জনসংস্কৃতিতে নজরুল কেন জনপ্রিয়

১১ জ্যৈষ্ঠ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। আমাদের জনসমাজে নজরুল কেন জনপ্রিয়? বিদ্রোহী কবির জয়ন্তীর ক্ষণে এ লেখায় রয়েছে তার সুলুকসন্ধান।

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩)
প্রতিকৃতি: শিশির ভট্টাচার্য্য

১৯৩৬ সালের কথা। ত্রিশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধের নাম ‘সূর্যাবর্ত’। সেই প্রবন্ধে বেশ একটু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ একটা বড় কথা বলে বসেন। কথাটা তিনি বলেন বাঙালি জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাব্য-কবিতার গভীর সম্পর্ক বিষয়ে। সুধীন বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ হাল আমলের সিদ্ধিদাতা গণেশ। তিনি তো আমাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের সূত্রধার বটেই, এমনকি তাঁর বাণী-ব্যতিরেকে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও লাভ নেই।’ ‘আমাদের’ বলতে সুধীন দত্ত বাঙালিদের বুঝিয়েছেন। সুধীন্দ্রনাথ ভুল কিছু বলেননি। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির বিচিত্র উৎসব-অনুষ্ঠানের উদ্​গাতা। বিচিত্র উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কাব্য-কবিতা রচনা করেছেন তিনি। প্রত্যক্ষ উদাহরণ দিতে গেলে বলতেই হয়, বর্ষা, বসন্ত, নববর্ষ এলে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা ছাড়া আজও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির চলেই না।

বাঙালি জীবনে এমন আরেক কবি আছেন—কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর গান-কবিতা ছাড়াও বাঙালির রাজপথ থেকে শুরু করে উৎসবাদি পর্যন্ত যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। প্রেমিকের আর্তিটা যেন অপ্রকাশিতই রয়ে যায়। শিশুর শৈশবজুড়ে থাকে তাঁর ছড়ার সৌরভ। তাই-ই হওয়ার কথা। বড় কবি সবার অজান্তেই ঢুকে পড়েন তাঁর জনসংস্কৃতি এবং জনগোষ্ঠীর যাপনের পরতে পরতে। নজরুলের ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে; দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে বাঙালির নজরুলকে লাগেই লাগে। কিন্তু বাঙালির জীবনের সঙ্গে নজরুলের কাব্য-কবিতার গভীর সম্পর্ক বিষয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো এমন একটা বলিহারি সর্বব্যাপী কথা কেউ কি উচ্চারণ করেছেন? মনে হয় না। শুধু চুপচাপ ভোক্তা হয়েই রইলেন সবাই। এর কারণ অনুসন্ধান করা দরকার।

১৯২৯ সালে নজরুলের বয়স মাত্র ত্রিশ বছর। ওই বছর জাতির পক্ষ থেকে কলকাতার আলবার্ট হলে—বর্তমান কফি হাউস—তাঁকে জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নজরুলকে ‘বাংলার কবি, বাঙালি কবি’ বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, ওই সময়ের বাঙালির আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছিল নজরুলের কবিতায়। তাঁর কবিতা বাঙালির জড় জীবনে গতি এনেছিল। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল বাঙালিকে রাজপথে নামিয়ে এনেছিল। প্রেমেন্দ্র মিত্র জানিয়েছেন, ‘ঘরে বাইরে, মাঠে-ঘাটে, রাজপথে, সভায় এ কবিতা (বিদ্রোহী) নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শত শত পাঠক পড়েছে।’ ১৯২৯ সালের ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি সেদিন নজরুলের গান-কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনো তাঁর গান গাইব।’ আদতে হয়েছেও তা–ই। অন্যায্যভাবে কেউ কারান্তরীণ হলে এখনো বাংলার মানুষ গায় ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট ভেঙে ফেল্​ কর্​রে লোপাট’। নজরুলের এই গান ছাড়া প্রতিবাদ করে শান্তি পায় না বাঙালি। আবার যুদ্ধের সাজে বাঙালি গায় ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’। নজরুলের এই গান ছাড়া আমাদের প্যারেড গ্রাউন্ড কি প্রাণ পায়? কলকাতার কথা জানি না, কিন্তু বাংলাদেশে নজরুল এভাবেই আগেও ব্যবহৃত হয়েছেন এবং এখনো হয়ে চলেছেন। নজরুলের এই সব গান-কবিতার সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মেরও রয়েছে গভীর সম্পর্ক।

এ তো গেল সংগ্রাম-সমর-রাজপথের কথা। নজরুলের গান ছাড়া বাঙালি মুসলমানের ঈদের আনন্দও তো যথার্থ হয় না। বাঙালি মুসলমান শত শত বছর ধরে ঈদ উদ্​যাপন করে এসেছে। কিন্তু ঈদ নিয়ে সাহিত্য রচনা করার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বিশ শতক পর্যন্ত। বিশ শতকে যখন ক্রমে মধ্যবিত্তের বিকাশ হচ্ছিল, তখন সে তার নিজের দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে। তার প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ নিয়ে শুরু হয় সাহিত্য রচনা। কিন্তু শুরুর দিকের ঈদবিষয়ক কাব্য-কবিতা যতটা ধর্ম হিসেবে রূপায়িত হয়েছে, ততটা ঠিক সাহিত্য নয়। আনন্দের প্রকাশ তো নয়ই। নজরুলই প্রথম ঈদকে আনন্দের সঙ্গে যুক্ত করেন। লেখেন বেশ কিছু কবিতা ও গান। শেষে দেখা গেল, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ গানটি বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্​যাপনের সঙ্গে অনিবার্য হয়ে উঠল। গানটি ঈদের আনন্দ আর তাৎপর্যকে দারুণভাবে শনাক্ত করে প্রতি ঈদে বাঙালি মুসলমানের মনে একটা হুল্লোড় তোলে। একটি জাতির বড় কবির অনেক সংজ্ঞা থাকতে পারে। তবে যে কবিকে তাঁর জনগোষ্ঠী ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, এড়াতে পারে না, তিনি নিশ্চয়ই ওই জনগোষ্ঠীর মর্মের সহচর, বড় কবি।

১৯২৭ সালের দিকে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’–এর প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এসে তিনি শিখা গোষ্ঠীর সভ্যদের দেখেশুনে রসিকতা করে বলেছিলেন, আমি ভাবলাম আমি একাই বোধ করি কাফের। কিন্তু এখানে এসে খুশি হলাম যে আমার মতো আরও অনেক কাফের-মুরতাদ আছে। নজরুল তাঁর সমকালে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিন্দার শিকার হয়েছিলেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে। বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা অংশ তাঁকে ‘কাফের’ বলে সাব্যস্ত করেন। কিন্তু এই নজরুলের গান-কবিতায় ভর করে বাঙালি মুসলমান খোদা ও রাসুল প্রেমে মশগুল হয়। তাঁর ইসলামি গানের ভাষার ডানায় ভর করে নিজের আকুতিকে মুক্তি দেয়। নজরুলের নাতে রাসুল ছাড়া বাঙালি মুসলমানের মিলাদ-মাহফিল যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/ মধু পূর্ণিমার সেথা চাঁদ দোলে’ অথবা ‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে/ তাই কিরে তোর কণ্ঠেরই গান এমন মধুর লাগে’।

শুধু মুসলমানের ধর্মানুভূতির কথাই বা বলি কেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মানুভূতির অনুবাদ নজরুলের অসামান্য সব শ্যামাসংগীত, ভজন-কীর্তন। ‘সখি সে হরি কেমন বল’ বা ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ ইত্যাদি ভজন-কীর্তন শ্রেণির গান সাধারণ হিন্দুরও ধর্মানুভূতিকে বহুকাল ধরে তৃপ্ত করে আসছে। রাধাকৃষ্ণ, শিবঠাকুর, কালী, শ্রীচৈতন্যদেব ইত্যাদি–সম্পর্কিত ভক্তিমূলক অসংখ্য গান বাঙালি হিন্দুর কীর্তন-ভজনের পিপাসা মিটিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

নজরুলের জীবন ঘাঁটলে দেখা যায়, যাকে ভদ্র ভাষায় সুন্দর শৈশব বলে, তা তাঁর ছিল না। তাঁর শৈশব-কৈশোর আসলে অন্নসংস্থানের নিরন্তর সংগ্রামে কাটানো সময়। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য বৃত্তির পর বৃত্তি পরিবর্তন করতে দেখি আমরা তাঁর শৈশব ও কৈশোরে। কিন্তু তাঁর ছড়া আর রঙিন গান ছাড়া বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের শৈশব-কৈশোর কল্পনা করা যায় না। ‘বাবুদের তাল-পুকুরে’ অথবা ‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমনি ওঠো রে’ কিংবা ‘প্রজাপতি, প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা’—এসব ছড়া-গান বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শিশু-কিশোরদের কল্পনা ও আনন্দের এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। আর শিশুদের নৃত্যের জড়তা ভাঙার প্রথম ধাপের গান ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ গানটির কথা নাহয় না-ই বললাম।

প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, নজরুলের কাব্য-কবিতা কি জনসংস্কৃতির সব স্তরে সমানভাবে ব্যবহৃত হয়? বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটা অংশ লালন বা হাসন রাজার ভোক্তা। ওই জনগোষ্ঠী তাদের কাজে এবং ভাবানন্দ প্রকাশে লালন-হাসন-করিম-জালালে ভর করে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যে সাহিত্য ও সাহিত্যরুচিকে ‘মূলধারা’ বলে দাবি করে, তা এখানে প্রায় অচল পয়সার মতো। কারণ এই ‘মূলধারা’র কাব্য-কবিতার একটা শ্রেণিচরিত্র খুঁজে পাওয়া খুবই সম্ভব। নজরুলের সাহিত্যের একটা অংশ ওই ‘মূলধারা’র সাহিত্য বলেই গণ্য হবে, যার ভোক্তা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কিন্তু আবার নজরুলসাহিত্যের একটা বড় অংশের মধ্যে এমন সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার বদৌলতে প্রায়ই তিনি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গণ্ডি বেশ খানিকটা পার হয়ে যান। নজরুল আক্রান্ত করে উঠতে চান বিশাল জনসমাজকে। চিরবিদ্রোহী এই কবি যেখানে শোষণ-বঞ্চনা-আধিপত্য-সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার কথা বলেন, সেখানে তিনি ওই শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অচলায়তন থেকে বেরিয়ে যান। আবার যখন বহু মানুষের ধর্মানুভূতির অনুবাদ করেন, তখনো তিনি টপকে যেতে চান বিত্তের দেয়াল। টপকে যেতে চান না, অনেক ক্ষেত্রে টপকে যানও। নজরুলের আগের এবং সমসাময়িক ‘মূলধারা’র অধিকাংশ কবি–লেখক যেখানে রুচি আর প্রকাশরীতির কারণে আটকে যান, নজরুল সেখানে ভেদ করতে চান।

কীভাবে নজরুল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ফাঁক গলে চুঁইয়ে পড়েন নিচের দিকে? এর সঙ্গে কি তাঁর কালের ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক আছে? সম্ভবত আছে। মনে রাখতে হবে, নজরুলের বেড়ে ওঠা এমন একটা সময়ে, যখন বাঙালিরা ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছে। কলকাতায় নজরুলের আবির্ভাবই ঘটেছে অসহযোগ আন্দোলন আর খেলাফত আন্দোলনের মতো দুটি ফুটন্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে। এই কবির সঙ্গে তাঁর কালের অন্যদের পার্থক্য হচ্ছে, নজরুল ওই উপনিবেশবিরোধিতাকে নিজের কবিতার একটা বড় অংশের কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, বাংলা সাহিত্য তখন পরোক্ষতাবাদ থেকে মুক্ত হয়ে প্রবেশ করছিল প্রত্যক্ষতাবাদের দিকে। নজরুল তাঁর কবিতার ভাষা থেকে শুরু করে বোধ-বোধির প্রশ্নে ওই প্রত্যক্ষতাবাদের উপাসক ছিলেন। এই প্রত্যক্ষতাবাদী চেতনা আর উপনিবেশবিরোধিতা তাঁকে বোধ হয় তুলনামূলকভাবে বেশি বাস্তবনিষ্ঠ ও জনঘনিষ্ঠ করেছে।

একজন কবি তাঁর জনগোষ্ঠীর মধ্যে কতটা আদরনীয় ও ব্যবহৃত হবেন, তা নির্ভর করে তিনি ওই জনগোষ্ঠীর চেতনার কতটা অনুবাদ করতে পেরেছেন, তার ওপর। নজরুল বাঙালির চেতনাকে অনেক দূর পর্যন্ত ভাষা দিতে পেরেছিলেন। এজন্যই তাঁকে বড় কবি মনে করে বাঙালিরা। এ কারণেই আমাদের বিপদে-সম্পদে, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, উৎসবে-উদ্​যাপনে, সংগ্রামে-মিলনে নজরুলের কাব্য-কবিতা ব্যবহৃত হচ্ছে এবং আরও বহুকাল হবে বলে মনে হয়।