কাজী আনিস আহমেদ ও তাঁর লেখালেখি

বাংলাদেশে বসে ইংরেজি ভাষায় যেসব লেখক সাহিত্যচর্চা করছেন, কাজী আনিস আহমেদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আজ তাঁর ৫০তম জন্মদিন। এই লেখায় বাংলাদেশে ইংরেজিতে লেখালেখির প্রেক্ষাপটসহ প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর লেখালেখি।

মাসুক হেলালের আকাঁ প্রতিকৃতি অবলম্বনে

২০০১ সালে ‘মিনেসোটা রিভিউ’-এ কাজী আনিস আহমেদের ‘চল্লিশ কদম’ প্রথম প্রকাশিত হয়েই ব্যাপক প্রশংসা পায় এবং বিবেচিত হয় উপমহাদেশীয় গল্পকথনের এক সেরা নমুনা হিসেবে। ইন্দ্রিয়পরতা, প্রবঞ্চনা আর ছলনার এক সিরিও-কমিক কাহিনি বর্ণনা করার জন্য আহমেদ তাঁর সূক্ষ্ম শিল্পদক্ষতায় এক জাদুবাস্তবতাধর্মী আবহ সৃষ্টি করেছেন। এর পটভূমি হলো জামশেদপুর নামে একটা ছোট ঔপনিবেশিক শহর, যার নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিচয় এবং উত্থান-পতনে ভরা ইতিহাস নেই। আহমেদ শহরটার এই বৈশিষ্ট্য আলাদা করে তুলে ধরেন। বিভিন্ন সময়ে রাজধানী শহরের যেখানে স্থান অনেক বেশি সুনির্ধারিত আর কাল অনেক বেশি সংকটপূর্ণ; তার সঙ্গে প্রতিতুলনার মাধ্যমে। কাহিনির আরম্ভ আর শেষটা ধাঁধার মতো—নায়ক মারা যায় এবং মারা যায় না; সেই সঙ্গে বিপরীত বয়ানের কৌশল সময়ক্রমের মধ্যে একটা রহস্যময়তা আনে, যার ফলে কাহিনির শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রেখে একই ঘটনার একাধিক সমান্তরাল ভাষ্যের আবির্ভাব ঘটানো সম্ভব হয়। জামশেদপুরের লোকদের বলা বেশির ভাগ কাহিনির মতোই যেগুলোর দুটো করে আলাদা ভাষ্য থাকে আর তাদের সৃষ্টি হয় মুখে মুখে এবং ‘চিমনির ধোঁয়া’য় ‘চল্লিশ কদম’-এরও দুটো সমান্তরাল অথচ পৃথক প্লট আছে। একটিতে আছে মূল কাহিনিটি, যার সূচনা হয় একটা কবরস্থানে আর তা নানা ঘটনার পর শেষ হয় সেই কবরস্থানেই; অন্যটি ধারণ করে আছে নায়ক শিকদারের স্ত্রী নূরজাহান আর তার ইংরেজ প্রেমিক ডসনের গোপন জীবনের ইতিবৃত্ত, যার শুরুটা গতানুগতিক হলেও যেকোনো বিয়োগান্ত প্রেমকাহিনির মতোই গতি উত্থান-পতনময়।

কাহিনির শেষে যে আমরা দেখি শিকদার একই সঙ্গে মৃত এবং জীবিত, এই ব্যাপার অনিবার্যের অস্তিত্বকে ঘোষণা করায় এবং একই সঙ্গে তাকে অস্বীকার করায় কাহিনির ক্ষমতাকে তুলে ধরে। আর সন্দেহ নেই যে এই ক্ষমতা আহমেদ নিয়েছেন গল্পকথনের লোকজ ঐতিহ্য থেকে।

কাজী আনিস আহমেদ

আহমেদের কাহিনি এমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রেণির অন্তর্গত, যেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয় এবং বজায় রাখা হয় একেবারে শুরু থেকে শেষ অবধি এবং যেখানে লেখক সাধারণ ও অদ্ভুতের সমন্বয় ঘটান সমান সহজতায়। কাহিনিও এমন এক এলাকার মধ্য দিয়ে নিজের পথ বুনে এগিয়ে চলে, যা একই সঙ্গে চেনা ও অদ্ভুতভাবে অচেনা।

এই সুনির্মিত কাহিনির কেন্দ্রটি ভর করে আছে একটি বাস্তবধর্মী কাঠামোকে, যদিও এর মধ্যে আছে এক শান্ত-অলস আঙিনায় জন্মানো গল্পের বৈশিষ্ট্যাবলি; গল্পটির কথক এক বৃদ্ধ গ্রামবাসী, যে গ্রামে কল্পনা আর বাস্তবতার সীমানা অবলুপ্ত। কিন্তু লোকগল্পের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়, স্থান-কাল থেকে শুরু করে সবকিছু থেকে যায় অনির্দিষ্ট এবং যতটা নিশ্চিত তার থেকে অনেক বেশি অনুমাননির্ভর এবং লোকগল্পের মতোই ‘চল্লিশ কদম’ তার সম্মোহনী ক্ষমতায় দেহজ আবেদন, রোমাঞ্চ ও অধিবাস্তব কৌতুকরস জাগিয়ে তোলে।

কিন্তু ‘চল্লিশ কদম’ কেন অনন্য এবং কীভাবে এর সুদক্ষ নির্মাণ একে গোগ্রাসে পড়ে ফেলার মতো একটি গল্প করে তুলেছে, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে এটিকে বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষায় কথাশিল্প রচনার পটভূমিতে স্থাপন করে বিচার করা জরুরি। দৃশ্যত বাংলাদেশের ইংরেজি কথাশিল্প পরিপক্ব হয়ে উঠেছে মাত্র কয়েক বছর হলো। এর সূচনাটা ছিল অনিশ্চিত এবং খানিকটা নড়বড়ে, যেন লেখকদের কোনো ধারণাই ছিল না দেশের ভেতরে ও বাইরে তাঁদের পাঠক কারা এবং তাঁরা কীভাবে তাঁদের গ্রহণ করবেন। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলেছেন, যদি ‘ভাষা রাজধানী’ বলে কোনো জিনিস না থাকে, যেখানে এমন পাঠকেরা থাকবেন, যাঁদের থাকবে নির্দিষ্ট একটা ভাষা ব্যবহারের সামর্থ্য, তাহলে সেখানে বইয়ের কোনো বাজার থাকবে না এবং সে কারণে প্রকাশকেরা কোনো সৃজনশীল উদ্যোগকে সমর্থন দিতে এগিয়ে আসবেন না। এভাবে বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার লেখকেরা নিজেদের আবিষ্কার করলেন এক সমাধান-অযোগ্য দুষ্টু চক্রের মধ্যে: বই ছাপা হলেও ব্যবসা করার মতো যথেষ্টসংখ্যক বই বিক্রি হলো না। আর এখানে কোনো ‘ভাষা রাজধানী’র অস্তিত্ব না থাকায় কোনো বাজারও তৈরি হলো না। তবে ১৯৯০ সালের শেষের দিকে অনেক বাংলাদেশি এ দেশে ইংরেজি ভাষায় সৃজনশীল সাহিত্যকর্মকে সমর্থন দিতে এগিয়ে আসায় এ অবস্থা থেকে বেরোনোর একটা উপায় দেখা গেল। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রী, দেশি জিনিসপত্রে নতুন করে আগ্রহী হয়ে ওঠা প্রবাসীরা, নতুন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের বিস্তার এবং সর্বোপরি এ দেশে সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাটাকে ব্যবহারে সক্ষম একদল লেখকের আবির্ভাব এই ঘুরে দাঁড়ানোতে ভূমিকা রেখেছে। এসবের সঙ্গে বলতে হয় ‘দ্য ডেইলি স্টার’ ও ‘দ্য নিউ এজ’-এর মতো দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা এবং ‘সিক্স সিজনস রিভিউ’-এর মতো মূলধারার বাইরের সাহিত্য পত্রিকাগুলোর ভূমিকার কথা, যা আত্মপ্রকাশোন্মুখ লেখকদের জন্য একটা জমি তৈরি করে দিয়েছে আর এই জমিকে ব্যবহার করেই তাঁরা বাধা ঠেলে এগিয়েছেন। তারপর ২০১০-এ ওয়েলসভিত্তিক হে ফেস্টিভ্যাল ঢাকায় এল এবং স্থানীয় ইংরেজি ভাষার প্রকাশকদের বিশ্ববাজারে যাওয়ার মতো ভীষণ দরকারি শক্তিটি জোগান দিল। ২০১২-তে ‘বেঙ্গল লাইটস’ নামে উঁচু শ্রেণির সাহিত্য পত্রিকাটির উদ্বোধন, যে পত্রিকা বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক লেখকদের একই মলাটের ভেতর একত্র করছে এবং বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ডেইলি স্টার বুকস ও বেঙ্গল লাইট বুকসের আবির্ভাব এ দেশে ইংরেজি ভাষার প্রকাশনায় উল্লেখযোগ্য গতি সঞ্চার করেছে। এর ফলে আশ্চর্যজনক সংখ্যায় তরুণ প্রতিভা আবির্ভূত হয়েছে, যাদের অনেকেই অবধারিতভাবেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তাদের সামর্থ্যের চিহ্ন রাখবে।

কাজী আনিস আহমেদ এই নতুন প্রজন্মের লেখকদের একজন, যাঁরা বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার সাহিত্যকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। একই সঙ্গে তিনি সেই গুটিকয় লেখকের একজন, যাঁরা তাঁদের প্রতিভার প্রথম চিহ্ন এঁকেছেন দেশের বাইরে; তাঁর ক্ষেত্রে দেশটা যুক্তরাষ্ট্র আর তারপর সন্ধান করেছেন বাংলাদেশি পাঠকের। এই শেষোক্ত কাজটা তাঁর জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল ‘চল্লিশ কদম’ ছাপা হওয়ার পর তিনি যে প্রশংসা পেয়েছিলেন তার বদৌলতে। আহমেদ যত দিনে তাঁর দ্বিতীয় কাজে হাত দিয়েছেন, সেটা হলো নয়টি ছোটগল্পের একটা সংকলন, ধাঁধার মতো যার নাম রাখা হয়েছে ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (২০১২), যা এই প্রায় অচল ঢাকা মহানগরের পটভূমিতে সফলতা ও ব্যর্থতা, ভালোবাসা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তবতা উন্মোচন করেছে। তত দিনে তিনি দেশে ও দেশের বাইরের সাহিত্যাঙ্গনের এক পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রকাশিত ‘গুডনাইট’ আমাজন ডটকমে বিক্রি হচ্ছে এবং পাঠকের কাছ থেকে নিয়মিত পাঁচ তারকা ‘রেটিং’ পেয়ে আসছে। এই বইয়ের পরপরই তিনি প্রকাশ করলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’, তাঁর প্রথম উপন্যাস, প্রকাশ করেছে র‌্যানডম হাউস ইন্ডিয়া, ২০১৩ সালে। এই রাজনৈতিক ‘স্যাটায়ার’ ২০০৬ সালে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরবর্তী ঘটনাবলি ফিরে দেখেছে। এই অনির্বাচিত সরকার ঝানু রাজনীতিকদের জন্যও রাজনীতি করা কঠিন করে তুলেছিল, কিন্তু এমন লোকজনের সঙ্গে একটা আঁতাত গড়ে তুলেছিল; যারা মনের গভীরে লালন করতেন ক্ষমতার লোভ। কিন্তু তাদের কোনো রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি ছিল না। ফলাফল, আহমেদ যেমনটা তাঁর নির্মম ব্যঙ্গ আর গভীর জিনিসকে তরল কৌতুকের মাধ্যমে প্রকাশের রীতিতে দেখিয়েছেন, হয়েছিল এক সর্বব্যাপী অবনমন, যা থেকে আমাদের সুশীল সমাজের গুটিকয় সদস্যই মুক্ত।

আহমেদের প্রতিভার বিশেষত্ব হলো, এক মহৎ গল্পকথকের সূক্ষ্ম শিল্পদক্ষতা দিয়ে তিনি দৈনন্দিনতাকে রূপ দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। নিছক সাধারণ একটা দিনে নিতান্ত সাধারণ লোকজনই তাঁকে সূক্ষ্ম ও পরিশীলিত সাহিত্যিক আখ্যান নির্মাণের জন্য যথেষ্ট মালমসলা জোগান দিতে পারে। তাঁর চরিত্রেরা পাঠকের সহানুভূতি আদায় করে নেয়। কারণ, তাদের মোটেই আগন্তুক মনে হয় না তাদের কাছে এবং কাহিনিতে, এমনকি তারা যখন নিজেদের মনের দুনিয়ার অতল জটিলতার মধ্যে বাস করে, তখনো। আহমেদের অনেক বর্ণনার মধ্যে একটা নজরকাড়া দৃশ্যময়তা রয়েছে, যা দেয় একটা বর্ণময়তার অনুভূতি; মনে হয় জীবন কাটছে অনেক মানুষজন আর জিনিসপত্রের মধ্যে।

আহমেদের আকর্ষণীয় রচনাশৈলী, কাহিনির বাস্তবধর্মী কাঠামোর মধ্যে জাদুময়তাকে জায়গা দেওয়ার ক্ষমতা, ক্ষমতাশালী ভাষা, চরিত্র সৃষ্টি এবং তাদের ইতিহাস, ভূগোল ও সমসাময়িক রাজনীতির বিচিত্র দৃশ্যে চালনা করার সহজ দক্ষতা, লোকগল্পের ঐতিহ্যকে নতুন করে ব্যবহার করা, কাহিনি বয়ানের সমান্তরাল কিংবা পরস্পরবিরোধী সম্ভাবনাগুলোকে পাশাপাশি রাখার প্রবণতা—এসব কিছুকে আশ্চর্যজনকভাবে কাহিনির শেষের দিকে এসে ভারসাম্যে স্থিত করা হয়েছে। আর কাহিনিতে উত্তেজনা সৃষ্টি ও তার প্রশমন নিয়ে তাঁর ক্লান্তিহীন খেলা আহমেদকে গল্পকথক হিসেবে অনন্য করে তুলেছে। ‘চল্লিশ কদম’-এ জামশেদপুরের একটা পুরোনো দিনের আবহ রয়েছে, যাকে গাঢ় বাদামি রঙেই সবচেয়ে ভালোভাবে কল্পনা করা যায়। অন্যদিকে ‘গুডনাইট’ দেখায় প্রকট দাঁতাল সাদাকালো একটা দুনিয়া, যেখানে সামাজিক রীতিনীতি আর মূল্যবোধগুলো প্রায়ই লঙ্ঘন করা হয়। ‘চল্লিশ কদম’-এ নূরজাহান ও ডসন সমাজের আইনকানুন না মেনে মিলিত হলেও তাদের রেহাই দেওয়া হয়, তবে সেটা বাকি জীবনের নীরবতার সাজা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার আগে নয়। ‘গুডনাইট’-এ অসুরেরই রাজত্ব।

‘চল্লিশ কদম’-এর প্রচ্ছদ

আহমেদের প্রতিভার বিশেষত্ব হলো, এক মহৎ গল্পকথকের সূক্ষ্ম শিল্পদক্ষতা দিয়ে তিনি দৈনন্দিনতাকে রূপ দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। নিছক সাধারণ একটা দিনে নিতান্ত সাধারণ লোকজনই তাঁকে সূক্ষ্ম ও পরিশীলিত সাহিত্যিক আখ্যান নির্মাণের জন্য যথেষ্ট মালমসলা জোগান দিতে পারে। তাঁর চরিত্রেরা পাঠকের সহানুভূতি আদায় করে নেয়।

কারণ, তাদের মোটেই আগন্তুক মনে হয় না তাদের কাছে এবং কাহিনিতে, এমনকি তারা যখন নিজেদের মনের দুনিয়ার অতল জটিলতার মধ্যে বাস করে, তখনো।

আহমেদের অনেক বর্ণনার মধ্যে একটা নজরকাড়া দৃশ্যময়তা রয়েছে, যা দেয় একটা বর্ণময়তার অনুভূতি; মনে হয় জীবন কাটছে অনেক মানুষজন আর জিনিসপত্রের মধ্যে। আবার দৈনন্দিনতার প্রসঙ্গ, তবে এবার একটু তির্যকভাবে। এর সঙ্গে যোগ করুন তাঁর নিয়ন্ত্রিত রসবোধ আর ‘অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুতা’কে দেখানোর পরিহাসপ্রবণ ভঙ্গি। এসব কারণে তাঁর বয়ান হয়ে ওঠে নিবিড় ও আনন্দময়। একই সঙ্গে আছে এক বিষাদের অনুভূতি, যেন শিকদারের কাহিনিতে তা ধুলার মতো লেগে থাকে।

‘চল্লিশ কদম’ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন কলকাতাবাসী খ্যাতিমান বাঙালি পণ্ডিত ও অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। লাতিন আমেরিকান লেখকদের রচনা বাংলায় পরিবেশনের মতো আরও যন্ত্রণাদায়ক কাজটিও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন; যা বিভিন্ন সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভাষার মধ্যবর্তী স্থানে তাঁর নিজেকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার সামর্থ্যের সাক্ষ্য দেয় এবং প্রতিস্থাপন ও স্থানান্তরের মধ্যে, অর্থোদ্ধার ও ব্যাখ্যানের মধ্যে, সমার্থকতা ও রূপান্তরের মধ্যে একটা মধ্যবর্তী পথ অনুসন্ধানে তাঁর সক্ষমতা প্রমাণ করে। ‘চল্লিশ কদম’-এর পটভূমি, চরিত্রগুলো, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহ, এর সংকেত ও সূত্রগুলো, এতে ব্যবহৃত ভাষার রূপ—সবকিছুই একটা দেশি প্রেক্ষাপটে সংলগ্ন। তাই এতে অনুবাদের সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম, শুধু প্রয়োজন গল্পটা বাংলায় নতুন করে বলা। তবু দুর্বলতর অনুবাদকের হাতে এই কাহিনির আনন্দময়তা আর বিষাদ হারিয়ে যেত, সেই সঙ্গে এর সূক্ষ্ম ভাষাগত বাঁকগুলো আর চরিত্রগুলোর কণ্ঠের কৌতুক ও স্বরভঙ্গি। বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদকে প্রাণময়তা দিয়েছে মূল রচনার মেজাজটা ধরতে পারায় তাঁর সফলতা, গল্পের জীবন্ত কাঠামো এবং কাহিনির ছন্দ ও চলন। অনুবাদে তিনি একটা কার্যকারিতার ধারণা ধরে এগিয়েছেন, যা তাঁকে গল্পটির অনূদিত সংস্করণটির নির্মাণপ্রক্রিয়ার একজন অংশী করে তুলেছে।

কখনো কখনো তিনি ভাষার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন, ব্যবহার করেছেন এমন সব শব্দ ও পরিভাষা, যা সাধারণত পুরোনো আমলের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মুসলমানরাই ব্যবহার করতেন। বলা বাহুল্য, এখন সেগুলো বাংলাদেশের কোনো লেখক আর ব্যবহার করেন না। এই একটি সমস্যা ছাড়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ সুপাঠ্য ও সুসংগত।

‘চল্লিশ কদম’ সুদীর্ঘ একটা গল্প। তবে এর লেখকের গল্পকথনের ক্ষমতা পাঠকের মনোযোগ শেষ অবদি ধরে রাখে। বলা হয়ে থাকে যে ছোটগল্প একই সঙ্গে বর্ণনা ও অভিনয়ের জিনিস। কাজী আনিস আহমেদ সন্দেহাতীতভাবে একজন অভিনেতার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, যে অভিনেতার বর্ণনা একই সঙ্গে মানুষ ও স্থানকে, বাস্তব ও জাদুময়তাকে এবং তুচ্ছ ও মহানকে জীবন দান করে। আমি নিশ্চিত, ‘চল্লিশ কদম’ পড়ার অভিজ্ঞতা পাঠকের সন্তুষ্টি উৎপাদন করবে।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]