জীবনানন্দের মৃত্যুর পর কী ঘটেছিল?

রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি জীবনানন্দ দাশ ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে একে একে ঘটছিল অনেক ঘটনা। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও ঘটনার ঘনঘটা থামেনি। আজ এই কবির প্রয়াণ দিবসে জানা যাক সেই ঘটনাগুলো।

কোলাজমনিরুল ইসলাম

শীত আসি আসি আবহাওয়া। ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ সালের রাত্রিবেলা। কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনের ওপারে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়েই ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য, যিনি জীবনানন্দের কবিতাকে রীতিমতো দার্শনিক ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন, তিনি ওই রাতেই একটি কবিতা লিখলেন:
‘একটি জাহাজ ছেড়ে গেল।
হলো নিরুদ্বেল ও
মনের জেটির কাঠ নেই আর ওঠা-নামা মাল।

যাত্রীর যন্ত্রণা গোলমাল গেছে সমস্ত সকাল
এখন সবাই মোহনায়,
সমুদ্রের লোনা হাওয়া মেখে ঘামে কেউ-কেউ,
কেউ শিস দিয়ে গান গায়।

সে হয়তো গোনে কত ঢেউ
পার হয়ে এল এই লোহা-ঘেরা কাঠ
হয়তো-বা ভাবে এতক্ষণে জেটি চৌকাঠের মতো চৌকো ফাঁকা
কিংবা তার ফাঁকের কপাট
সমস্ত মালের স্মৃতি নিয়ে পিঠ-বাঁকা
সে-যে নিজ বোঝা, কথা-গান নিয়ে দিগন্তে উধাও
যাবার আবেগে বুঝি ভুলে গেছে তা-ও
শুধু মনে আছে থেমে থাকা—
দুদিনের কাঠ-শ্যাওলার ছোঁয়াটুকু
জেটির মাটিতে গাঁথা মুখ,
লোহার আড়ালে গায়ে সবুজের গন্ধে জোড়া পাখা’

জীবনানন্দ দাশ
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রামের ধাক্কায় আহত হন জীবনানন্দ দাশ। ট্রামের ক্যাচারে আটকে দলিত হয়ে গিয়েছিল তাঁর শরীর। এর আট দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। আইন অনুযায়ী তাঁর মৃত্যু যেহেতু দুর্ঘটনায়, ফলে পোস্টমর্টেম তো হতে হবে। তাই কবির মৃতদেহ নিয়ে যেতে হাসপাতালে এসে দাঁড়িয়েছিল কলকাতার পুলিশেরা—না, মৃতদেহ কিছুতেই ছাড়বে না তারা। এ সময় জীবনানন্দের চিরকালের প্রায়-শত্রু ও সমালোচক, ‘শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাস আবার দাঁড়ালেন ত্রাতার ভূমিকায়। এর আগে জীবনানন্দ যখন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন, সে সময় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে সজনীকান্তের দৌড়ঝাঁপেই মূলত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয় জীবনানন্দের। এবারও তিনিই নিলেন মুখ্য ভূমিকা। মূলত তাঁর তদবির ও কলকাতার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের পরোক্ষ হস্তক্ষেপে পোস্টমর্টেম থেকে নিবৃত্ত হয় পুলিশ।

‘বধূ শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহু কাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।’

একদা এই কবিতা লিখেছিলেন যিনি, বলাবাহুল্য জীবন তাঁর কাছে অন্য রকম এক মানে নিয়ে হাজির হয়েছিল। বেঁচে থাকার পেছনে যেন অন্য এক উদ্দেশ্যমানতা ছিল তাঁর। এক সতর্ক, ভীত, আশাহত, অনিশ্চিত মন নিয়ে আত্মিক সংকটের মধ্যে বেঁচে থেকে, ধীরে-ধীরে বেঁচে থাকার সেই নিজস্ব উদ্দেশ্যকে গন্তব্যের দিকে নিয়ে যেতে যেন অপঘাতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন কবি—জীবনানন্দ দাশ, অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতায় ধীর লয়ের এক ট্রাম তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিল? সেদিন স্ত্রী ছিলেন না তাঁর পাশে, শিশুটিও নয়, ততদিনে প্রেম হারিয়ে, আশার মরীচিকার স্বরূপও তিনি খুব বুঝে গিয়েছিলেন। আর্থিক দুরবস্থা চরমে। সব মিলিয়ে ক্লান্তির চমৎকার আয়োজন! চিতা-ভস্ম কি তাঁকে কাছে ডেকেছিল? অথবা, গাঢ় প্রতীতি জন্মেছিল: মৃত্যুতেই মিটে যাক সব!

জীবনানন্দের হাসপাতালে থাকার দিনগুলো ছিল দুঃসহ। একদিন তিনি কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। তখন জেগে থাকলেই প্রলাপ বকতেন তিনি। শরীরে ছিল অসহ্য যন্ত্রণা। এর মধ্যে একদিন বললেন, ‘আচ্ছা, আমাকে তেতলায় নিয়ে যেতে পারো, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কবিতা পড়ব। আমার যে রেডিও প্রোগ্রাম আছে।’ শেষের দিকে এক রাতে হঠাৎ বলে উঠলেন, আকাশে দেখছেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র রং।

১৪ অক্টোবর ১৯৫৪-এর অভিশপ্ত অপরাহ্ন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের কাছাকাছি দুটো দোকান—‘জলখাবার’ ও ‘জুয়েল হাউস’। প্রাত্যহিক সান্ধ্য ভ্রমণের পর জীবনানন্দ দাশ সব সময় যেমন করে বাড়িতে ফিরতেন, সেদিনও তেমনভাবেই ফিরছিলেন। হঠাৎ কোন ‘ভূত’ দেখলেন কে জানে, ওই দোকান দুটির সামনের পথ ধরে রাস্তা পেরোতে গিয়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তখন অদূরেই ধেয়ে আসছে একটি ট্রাম।

চালক অবিরাম ঘণ্টা বাজালেন। কিন্তু কাজ হলো না। মাথা ঘুরে কবি পড়ে গেলেন ধীরগতির বাহনের নিচে। গাড়ি যখন থামল, তখন তাঁর দেহ ট্রামের তলায়।

জীবনানন্দের অচৈতন্য দেহ উদ্ধার করলেন সেলি ক্যাফের মালিক চুনিলাল। তাঁকে ভর্তি করানো হলো শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ট্যাক্সিতে করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় তাঁর কণ্ঠার, বুকের খাঁচার একগুচ্ছ ও জানুর হাড় ভেঙে গেছে। পরে এক্স-রে করে দেখা গেল, ডান দিকের ফুসফুসে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ভাঙা হাড়ের খোঁচায় অনেকটাই থেঁতলে গেছে ফুসফুস। মাংসপেশির ভেতরে হচ্ছে প্রচুর রক্তক্ষরণ।

জীবনানন্দের হাসপাতালে থাকার দিনগুলো ছিল দুঃসহ। একদিন তিনি কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। তখন জেগে থাকলেই প্রলাপ বকতেন তিনি। শরীরে ছিল অসহ্য যন্ত্রণা। এর মধ্যে একদিন বললেন, ‘আচ্ছা, আমাকে তেতলায় নিয়ে যেতে পারো, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কবিতা পড়ব। আমার যে রেডিও প্রোগ্রাম আছে।’ শেষের দিকে এক রাতে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আকাশে দেখছেন “ধূসর পাণ্ডুলিপি”র রং।’ সঞ্জয় ভট্টাচার্য দেখতে এলে তাঁর ডান হাতখানি টেনে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ‘প্রেমেন এল না?’ বলা ভালো, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথাই এখানে বলেছিলেন তিনি।

ট্রামের ধাক্কায় আহত হয়ে জীবনানন্দ দাশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাঁকে আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেকেই দেখতে আসতেন। ভূমেন্দ্র গুহ ও তাঁর বন্ধুবান্ধব তো ছিলেনই। এ ছাড়া ছিলেন কবির ছোট ভাই অশোকানন্দ, তাঁর স্ত্রী নলিনী দাশ, খুড়তুতো বোন জ্যোৎস্না দাশগুপ্ত ও সুপ্রিয়া দাশগুপ্ত। ভূমেন্দ্র গুহ লিখেছেন, ‘তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ করে হাসপাতালে থেকেছেন। কিন্তু জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশকে বেশিক্ষণের জন্য হাসপাতালে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বস্তুত, জীবনানন্দ যেদিন মারা যান, তার কয়েক দিন আগে থেকে তিনি হাসপাতালে আসা পুরো বন্ধ করে দেন এবং মৃত্যুর সময়ে তিনি হাসপাতালে ছিলেন না।’ ‘জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য’ বইতে ভূমেন্দ্র গুহ উল্লেখ করেছেন, ‘জীবনানন্দের মৃত্যুর পর লাবণ্য দাশকে বাসা থেকে হাসপাতালে আনার জন্য দুবার গাড়ি পাঠানো হলেও তিনি আসেননি।’

১৪ থেকে ২২ তারিখ। ৮ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যেন যুদ্ধই করা হলো। অবশেষে ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৪ মিনিটে রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ প্রয়াত হলেন। পরের দিন হলো নাতিদীর্ঘ শোকযাত্রা। মরদেহ নেওয়া হলো দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট মন্দিরের পাশে কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে। চিতায় চড়ানো হলো সেই কবিকে, যিনি লিখেছিলেন:
‘মাটি-পৃথিবীর টানে মানব-জন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হলো সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হলো হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলই অনন্ত সূর্যোদয়।’

সূত্র: ফারুক মঈনউদ্দীন অনূদিত ক্লিন্টন বুথ সিলির ‘অনন্য জীবনানন্দ’, ভূমেন্দ্র গুহর ‘আলেখ্য: জীবনানন্দ’ ও প্রভাতকুমার দাসের ‘জীবনানন্দ’।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]