এখনো না ঘটা সত্যের কথা

মির্জা গালিব। মৃত্যু ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯
মির্জা গালিব। মৃত্যু ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯
>

বহু কাল হয়ে গেল গালিব মরে গেছে, তবু মনে পড়ে
সেই যে প্রতি কথায় সে বলত—যদি এমন হতো তবে কেমন হতো!

[মির্জা গালিবের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৭৯৭ সালে, দিল্লিতে]

মির্জা গালিবের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে দিল্লি যেতে পারলে ভালো। অষ্টাদশ শতাব্দীর দিল্লি। এই শহর কাব্যেশ্বর মীর তকি মীরেরও শহর। এই শহরের চেহারা দেখাতে গিয়ে বলেছিলেন, এর অলিগলি যেন আঁকা ছবির খাতা, এর বাসিন্দাদের চেহারা যেন তুলিতে আঁকা ছবি! সেই গলিতেই তিনি অসম প্রেমে পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন হাতে আলুথালু এক তাড়া কাগজে লেখা গজল নিয়ে। বলছেন:
প্রত্যেকটা পাতা প্রতিটা অঙ্কুর আমার হাল জানে
কেউ না জানলে সেই ফুলই শুধু জানে না, সারা বাগান তো জানে

(পাত্তা পাত্তা বুটা বুটা হাল হামারা জানে হ্যাঁয়
জানে না জানে গুল হি না জানে বাগ তো সারা জানে হ্যায়)

শীতের রাত, দিল্লির কনকনে ঠান্ডা মনে করিয়ে দেয় মধ্য এশিয়ার নির্মম শীতের চাবুকের কথা। মনে পড়তেই পারে। দিল্লি মধ্য এশিয়া আর সিল্ক রুটের একটা অংশের দুয়ার। ভারতবর্ষের সঙ্গে বাকি এশিয়ার আঙিনা। সেই মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিলেন মির্জা গালিবের পিতামহ কুকান বেগ। বাপ-দাদা যোদ্ধা ছিলেন। গালিব নিজে একবার নিন্দুকদের বলেছিলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ সব যোদ্ধা, সম্মানের জন্য তোমাদের কবি খেতাবের প্রয়োজন নেই আমার।’
আসলে গালিব নিজেকে ভাবতেন ফারসির বড় কবি। ২০ বছর বয়সের পর উর্দুতে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে আবার বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি হয়ে উর্দুতে কবিতা লেখা শুরু করেন। বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, গালিবকে নিয়ে আজও দুনিয়া মাতামাতি করে, সেই গালিব ২০ বছর বয়সের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছেন। আবার যখন বার্ধক্যে উর্দুতে কবিতা লেখা শুরু করেন আবার সেই বিশ বছর বয়সী সদ্য তরুণের মতোই কবিতা লেখা শুরু করলেন। তাও নিতান্ত অনিচ্ছায়। সেই অবহেলার কবিতা এখন জগৎ কুড়িয়ে নিয়ে রত্নের মতো বুকে আগলে রাখছে।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সময় পালটে যাচ্ছে। ইংরেজদের আসার পর সেই মোগল বৈভব অতীতের স্মৃতিমাত্র হয়ে যাচ্ছে। স্থির জগতের ধারণা যে নেই হয়ে যাচ্ছে, ভূমিভিত্তিক সম্পদ সংগ্রহের কাল পালটে বাণিজ্যের যুগ আসছে, ব্যবসার ক্ষতি-মুনাফার অনিশ্চয়তা মানুষের চিন্তার জগতে ঠাঁই নিচ্ছে ̶ এই লক্ষণ সচেতনভাবে ইংরেজদের তৈরি করা কলকাতা দেখে গালিব বুঝে ফেলেছেন। কবিতাতেও এমন সুর শোনা যাচ্ছে যা আগে কখনো শোনা যায়নি ভারতবর্ষে। সেই সুর হচ্ছে অনিশ্চয়তার সুর। রাজা-বাদশার প্রতাপের সামনে যে স্থির নিশ্চিত আর ছক বাঁধা অর্থের সুযোগ ছিল, তা পালটে গেছে। তাঁর কবিতা নিন্দিত হচ্ছে ‘অর্থহীন’ বলে। এমনটা ভারতবর্ষে আগে শোনা যায়নি। সেই ১৮৪০-এর দিকে গালিব বলছেন:
প্রশংসার বাসনা নেই প্রতিদানের পরোয়া করি না
আমার কবিতায় যদি অর্থ না থাকে, নাই থাকলো
(না সাতায়িশ কি তামান্না না সিলে কি পরওয়া
গর নেহিঁ হ্যায় মেরি আশআর মে মানি না সহি)
বহাল অর্থের যুগ আর যে নেই সেটা যারা সবার আগে বুঝেছিলেন তাঁদের অন্যতম মির্জা গালিব। উপনিষদে ব্রহ্মকে জ্ঞানী অর্থে কবি বলা হয়েছে। ফ্রয়েড বিস্ময়ভরে বলেছিলেন—কী আশ্চর্য! যেখানেই বহু কষ্ট করে যাই, দেখি আমার আগেই কোন কবি সেখানে পৌঁছে গেছেন।
চিরকাল কবিরা গালিবের আগে মুক্তো হতে চেয়েছেন। মীর বলেছিলেন:
ব্যস, চোখ থেকে মোছো তো এই অশ্রু
বোকা, এমন দামি মুক্তো কেউ ধুলোয় মেশায়?
গালিবের কাছে এসে অভ্যস্ততার প্রথা থমকে দাঁড়াল। গালিব বললেন যে তাঁর পায়ের কাছে সমুদ্র এসে ধুলোয় মাথা ঘষে। তাঁর প্রার্থনারা তীর্থে গিয়ে পবিত্র গৃহের দরজা খোলা না পেলে অপেক্ষা না করে ফিরে আসে। এমনি তাদের আত্মসম্মানের বোধ! গালিবের হৃদয়েই এমন কারও বাস, যার নাম মুখে নিলে মুখ থেকে বের হয়ে যাওয়া অভিযোগেরা ফিরে এসে ঠোঁট চুম্বন করে, বিস্ময়ে বলে—হায়! এ কার নাম উচ্চারণ করলে? তিনি প্রেমাস্পদকে ডেকে তাঁর অবস্থা দেখতে মিনতি করেন না। তিনি বরং বলেন, তোমার পেছনে আমার কী হাল জানতে চেয়ো না, বরং আমার সামনে তোমার কী ঘটে তাই দেখো!
গালিব এসে পরিমাপের মাণদণ্ড পালটে দিলেন। কাকে বলো জিতে যাওয়া? যে বৃষ্টির ফোঁটা মুক্তো হলো সেই কী জিতে গেল? গালিব তা মানতে রাজি নন। যে ফোঁটা আমার চোখের পলকে অশ্রুর সঙ্গে জড়িয়ে অশ্রু হতে পারল, বিজয় তারই। কারণ যদি দেখার চোখ না থাকে তবে মুক্তোর মূল্য কী? তাহলে মানতেই হয়, আমার চোখের জলের সঙ্গে মিশতে পারার সৌভাগ্য হলো যে জলকণার, মহাকালের পৃষ্ঠায় সেই টিকে গেল।
অনন্ত হতে সাফল্য করে স্থায়িত্বের ওপর
মুক্তো নয় অশ্রু হওয়াতেই বৃষ্টিকণার সাফল্য
(তওফিক বাআন্দাযা য়ে হিম্মত হ্যায় আযল সে
আঁখো মেঁ হ্যায় ও কাতরা জো গওহর না হুয়া থা)

মির্জা গালিব। মৃত্যু ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৯
মির্জা গালিব। মৃত্যু ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৯

কবিরা সত্যদ্রষ্টা হন। যুক্তির ক্ষমতা যদি যুক্তির স্রষ্টা মানুষের ঈশ্বর হয়ে বসে, যদি খোদ স্রষ্টার সামনে সৃষ্টি মাতবরি করে তখন কবিতা সামনে এসে বলে—আমি কবি, আমি মানুষ আর এই কবিতা হচ্ছে আমার যুক্তি সৃষ্টি করার ক্ষমতার দলিল। এই সত্যটি ইতিহাসের কায়েমি স্বার্থের গদির তলায় টাইম বোমার মতো টিকটিক করে যাচ্ছে। আইন, রাষ্ট্র, ইত্যাদি যেমন করে নিজেকে অলঙ্ঘনীয় বলে মানুষকে শাসায়, নিজেকে নিজের পক্ষে একমাত্র যুক্তি বলে সমন পাঠায়, তার সামনে সে মানুষের সার্বভৌমতার সম্ভাবনার কথা বলে যায়। যা ঘটেছে তাকে একমাত্র সত্য বলে মেনে নিলে কবিতা হয় না। কবিতা এখনো না ঘটা সম্ভাবনার বাস্তবের কথা বলে। যা হয়নি, কিন্তু যার বাস্তবতার সত্য বাসনায় রয়ে গেছে সেই কথা বলে কবিতা। মির্জা গালিব সেই কথা বলেন এমনি করে:
বহু কাল হয়ে গেল গালিব মরে গেছে, তবু মনে পড়ে
সেই যে প্রতি কথায় সে বলত—যদি এমন হতো তবে কেমন হতো!
(হুয়ি মুদাত কে গালিব মর গ্যায়া পর য়াদ আতা হ্যায়
ও হর ইক বাত পে ক্যাহনা কে য়ুঁ হোতা তো কেয়া হোতা)
যা ঘটে গেছে, যা আছে বলে বহু প্রতাপে প্রচণ্ড হুংকারে নিজেকে একমাত্র সত্য বলে, তার সামনে গালিব বলতে পারেন—যদি এমন হতো তবে কেমন হতো! এর জন্য সুখের গ্লানির কাছে যখন লজ্জায় জীবন স্খলিত হয়, তখন মির্জা গালিবের কাছে ফিরে আসতে হয়। শেষ বিচারে এই বিচ্ছিন্ন জীবিকাকে জীবন বানিয়ে ফেলা জীবনে তিনি আমাদের বন্ধু!