পয়লা বৈশাখের রূপান্তর

পয়লা বৈশাখের কথা দূরে থাক, একসময় ‘বঙ্গাব্দ’ কথাটারই অস্তিত্ব ছিল না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শব্দটার আবির্ভাব। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’র (১৮৬৫) শুরুতেই শব্দটা পাওয়া যায়। তাহলে বাংলা বছর বোঝানো হতো কী দিয়ে? একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

কলকাতার প্রথম আদালতের নাম ছিল মেয়র্স কোর্ট (১৭২৬-১৭৭৩)। সেই কোর্টের প্রথম যে বাংলা দলিলটি রক্ষা পেয়েছে (ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে), তাতে তারিখটি দেওয়া আছে: ‘সন ১১৬২, ইঙ্গরেজী ১৭৫৬ সাল তারিখ ২২ মাঘ ২ ফিবরিল।’ ১১৬২ সনের কোনো নাম নেই। কিন্তু ইংরেজি সনের নাম আছে। কেবল তাই নয়, ইংরেজির বেলাতে বলা হয়েছে ‘সাল’ আর বাংলার বেলায় ‘সন’। বস্তুত, তখন পর্যন্ত ‘সন’ ছাড়া, বাংলা বছরেরর আর কোনো নাম ছিল না। শুধু এই দলিল থেকে নয়, আরও দৃষ্টান্ত থেকেও কথাটা বোঝা যাবে। ক্যালকাটা গেজেট পত্রিকায় হাজারখানেকের বেশি বাংলা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় ১৭৮৪ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে। এই সব বিজ্ঞাপনে তারিখ দেওয়া হতো এভাবে: ‘ইতি সন ১১৯৮ ইং ১৭৯২ তাং ২২ ফীবরীল ১৩ ফাল্গুন’। এখানেও ১১৯৮ বছরটাকে বাংলা সন বলে চিহ্নিত করা হয়নি। সত্যি বলতে কী, তখন বাংলা সন বলে কোনো কথা ছিল না। উনিশ শতকের প্রথম দিকেও নয়। যেমন বাংলা প্রথম সংবাদপত্র  প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে। তার প্রথম সংখ্যায় তারিখ দেওয়া আছে: ২৩ মে সন ১৮১৮ ১০ জ্যৈষ্ঠ সন ১২২৫।

আসলে সম্রাট আকবর ‘বাংলা সন’ নামে কোনো সন প্রবর্তন করেননি, তবে তিনি একটা সন প্রবর্তন করেছিলেন। সে সনটা তিনি চালু করেন তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র। নামও ছিলো সর্বত্র এক—ফসলি সন। ফসলের সঙ্গে যোগ থাকে ঋতুচক্রের, আর ইসলাম ধর্মের সঙ্গে যোগ পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের প্রদক্ষিণের। ফসলের সঙ্গে খাজনা আদায়ের যোগ থাকায় এই বছরের নাম দেওয়া হয় ফসলি সন। আজও নামটি ভারতের কয়েকটি প্রদেশে চালু আছে। তা হলে কথাটা দাঁড়ায় এই যে ফসলি সনই উনিশ শতকে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিত হয়। পয়লা বৈশাখের ধারণা তখনো দূর অস্ত।

জীবনের প্রথম পয়লা বৈশাখের কথা যা আমার মনে আছে, সেটা ১৯৫০ সালের। ঠিক পয়লা বৈশাখের না, ‘হালখাতা’র। হালখাতা কথাটার মানে তখন জানতাম না। তাই মনটা ছিল কৌতূহলে ভরা।

বাবার সঙ্গে গলাচিপা বন্দরের এক বড় দোকানে গেছি রাতের বেলায়। বিক্রেতারা থাকলেও ক্রেতা মাত্র তিন-চারজন। কার্বাইডের আলো জ্বলছে। বৈদ্যুতিক আলোর পর তখনকার দিনে দ্বিতীয় অভিজাত আলো ছিল কার্বাইডের বাতি। খুব উজ্জ্বল। সেই আলোতে তাকিয়ে দেখি, দোকান-সাজানো গাঁদা ফুলগুলোর রং হলুদ নয়, সাদা হয়ে গেছে। সাদা গাঁদা! বিশ্বাস হতে চায় না। যতক্ষণ সেই দোকানে ছিলাম, মনের মধ্যে খুঁত খুঁত করতে থাকল। অন্য দিকে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। পরে শুনলাম, আলোতে হলুদ রং নাকি অমনই দেখায়। মনে আছে, দোকানদাররা আমাদের মিষ্টি খেতে দিল। আর বাবা পকেট থেকে একটা রুপার টাকা বের করে দিলেন। টাকাটায় বোধ হয় সিদুঁর মেখে একটা সরু বাঁধানো খাতায় লাল ছাপ এঁকে দিল। শুনলাম ওর নিচে আমাদের এ বছরের হিসাব, বিশেষ করে ধারে কেনার হিসাব লেখা হবে। বুঝলাম, হালখাতা মানে বর্তমান বছরের কেনাবেচার হিসাব। সেকালে পয়লা বৈশাখের এই ছিল প্রধান উৎসব।

ওদিকে তত দিনে জমিদারি প্রথা প্রায় উঠে গেছে। কিন্তু একসময় জমিদাররা পয়লা বৈশাখ অথবা বছরের প্রথম দিকে পুণ্যাহ বলে একটা উৎসব পালন করতেন। সেদিন কাছারিবাড়িটা সাজানো হতো। তার সামনে থাকত নানা বাদ্যযন্ত্রের ব্যান্ড। দেশি আর বিলিতি বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। সানাই আছে, আবার কর্নেট, ক্লারিওনেটও আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে থাকত ঢাকের বাদ্যি। ছেলেমেয়েদের ভিড় ব্যান্ডের কাছেই। প্রজারা চলে যেত কাছারির ভেতর। সেখানেই আদান-প্রদান। মোটকথা, পুণ্যাহটা হালখাতার মতো। পার্থক্য এই যে ‘হালখাতা’ হলো ক্রেতার সঙ্গে দোকানদারের দেনা-পাওনাসংক্রান্ত; আর ‘পুণ্যাহ’ প্রজাদের সঙ্গে জমিদারের।

ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় উৎসবের কথা বাদ দিলে আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রধান উৎসব হলো পয়লা বৈশাখ অথবা বাংলা নববর্ষের উৎসব। যদি একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানকেও ‘উৎসব’ বলে বিবেচনা করা হয়, তা হলে সেটাকেও আমাদের প্রধান উৎসব বলে গণ্য করতে হয়। কিন্তু পয়লা বৈশাখের দিকে তাকানো যাক। যা ছিল ‘হালখাতা’ আর ‘পুণ্যাহ’র উৎসব, তা-ই কখন এবং কী করে পয়লা বৈশাখের বর্ণাঢ্য এবং প্রাণের উৎসবে পরিণত হলো?

রক্তক্ষয়ী একুশের প্রথম ঢেউ লেগেছিল চুয়ান্নোর নির্বাচনে। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান এনেছিল, এই নির্বাচনে তা চিরদিনের জন্যে মুছে গেল। তারপর কেবল বাংলা ভাষার প্রতি জনগণের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়নি, বরং গোটা সমাজেই ধীরে ধীরে বাঙালিয়ানার জোয়ার বইতে শুরু করে। শহীদ দিবস পালন করাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর রীতিমতো প্রবল আবেগ প্রকাশ পেত। তা ছাড়া বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেতে আরম্ভ করে নানাভাবে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি সচেতনতাও বৃদ্ধি পায়। ছেলেমেয়েদের বাংলায় নাম রাখাও ফ্যাশনেবল হলো। গাড়ির নম্বর প্লেট বাংলায় লেখা, দোকানের নামফলক বাংলায় লেখা ইত্যাদির মধ্য দিয়েও এই ভালোবাসা প্রকাশ পায়। দেশে তখন আইয়ুব খানের ফৌজি শাসন চলছিল।

তা সত্ত্বেও আমরা যখন ১৯৬২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দিই, তখনো পয়লা বৈশাখের আজকের মতো অনুষ্ঠানের সূচনা হয়নি। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগেও নয়। কিন্তু যুদ্ধের পর নতুন প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ ঘটা করে রবীন্দ্রজয়ন্তী এবং ঋতুউৎসব পালন করার উদ্যোগ নেয়। ঋতুউৎসবের মধ্যে বর্ষবরণও ছিল একটা। মনে হয়, ১৯৬৬-৬৭ সাল থেকে পয়লা বৈশাখের উৎসবের সূচনা। তখনকার বর্ষবরণ, ঋতুউৎসব, রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদি অনুষ্ঠানকে দেখা হতো পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অনুষ্ঠান হিসেবে। এগুলো ছিল তখনকার স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালিয়ানার বলিষ্ঠ এবং উদ্ধত প্রকাশ। তখনো পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঠিক উৎসবে পরিণত হয়নি। তখনো এ ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে লড়াইয়ের অংশবিশেষ।

পয়লা বৈশাখ আনন্দের অনুষ্ঠানে পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধের পর—স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু ১৯৮০ সালের আগে-পরে দিনটি উদ্‌যাপনের মধ্যে ফৌজি-শাসনবিরোধী অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেত। তখনো ছায়ানটের আয়োজিত রমনার বটমূলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই ছিল এ উৎসবের মূল আকর্ষণ। সার বেঁধে বন্ধুদের নিয়ে অথবা সপরিবারে সেখানে যাওয়াই ছিল সংস্কৃতিবান বলে নিজেদের পরিচিত করার প্রধান উপায়। সেই সঙ্গে পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ খাওয়াও কখন যে যুক্ত হলো, ঠিক করে বলা যায় না—যদিও কোনোকালে গ্রামবাংলায় ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল বলে জানা যায় না। ভাবলে অবাক হই, তখন তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জিনিসটার অস্তিত্ব ছিল না! তাহলে কী করে জনে-জনে সর্বত্র ইলিশ আর পান্তার বার্তা পৌঁছে গেল, ভেবে পাই না। কেবল পৌঁছাল না, তা রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হলো।

এ উৎসবে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট কলেজ (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) যখন এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগ দিল। তাদের নতুন নতুন নকশার আলপনা, তাদের তৈরি বাস্তব ও কাল্পনিক জীবজন্তুর রংবেরঙের বিশাল প্রতিকৃতি, মঙ্গল শোভাযাত্রা এ অনুষ্ঠানকে রীতিমতো আড়ম্বরপূর্ণ করে তোলে। তার সামনে ছায়ানটের বটমূলের অনুষ্ঠানও যেন খানিকটা ম্লান হয়ে গেল। কারণ, গান শুনে এবং বুঝে তার প্রশংসা করা কঠিন। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো একটা জিনিস সহজেই চোখে পড়ে। এখন তাই অনেকে কেবল এই শোভাযাত্রা দেখার জন্যে রমনা-শাহবাগ অঞ্চলে সমবেত হন।

‘সুরের ধারা’ নামক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে বৈচিত্র্য দিয়েছে। এদের অনুষ্ঠান শুরু হয় আগের দিন সন্ধ্যায়, যদিও রাত বারোটা পর্যন্ত সে অনুষ্ঠানকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান। চৈত্রসংক্রান্তির সঙ্গে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের কোনো যোগাযোগ আছে বলে শুনিনি। কিন্তু ‘সুরের ধারার’ অবদান যেখানে, সে হলো হাজার কণ্ঠে একযোগে গান পরিবেশনা। এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্যে সারা দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা ঢাকায় আসে, গান শেখে, গান পরিবেশন করে। বস্তুত বর্ষবরণের অনুষ্ঠান কেবল বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা এবং গোটা দেশের ছোটবড় শহরেও।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে পল্লির কুটিরশিল্পের মেলাও বসে, বিশেষ করে বাংলা একাডেমির চত্বরে। মোটকথা, পয়লা বৈশাখের উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। সে জনপ্রিয়তা এমন আন্তরিক এবং ব্যাপক যে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এবং ফৌজি শাসক এ উৎসবকে সৎমায়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখলেও এ উৎসবকে বাধা দিতে পারেনি। তবে রাজনৈতিক রোষ নয়, পরিবেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় এবার প্রকৃতির প্রতিশোধ নেমে এসেছে গোটা মানবজাতির ওপর। পয়লা বৈশাখের সাজানো মঞ্চও তাই করোনার বিভীষিকায় অন্ধকার।