পারেন, কত কিছু দিতে পারেন!

সৈয়দ শামসুল হক ঢাকায় আসেন ১৯৪৮ সালে। তাঁর ঢাকায় আগমন থেকে শুরু করে কবিতাটির রচনাকাল পর্যন্ত ঢাকা শহর আমূল বদলে গেছে। এখন আরও বদলে যাচ্ছে। প্রতিদিন ঢাকা শহর বদলে যাচ্ছে, বদলাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। এ শহর পরিণত হচ্ছে এক কংক্রিটের নগরীতে। চার দশকে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও সামাজিকভাবে বদলে গেছে ‘আমার শহর’—ঢাকার পুরো পরিবেশ। ‘আমার শহর’ কবিতার স্তবকে স্তবকে সৈয়দ শামসুল হকের বুকের একধরনের হাহাকার ধ্বনি শোনা যায়। এই বদলে যাওয়া তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, সবুজ ঢাকা পরিবর্তিত হয়েছে ‘ইটপাথরের জঙ্গলে’। আমরাও মানতে পারি না এই বদল। এ শহর এখন আরও বেশি ধূসর। পুরান ঢাকায় তাঁর স্মৃতির বংশাল রোড, নবাবপুর রোড, ইসলামপুর রোড, ইংলিশ রোড, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, গেন্ডারিয়া প্রভৃতি আমাদেরও বড় চেনা। কিন্তু খুব বেশি বদলে গেছে সবকিছু। এসব স্থানের স্মৃতি তাঁকে ভীষণভাবে আবেগতাড়িত করে রেখেছিল সারা জীবন। তিনি চিনতে পারেন না পরিবর্তিত এই ঢাকাকে। তাই তিনি লিখতে পারেন:

কী নাম এ শহরের? কারা বাস করে?

                                নাগরিক অধিকার কী কী?

সমস্ত নাবাল কারা কোন অধিকারে

মাটি দিয়ে ভরায়, বানায় সিটি মাল্টি স্টোরিড?

কোন সুষমায় কর্ডলেস টেলিফোনে কথা বলে?

                চাইনিজ লাঞ্চে চলে যায়?

                 এরা কারা?

সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতিময় ঢাকাকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা ‘আমার শহর’ আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে ফেলেছিল প্রথম পাঠেই। তারপর যে কতবার পড়েছি, সে হিসাব নেই।

একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং বত্রিশ নম্বর রোড—এসব বিষয় কবিতাটির পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে স্থান পেয়েছে নানামাত্রিক ঘটনার চিত্র হিসেবে। বিশেষ করে সেই সময়ের সওগাত অফিস, নানা সাহিত্য সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, মধুর ক্যানটিনের আড্ডা প্রভৃতির খণ্ড খণ্ড চিত্র ফুটে উঠেছে কবিতাটির লাইনে লাইনে। এর বাইরেও যেসব ঐতিহাসিক স্থান ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে, সেসবের সঙ্গেও আমাদের শৈশব-কৈশোর থেকে যৌবনকালের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে গভীরভাবে। সে জন্য ‘আমার শহর’ কবিতাটি অন্তরের ভেতরের বেদনামিশ্রিত স্মৃতিগুলো বড় বেশি করে ‘দিনের রৌদ্রে আবৃত বেদনার’ মতো করে রেখেছে আমাদের।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ঘটনাবলির কথা বলতে গিয়ে সৈয়দ হক যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই সেই সময়ের সেরা মানুষ। এখন তাঁরা আমাদের সেরা ঐতিহ্য। শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আমিনুল ইসলাম, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, বামপন্থী লেখক-সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, সাংবাদিক ফজলে লোহানী, আবিদ হোসেন, কবি শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, শহীদ কাদরী ও লেখক সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, ‘প্রভু’ নামে পরিচিত খালেদ চৌধুরী, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান প্রমুখের নাম এসেছে নানাভাবে; এসেছে সেই দুর্দান্ত সময়ের বর্ণাঢ্য চিত্র গুরুত্বের সঙ্গে। এভাবেই উচ্চারণ করেছেন অনেকের নাম:

মুনীর চৌধুরী নেই, ‘কবর’ রচনারত সেন্ট্রাল জেলে,

শামসুল হক নেই,

কবেই তো ইমাদউল্লা গেছে;

এই শহরে শুনি না এখন

 শেখ মুজিবের পায়ে কাবুলি চপ্পল

বাংলার বুকের গভীরে

                 শব্দ তুলে হেঁটে যাচ্ছে

                                আরমানিটোলা থেকে

                 কারকুন বাড়ির গলিতে

আবার এমন অনেকের নাম এসেছে, যাঁরা হয়তো নতুন প্রজন্মের কাছে কম পরিচিত। কিন্তু তাঁরাও পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নানা ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের উপস্থিতি ছিল গান আর নাচের জগতে, নাটকে, কবিতা–গল্প–উপন্যাস ইত্যাদিতে। সৈয়দ হকের স্মৃতি থেকে বাদ যাননি কেউই। এ দেশের চলচ্চিত্রের জনক বা প্রতিষ্ঠাতা নাজির আহমেদ, চিত্রালী পত্রিকার সম্পাদক এস এম পারভেজ, সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার গাজী শাহাবুদ্দিন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও পুঁথিপত্র প্রকাশনার কর্ণধার মোহাম্মদ সুলতান, নাট্য আন্দোলনের একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী দুই ব্যক্তি মাকসুদ সালেহীন ও বজলুল করিম—যাঁরা এই প্রজন্মের কাছে পরিচিত নন তেমনভাবে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর আর কাইয়ুম চৌধুরীর নাম এসেছে বারবার। একই সঙ্গে বিজন চৌধুরী, হামিদুর রহমান আর মোহাম্মদ কিবরিয়ার কথা এসেছে দারুণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে। সিনেমা হলগুলোর কথা বলতে গিয়ে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন ‘নাজ’ ও ‘লায়ন’–এর কথা। এ প্রসঙ্গেই এসে গেছে অভিনয়শিল্পী আভা গার্ডনার, রোমান হলিডের নায়ক গ্রেগরি পেক আর ব্রিটিশ অভিনেতা স্যার লরেন্স অলিভিয়ারের কথাও। সেসব দিনে আমরাও বিশ্বের সেরা সিনেমা ও অভিনয়শিল্পীদের দেখেছি পর্দায়।

এসব প্রিয় মানুষ, প্রিয় বিষয়, প্রিয় স্মৃতির নানা প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকায় ‘আমার শহর’ সেই সময় থেকেই আমার কাছে বড় বেশি প্রিয়। দীর্ঘদিন থেকে বইটি আমার টেবিলে আছে। অনেককেই কবিতাটি পড়ার জন্য উৎসাহিত করেছি। কতজনকে এ কবিতার বিষয়ে বলেছি, কতজনকে পড়ে শুনিয়েছি! কবিতার এই লাইনগুলো পড়ে কেমন জানি হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতরে,

বারান্দার শেষ প্রান্তে বসে না নাজিরভাই

প্রেসক্লাবে বস্তুত সে লালবাতি নেই,

                          আমি এ বাড়ি চিনি না।

রেডিওতে লায়লা আরজুমান্দ আর

শামসুর রাহমান নেই পুরনো ঢাকায়—

চিড়িয়াখানায় যেন আনীত অরণ্য থেকে কালোচিতা

               এই কবি 
                         বর্তমানে  সবটাই ফ্লাটের জঙ্গলে।

‘আমার শহর’ কবিতার পঞ্চম বসতিতে এসে সৈয়দ শামসুল হক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছেন। দেখি, তিনি অপেক্ষা করে আছেন সেই তরুণের জন্য, একজন চিত্রকর, একজন কবি, একজন নাট্যকারের জন্য, যে সৈয়দ শামসুল হকের মতোই ‘হাতুড়ি-বাটালি-ছেনি হাতে নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে’ আছে, যার হাতেই তুলে দিয়ে যেতে চান যা আছে তাঁর সবকিছুই। তাই তো তিনি অত্যন্ত সহজে বলতে পারেন:

... অবশেষে

          আমারও সময় হলো, যাবার সময়।

এখন আমার ছেনি বাটালি কলম

                          অন্য কারো হাতে দিয়ে যেতে হয়—।

এটাই কর্তব্য বটে।

 সে আছে কোথায়?

কোথায় খুঁজব আমি। সে থাকে কোথায়?

                                 কোন মহল্লায়

শহরের কোন কলোনিতে?

একবিংশ শতাব্দীর থাকে কোন অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে সে যুবক?

কী আমাকে বলে দেবে সে

                বসে কোন রেস্তোরাঁয়

কোন বইয়ের দোকানে কাটে তার সন্ধ্যা।

                                কোন মেয়ে, কী পোশাকে,

                                                জানব কীভাবে?

বহুদিন বহুবার ভেবেছি শুধু সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার শহর’ নিয়ে একটা আলাদা বই করার কথা। আর শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হবেন সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি এই কবিতার বইয়ের শিল্পকর্মের জন্য। সৈয়দ শামসুল হক আর কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন প্রায় ষাট বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভেবেছিলাম, মূল বইটির সমপরিমাণ বা আরও বেশি পৃষ্ঠাজুড়ে থাকবে পুরান ঢাকার পরিচিত মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ইলাস্ট্রেশন বা ড্রয়িং। এটা সাজিয়ে-গুছিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারলে আমাদের খুব আনন্দ হতো। একধরনের সম্মান জানাতে পারতাম যুগপৎ আমাদের দেশের দুই প্রধান শিল্পী ও সাহিত্যিককে। আগামী দিনের পাঠকদের জন্য বইটি হতে পারত তাঁদের প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য, আর এসব ঐতিহ্য হয়ে উঠতে পারত এক প্রেরণার জায়গা। বাংলাদেশের দুজন শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্যও সুন্দর সেই প্রকাশনাটি হতো অত্যন্ত আনন্দময় স্মৃতির স্মারক। আজ সৈয়দ শামসুল হক নেই, কাইয়ুম চৌধুরীও নেই। তাই এই বেদনা আমাদের রয়েই গেল।

তবু আনন্দের কথা এই যে এ সময়ের একজন সেরা চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর হাতে কাজটি সম্পন্ন হলো। আমাদের অনুরোধে অসুস্থতা সত্ত্বেও আনন্দচিত্তেই তিনি বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করে দিয়েছেন। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ। বইটি প্রকাশের ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিণী কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হক। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।