প্রত্ন-জীবন থেকে আধুনিকতায়

শিল্পী: লেজার উরি
শিল্পী: লেজার উরি

প্রথম বাঙালি আত্মজীবনীর রচয়িতা রাসসুন্দরী দেবী শ্বশুরবাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের চেষ্টায় চৈতন্য ভাগবত পড়বেন বলে বাংলা অক্ষর চিনতে শিখেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম উল্লেখযোগ্য মুসলিম নারী লেখক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রাতের অন্ধকারে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সংগোপনে ভাইয়ের কাছে শিক্ষালাভ করেছিলেন। রাসসুন্দরীর ঠিক এক শ বছর পরে সৈয়দা মনোয়ারা খাতুন লিখেছিলেন, ‘চাষার মেয়ে জোয়ান অব আর্ক যা যা করেছিল, আমরা ভদ্রলোকের মেয়ে হয়ে তা করতে পারি না কেন?’ কী ছিল সেই অতৃপ্তি? প্রথমত, শিক্ষা অর্জন থেকে বঞ্চিত হওয়ার আক্ষেপ। দ্বিতীয়ত, পুরুষ যেভাবে যা লেখে তার চেয়ে আলাদা কিছু লিখতে চাওয়া। বাঙালি নারীর মধ্যে সেই উনিশ শতক থেকেই সমষ্টিগত চেতনা আর ব্যর্থতার বোধ ছিল প্রায় একই, নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে লিখতে পারার আকুতি।

নারীরা আসলে যা লেখেন, যা লিখতে চান—কি বিষয়–আশয়ের দিক থেকে, কি ভাষাভঙ্গিতে, পুরুষের তুলনায় তা আলাদা হয়েই পড়ে। মনে রাখতে হবে, আলাদা কিন্তু অনুল্লেখযোগ্য নয়; বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক পার্থক্য আর বঞ্চনার বোধ থেকে নারীর লেখা পুরুষের তুলনায় আলাদা হয়ে যায়। তাদের বয়ানে শুধু নারী নয়, পুরুষের কথাও বড় একটা জায়গাজুড়ে থাকে। নারী ও পুরুষের লেখার এই পার্থক্যকে গত শতকের আশির দশকেই দুজন নারীভাবুক এলিজাবেথ আবেল ও অ্যাস্টেল সি জেলিনেক ‘ফেমিনাইন’ বলে একটা তাত্ত্বিক কাঠামোয় দেখার চেষ্টা করেছেন। পরে এ কথাটাই ফরাসি সাহিত্যতাত্ত্বিক হেলেন সিসু বলেছেন, নারীত্বধর্মী লেখার অস্তিত্ব থাকবেই। তবে এই লেখা কখনো পুরুষতন্ত্রের কারণে পুরুষের মতো একমাত্রিক হবে না, হবে বহুমাত্রিক। নারীর ‘আমি’ আসলে সমষ্টিগত ‘আমরা’।

প্রত্ন-পুরাণ থেকে আধুনিকতায়
কথাটা বলেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় সমাজ সংস্কারের পথ ধরেই ভারতীয় নারী আধুনিক হয়ে উঠেছে। ইংরেজি শেখা বাঙালি ভদ্রলোকেরা চেয়েছিলেন, তাঁদের দাম্পত্যজীবন হবে ভিক্টরীয় আদর্শে গড়া। মনে করেছিলেন স্ত্রী হবে আদর্শ সঙ্গিনী। সংস্কার বলতে তাঁরা নারীস্বাধীনতার কথা ভাবেননি। উনিশ শতকের নবজাগরণের বিনির্মাণ নারীকে দেখেছে জাতীয়তাবাদী ভদ্রলোকদের অনুসারী হিসেবে, স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে নারীকে বিবেচনা করেনি। হিন্দু সমাজের নারী বিনির্মাণের এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুমিত সরকার ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আর মুসলমান সমাজের কথা বলেছেন আনিসুজ্জামান, গেল মিল্টন ও সোনিয়া নিশাত আমিন। মালবিকা কার্লেকর অবশ্য নারীর আত্মজীবনী বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালি মেয়েদের কেউ কেউ নিজেদের স্বাধীন পরিসর তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। ওই শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই বাঙালি মেয়েরা নিজেদের মতো করে নিজেদের জীবনের পথে প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন। এক হিসেবে দেখা যায় ১৮৫০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে নারীর রচিত কম করে হলেও শ চারেক সাহিত্যকর্ম এবং তাঁদের সম্পাদিত ২১টি পত্র-পত্রিকার সন্ধান মেলে। সোনিয়ার পর্যবেক্ষণ অবশ্য আশান্বিত করার মতো নয়। তিনি বলেছেন, মুসলিম নারীজাগরণ ‘ব্যক্তিগত পিতৃতান্ত্রিকতার স্থলে সর্বজনীন পিতৃতান্ত্রিকতার জন্ম দিয়েছে।’ সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাঙালি মুসলমান নারীর আত্মমুক্তির সূত্রপাত হয়েছে গত শতকের চল্লিশের দশকে; আর সেটা ঘটেছে নারীশিক্ষার পথ ধরে।

সেদিক থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে ভাষা আন্দোলনই হচ্ছে বাঙালি মুসলমান নারীর প্রথম বাইরে পদক্ষেপের সূচনাকাল। এরপর ষাটের দশকে আমাদের নারীরা শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে সমাজে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। আর মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এখন নারী ক্রম-অগ্রগতির সূত্রে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করে চলেছেন।
আগেই বলেছি, সমাজ সংস্কার ও শিক্ষার সঙ্গে নারীর সাহিত্য রচনার ধারাটিও গভীরভাবে যুক্ত। অধিকাংশ গবেষকই দেখতে চেয়েছেন, নারীর জীবন আমাদের সাহিত্যে কীভাবে কতটা প্রতিফলিত হয়েছে। নারী সাহিত্যিক হিসেবে কতটা প্রতিষ্ঠা অর্জন করলেন, সামগ্রিকভাবে সেই বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস রচনায় তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি। এ নিয়ে কি প্রাতিষ্ঠানিক, কি ব্যক্তিগত কোনো স্তরেই উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। আমি অবশ্য এখানে দুজন গবেষকের কথা উল্লেখ করব, যাঁরা ব্যর্থতার এই ছবিটিকে নিজেদের প্রজ্ঞা ও প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের একজন হচ্ছেন আনিসুজ্জামান এবং আরেকজন মালেকা বেগম। বাঙালি মুসলমান নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জনের পাশাপাশি কীভাবে তাঁরা সাহিত্যক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন, তার বিবরণ ছড়িয়ে আছে এই দুই মনীষী-গবেষকের নানান গ্রন্থে ও প্রবন্ধে।

সময় থেকে সময়ান্তরে
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, তবু বলা যায়, চন্দ্রাবতীই প্রথম বাঙালি নারীলেখক। তবে প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের কালেই আবির্ভাব ঘটেছিল দুজন নারী ঔপন্যাসিকের। তাঁদের একজন লিখেছিলেন মনোত্তমা শীর্ষক একটি উপন্যাস। কিন্তু ‘হিন্দুকুল-কামিনী প্রণীত’ কথাগুলো ছাড়া সেই উপন্যাসে লেখকের কোনো নাম ছিল না। এর বিষয়বস্তুও বেশ আকর্ষণীয় ছিল। শিক্ষিত আলোকিত নারী মনোত্তমা তার জীবনের গতিপথ কী হবে, তাই নিয়ে বোঝাপড়া করছে। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য উপন্যাসটি হেমাঙ্গিনী দেবী রচিত মনোরমা (১৮৭৪)। সম্ভবত ফুলমনি ও করুণার বিবরণ (১৮৫২ সালে এক ইংরেজের লেখা উপন্যাস), মনোত্তমা এবং নবীনকালী দেবীর কামিনীকলঙ্ক-এর (১৮৭০) পর এটি নারীর লেখা চতুর্থ উপন্যাস। ঐতিহাসিক দিক থেকে এসব উপন্যাসের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে রূপজালাল (১৮৭৬) নামে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যগ্রন্থ রচনা করেন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। আনিসুজ্জামান বলছেন, ফয়জুন্নেসাই প্রথম মিশ্রভাষা বর্জন করে খাঁটি বাংলায় সাহিত্য রচনা করেন। ওই একই বছরে প্রকাশিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর দীপ নির্বাণ। রবীন্দ্রনাথের বোন স্বর্ণকুমারীই ছিলেন সূচনাকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান নারী লেখক। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এই বোনটির লেখালেখি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই নিস্পৃহ ছিলেন। তবে মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম গদ্যরচনার কৃতিত্ব যাঁর, তিনি হচ্ছেন তাহেরুন্নেসা। ১৮৬৫ সালে ‘বামাগণের রচনা’ নামে বামাবোধিনী পত্রিকায় তাঁর একটি গদ্য ছাপা হয়। ওই একই পত্রিকায় ১৮৯৭ সালে লুৎফুন্নেসা নামের আরেক মুসলমান নারীর কবিতা প্রকাশিত হয়। সেদিন থেকে বিবেচনা করলে তিনিই হচ্ছেন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত প্রথম মুসলমান নারী কবি। নারী জীবনের অনগ্রসরতা আর এগিয়ে আসার আহ্বানই তাঁদের লেখায় বিষয় হয়ে উঠেছে।

তবে ঠিক উনিশ শতক নয়, বাঙালি মুসলমান নারীর লেখালেখিতে ব্যাপক আত্মপ্রকাশ ঘটে বিশ শতকে। আজিজুন্নেসা সম্ভবত প্রথম মুসলমান নারী, যাঁর লেখা মুসলমান সম্পাদিত ইসলাম প্রচারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর পরে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে খায়রুন্নেসার। প্রবন্ধ লিখতেন তিনি। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনেরও সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটে বিশ শতকের সূচনাবর্ষ ১৯০১ সালে, নবপ্রভা পত্রিকায় ‘পিপাসা’ নামের একটি লেখার মাধ্যমে। রোকেয়া হচ্ছেন সেই সব বিরল লেখকের একজন, যিনি একাধারে সমাজসংস্কারের কথা বলেছেন, আবার সৃজনশীল রচনায়ও ছিলেন সমান সক্রিয়। ব্যঙ্গ রচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প ইত্যাদি সব ধরনের লেখাই তিনি লিখেছেন। তাঁর রচনা ক্ষুরধার যুক্তি, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আর প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা। নারীর অধস্তনতা, অবদমন আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীর প্রতি নির্যাতনের যে ছবি তাঁর লেখায় পাওয়া যায়, বিস্ময়কর শোনালেও এত বৈচিত্র্যপূর্ণ লেখা বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। রোকেয়ার অনুসারী হিসেবে এর পরেই আবির্ভাব ঘটে শামসুন্নাহার মাহমুদ ও রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর।

বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম ঔপন্যাসিক হচ্ছেন জোবেদার (১৯২১) রচয়িতা এস এফ খাতুন। দ্বিতীয় বাঙালি মুসলিম নারী ঔপন্যাসিক স্বপ্নদ্রষ্টার (১৯২৩) নূরুন্নেছা খাতুন। রোকেয়ার পদ্মরাগ–এর আগে লেখা হলেও প্রকাশিত হয় পরে (১৯২৫)। কবিতা রচনাতেও এই সময়ে আবির্ভাব ঘটে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ও সুফিয়া কামালের। দুজনই রোমান্টিক ও সমাজ সংস্কারমূলক কবিতা রচনা করেছেন। দুজনেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন কবি। গার্হস্থ্যজীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রেম-প্রেমহীনতাই ছিল বাঙালি মুসলমান নারীর লেখার বিষয়–আশয়।

প্রথম যুগের এই দ্বিধারক্তিম পথ পেরিয়ে পরবর্তী সময়ে—পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে আমাদের নারীরা অনেকটা বাধাবন্ধনহীন পরিবেশে সাহিত্যচর্চা করেছেন। এই সময়েই প্রথম দিকে আমরা পেয়েছি রিজিয়া রহমান, দিলারা হাশেম, লায়লা সামাদ, জুবাইদা গুলশান আরা, মকবুলা মনজুর, জাহানারা ইমাম, সেলিনা হোসেন, জাহানারা আরজু, খালেদা এদিব চৌধুরী, রুবী রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, জিনাত আরা রফিক, ঝর্নাদাশ পুরকায়স্থ, সুরাইয়া খানমের মতো সৃষ্টিশীল ঔপন্যাসিক ও কবিদের।

স্বাধীনতার পরে এ ধারাটি আরও বিচিত্রমুখী হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে নারী লেখকদের সংখ্যা এতটাই আশানুরূপ যে, বাংলাদেশের সাহিত্যকে তাঁরা নানাভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তবে যে কথাটি বলে এই লেখাটি সমাপ্ত করা যেতে পারে সেটি হলো, লেখক নারী আর তাঁদের বিষয়–আশয় নারীভাবাপন্ন হলেও, রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সর্বজনীন ছবিটি সবার মধ্যেই স্পষ্ট। লৈঙ্গিক পার্থক্যের বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও সেটি সমাজের ছবি হিসেবেই ফুটে উঠছে। সেই সঙ্গে তাঁদের রচনা ভাষা ও রচনাশৈলীর দিক থেকে পুরুষের সমধর্মী। পুরুষের সঙ্গে তুলনাটা করা হলো এই ভেবে যে, এখন আর নারীর লেখাকে মোটা দাগে নারীর লেখা বলে শনাক্ত করা যায় না। লৈঙ্গিক বিভাজন নারী-পুরুষ উভয়ের সব ধরনের লেখাতেই ঘুচে গেছে। নারীর লেখাকে নারীর লেখা বলে উন্নাসিকতা দেখানোর অবসান ঘটে গেছে।