নববর্ষ ও নিম-হলুদের কথা

বিদ্যমান সমাজ আর বাজার-বাস্তবতায় নববর্ষ এখন মোটাদাগে কতিপয় জায়গায় সচল ও বৃত্তাবদ্ধ: লাল-সাদা পোশাকের রমরমা বাজার-বাণিজ্যে, পত্রপত্রিকার পহেলা বৈশাখের বিশেষ ক্রোড়পত্রের পৃষ্ঠাসজ্জায়, পান্তা-ইলিশ খাওয়ার নগর-মধ্যবিত্তীয় মজায়, বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যাম্পাসগুলোতে কর্পোরেট-অর্থায়নে ঘন ঘন সাউন্ড বক্স সংবলিত নাচাগানার অনুষ্ঠানাদিজাত কানের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর আওয়াজে, ক্যাম্পাসে বৈশাখী মেলার নামে ঘন ঘন স্টলের অস্বাস্থ্যকর সমাগমে, রমনার বটমূলে সকালে সমবেত প্রার্থনা-সংগীতে, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়, তরুণ-তরুণীর নির্দিষ্ট পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানোর তারুণ্য বাতাসে আর চ্যানেলে চ্যানেলে ‘এসো হে বৈশাখে’-এর গানের পুনরাবৃত্তিমূলক অনুষ্ঠানাদি প্রভৃতিতে।

এসবের মধ্য দিয়ে নগর-নববর্ষের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তার শৈল্পিক ইতিবাচক দিকটির উদ্যোক্তা মূলত ‘ছায়ানট’ ও চারুকলা প্রতিষ্ঠানটি। এই নগর-নববর্ষের ঢেউ আজ কেবল শহরে নয়, ছড়িয়েছে মফস্বলে, এমনকি গ্রামেও। এখন সারা দেশেই নগর-নববর্ষের কমবেশি ছবি দেখা যায়। উৎসবের আমেজে মানুষ এই দিনটি পালন করে নানামুখী বিনোদন, খাওয়াদাওয়া এবং ঘোরাফেরার মধ্য দিয়ে। নববর্ষকে উপলক্ষ করে শহরে-গ্রামে মেলা বসে। নববর্ষ এভাবে এখন সারা দেশেই বাঙালির বিশেষভাবে পালনীয় আনন্দের আচার৷

তবে  ইতিহাস বলে, কৃষিভিত্তিক এ দেশে কেবল নববর্ষ নয়, একে পালন করার প্রস্তুতি নেওয়া হতো চৈত্রসংক্রান্তি পালনের মধ্য দিয়ে। এটা আজও গ্রামবাংলার ঘরগেরস্তালিতে পরম্পরাগত আচার হিসেবে পালনীয়। কেননা চৈত্রসংক্রান্তির লোকাচারই মানুষকে নতুন বছর পালন করার উদ্দীপনা জোগায়। অঞ্চল বিশেষে এর আচার-আচরণে খানিক ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য থাকলেও এখনো চৈত্রসংক্রান্তিতে বিশেষভাবে পালনীয় যা—তার মধ্যে অন্যতম হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবারদাবারে তিতা আর নানা পদের শাকপাতা খাওয়া, তেল-হলুদ লাগিয়ে গোসল করা ইত্যাদি। আসলে নববর্ষের দিনে খাবারদাবারে যে জাঁকজমক হয়, তাকে সাদরে-সহজে গ্রহণ করতে পারার জন্যই আগের দিনের এমন প্রস্তুতি। ফলে বছরের শেষ দিন গায়ে তেল-হলুদ লাগিয়ে শুদ্ধ হওয়ার মধ্যে আদতে পরম্পরাগত জ্ঞান আর চর্চায় এ সময়ের আবহাওয়োপযুক্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিই নিশ্চিত হয়। এমনকি এ সময়ে দেহের উপযুক্ত তিতা খাওয়ার বিষয়টিও কিন্তু স্বাস্থ্যসংক্রান্ত। বাড়িঘরে বছরের শেষ দিন খাদ্যের শুরুতে নিমপাতা-বেগুন দিয়ে ভেজে খাওয়ার চল রয়েছে। কোথাও শুধু নিমপাতার একটু ভাজা মুখে দিয়েই খাবার খাওয়ার শুরুয়াদ ঘটে। কোথাও কোথাও এ দিনে কাঁচা নিমপাতার সঙ্গে শুকনা গুড় সকালে খালি পেটে খাওয়ার রীতি রয়েছে। কোথাও কোথাও চরম গরমের উপযোগী খাদ্য দই-চিড়া খাওয়ারও চল রয়েছে। তবে চৌদ্দ শাক খাওয়ার মতো আচারও এ দিনেরই।

এখন চৌদ্দ শাকের জোগাড়ে ভাটা পড়লেও গ্রামে-শহরে অনেক বাড়িঘরে আজও পাঁচমিশালি শাক খাওয়ার রীতিটি ঠিক চালু আছে চৈত্রসংক্রান্তির দিনটিতে। এ দিনে নিরামিষ খাবার খাওয়ার রীতি রয়েছে অনেক বাড়িঘরে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, এ দিন পাকস্থলীকে পরের দিনের গুরুপাক খাবার গ্রহণের উপযোগী করার এ হলো এক লোকায়ত বিধিব্যবস্থা।

আজকাল আমরা যারা পহেলা বৈশাখের আনন্দকে পোশাক, করপোরেট-গানবাজনা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া আর ঘুরে বেড়ানো প্রভৃতি বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে আটকে ফেলেছি, তাদের এসবের পাশাপাশি পরম্পরাগত ওই সমস্ত লোকাচারগুলোও নতুনভাবে পরখ করে দেখতে বলি; বিশেষত নববর্ষের প্রস্তুতিমূলক চৈত্রসংক্রান্তির নিমপাতা খাওয়া, হলুদ গায়ে মেখে গোসল করা, নানা পদের শাক খাওয়ার মতো লোকায়ত বিষয়গুলো। কারণ, কে না জানে নিম ও হলুদ—দুটোই হলো এক শক্তিশালী প্রাকৃতিক উপাদান, যার উপযুক্ত ব্যবহারে দেহ শুধু সুন্দর শুদ্ধ জীবাণুমুক্ত হয় তা-ই নয়, এ দুটোর ব্যবহার মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ব্যাধি মোকাবিলায় শরীরকে সাহায্যও করে।

বিদ্যমান করোনা-বন্দী সময়ে চলুন, সম্ভব হলে ঘরে বসেই সে নিম-হলুদের সন্ধান করি। নিম-হলুদের পরম্পরাগত ব্যবহার এ সময় আমাদের জন্য অবশ্যই কাজের হবে। সবাই সাবধানে থাকুন, বাড়িতে বসেই উৎসবের নির্যাস সীমিত পরিসরে শরীর-মনে মাখুন, এ দুর্যোগের সময় উৎসবের মতো সমবেত আনন্দযজ্ঞ পরিহার করা ছাড়া নিরাপদে থাকার আর উপায় কী!

আসুন, এ দুর্দিনে ঘরে বসে সামনের সুদিনের জন্য প্রার্থনা করি এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সাবধানে নিজ নিজ ঘরে থাকি! ওম শান্তি।

কৃতজ্ঞতা: সবিতা ভট্টাচার্য্য, নাসুরা বেগম ও কল্যাণী দাশগুপ্তা