‘জান’ ও ‘জবান’ প্রসঙ্গে

কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেওয়া এক স্লোগানে ‘জান’ ও ‘জবান’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা ভাষায় চালু আরবি-ফারসি উৎসজাত এ দুই শব্দের ব্যবহারে অনেকে আপত্তি করেছেন। সংস্কৃত উৎসের চালু বিকল্প থাকতে এ ধরনের শব্দ বাছাই করাকে তাঁরা প্রভাবশালী সংস্কৃতির নিগ্রহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। বিপরীতে অন্য অনেকেই বলেছেন, এ দুই চালু শব্দ সম্পর্কে আপত্তি যৌক্তিক তো নয়ই, এমনকি ভাষাসম্মতও নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকে প্রকাশিত বেশ কিছু মন্তব্যের ভিত্তিতে এ লেখা। এখানে এ বিষয়ে ‘সত্য-মিথ্যা’র কোনো মীমাংসা করা হয়নি। বরং প্রকাশিত মত ও মন্তব্যে বিশেষভাবে উচ্চকিত কয়েকটি ভাষিক-ঐতিহাসিক দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, যেগুলো বাদ দিয়ে এ ধরনের আলাপের হয়তো বুদ্ধিবৃত্তিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক কোনো ভিত্তি দাঁড়ায় না।

এক. এ আলাপটা আদতে বেশ পুরোনো এবং মুখ্যত ‘বিদেশি’ ভাষার আলাপ। দশ ক্লাস পর্যন্ত যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের সবারই মনে থাকার কথা, বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে ‘শব্দের উৎসগত শ্রেণিবিভাগ’ বলে এক চিজ থাকে। এটাও ভুলে যাওয়ার কারণ নেই, ইংরেজি ব্যাকরণে এ ধরনের কোনো বাতচিত থাকে না। পেছন ফিরে স্মৃতিচারণা করলেই মনে করতে পারার কথা, বাংলা ব্যাকরণটা সাজানো হয়েছে এই ‘বিদেশি’ আর ‘অবিদেশি’ ক্যাটাগরি বা বর্গকে ভিত্তি করে। এর পেছনে রাজনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বিস্তর আছে। সেদিকে না গিয়ে বলি, ‘বিদেশি’ শব্দ বলে ভাষায় আসলে কিছু থাকে না। এটা ভাষাবিজ্ঞানের খুবই প্রাথমিক আলাপ। ‘বোতল’ শব্দটা বিদেশি নয়; কারণ, দুনিয়ার অন্য কোনো ভাষায় এ রূপতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্বে ব্যাখ্যাযোগ্য কোনো শব্দ নেই। ইংরেজিতে যে ‘বোতল’ বলে কোনো শব্দ নেই, তা আপনারা সবাই–ই জানেন। তার মানেই হলো, ইংরেজি শব্দটা হয়তো ইংরেজি থেকে সরাসরি, অথবা অন্য কোনো ভাষার মধ্যস্থতায়, বাংলায় ঢোকার সময়েই বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব মোতাবেক বদলে গেছে।

নানা ঐতিহাসিক কারণে আমাদের ব্যাকরণবীরেরা এ সরল কথাটা আমল করতে পারেননি। শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকেই এ বিষয়ে কার্যকরভাবে আলোকপাত করার পরেও বাংলা ব্যাকরণে এ ধরনের অযৌক্তিক বিভাজন থেকেই গেছে। ফলে আমাদের মনস্তত্ত্বে ভাষার এ আলাপটা ‘বিদেশি’ শব্দের আলাপ হিসেবেই আবির্ভূত হয়। কাজেই যাঁরা ‘বিদেশি’ ক্যাটাগরিতে আলাপটা করেছেন—পক্ষে থেকে বা বিপক্ষে গিয়ে—বাংলা হয়ে গেছে বা হয়নি ইত্যাদি বলে, তাঁরা জেনে বা না জেনে ইতিমধ্যে সাম্প্রদায়িকতার খপ্পরে থাকা ব্যাকরণের খপ্পরে পড়েছেন।

এখানে বলে রাখি, ‘বিদেশি’ কথাটা শুধু বাংলা ব্যাকরণের না, এ অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অন্য অনেক শাস্ত্রেরও ঘোষিত বা অঘোষিত ভিত্তিভূমি। কাজেই সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ইত্যাদি চর্চায় আপনি এ গোলমাল এড়াতে চাইলে ‘সাধু’ সাজলেই কেবল হবে না, এই সাম্প্রদায়িক ‘বিদেশি’ ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে।

দুই. এ আলাপে ‘আরবি’ ও ‘ফারসি’ শব্দ দুটো দেদার ব্যবহৃত হয়েছে। এ ব্যবহারের গলদ শনাক্ত করা খুব সহজ নয়। দুই শ বছর ধরে সবচেয়ে ভদ্রলোকেরাও কথাটা এভাবে বলায় এখনকার ভদ্রলোকেরা কথাগুলো ব্যবহার করেছেন, আর দাবি করেছেন, তিনি আরবি-ফারসিকে সমস্যা মনে করছেন না, কাজেই তিনি অসাম্প্রদায়িক। আসলে পুরো আলাপটাই ভয়াবহ গোলমেলে। বাংলায় ব্যবহৃত এসব শব্দের সঙ্গে ‘আরবি-ফারসি’র সম্পর্ক খুবই সামান্য অথবা একেবারেই নেই। বাংলায় ব্যবহৃত আরবি-উৎসের শব্দগুলো এসেছে মূলত ফারসির মধ্য দিয়ে। এমনকি ধর্মীয় পরিভাষাগুলোও। যাঁরা এখন ‘নামাজ’ বাদ দিয়ে ‘সালাত’ প্রচলনের চেষ্টা করছেন, ভাষার দিক থেকে তাঁদের চেষ্টা বরং সমালোচনাযোগ্য। ফারসি থেকে এসেছে, আমরা সবাই জানি, রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন ও জমিজমাবিষয়ক শব্দরাশি। যে ভাষা থেকে বাংলা ও ভারতীয় অন্য ভাষায় দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য শব্দ ঢুকেছে, সে ভাষাটির নাম হিন্দুস্তানি—ইংরেজির আগে ভারতের সবচেয়ে প্রতাপশালী লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা।

এ কথা মাথায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি দুই শ বছরের এ বাতচিতের গোড়ার ব্যারামটা বুঝে ফেলবেন। ‘আরবি-ফারসি’ ‘বিদেশি’ ভাষা এবং প্রধানত মুসলমানদের সঙ্গে যুক্ত। হিন্দুস্তানি খাঁটি ভারতীয় উৎপাদন এবং এসেনশিয়ালি ভারতের হিন্দু-মুসলমানসহ সব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত। কাজেই হিন্দুস্তানিকে ভাশুর বানিয়ে ‘আরবি-ফারসি’র নাম জবানে এস্তেমাল করতে পারলেই একসঙ্গে অনেকগুলো কেল্লা ফতে করা যায়। দুই শ বছর ধরে এ ঘটনা নানা ফর্মে ঘটছে। যাঁরা ফেসবুকের আলাপ অনুসরণ করেছেন, ব্যাপারটার ব্যাপকতা বুঝতে তাঁদের দেরি হওয়ার কথা না।

তিন. অনেকে ভাষার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতি ইত্যাদির সম্পর্ক নেই বলে মত দিয়েছেন। নিশ্চয়ই ভালো নিয়তেই করেছেন। কিন্তু তাঁদের এ মত ভাষার স্বভাব ও কার্যপ্রণালির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ভাষাকে এঁরা পোশাক হিসেবে ভেবেছেন, যাকে ধুয়ে-মুছে সাফ-সুতরা করিয়ে নেওয়া যায়, এবং চাইলে যেকোনো সুগন্ধি মাখিয়ে অন্য ফ্লেবারও দেওয়া যায়।

না। ভাষা ওই জিনিস নয়। এটা জীবনের প্রধান প্রকাশ; কাজেই জীবনের মাপই এর মাপ। জীবনে যা যা আছে, ভাষাতেও তার সবই আছে। কৃত্রিমভাবে অন্য রূপ যে তৈরি করা যায় না তা নয়, কিন্তু তাতে ভাষার প্রাণ ও প্রবাহ অনেকাংশেই বাদ পড়ে। ভাষা জন ও জীবনবিচ্ছিন্ন হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের শেষ ৪০ বছর লেখ্য বাংলা বিষয়ে এ অভিযোগ বিরামহীন করে গেছেন।

এদিক থেকে যাঁরা ‘জান’ ও ‘জবান’ শব্দের একত্র-ব্যবহারে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, তাঁদের পজিশন, আমি বলব, রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ না–ও হতে পারে, কিন্তু ভাষার চরিত্রের দিক থেকে বিলকুল সহি। এ ব্যবহার রাজনৈতিকভাবে, বিশেষত সাংস্কৃতিক রাজনীতির দিক থেকে, কাজে কাজেই ক্ষমতা-সম্পর্কের দিক থেকে, অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।