বাংলাদেশি উর্দু কবির মুক্তিসংগ্রাম

ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ—শব্দে শব্দে লড়ে গেছেন এক উর্দু কবি—নওশাদ নুরী। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই কবির জীবনবৃত্তে ফিরে দেখা।

নওশাদ নুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। সত্তরের দশকের শেষের দিক। ঢাকার শহর থমথম করছে। ইতিহাস তৈরি হবে। জন্ম হবে একটা স্বাধীন দেশের। তাঁর অপেক্ষায় সবাই। একজন দীর্ঘদেহী মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে বেশ আগে। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা সেরে ফিরছিলেন বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় আমগাছের সামনে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তিনি। অনেকক্ষণ তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। ফিরে একটা কবিতা লিখলেন, উর্দু কবিতা—‘আম কি দরখত’। কবিতার পুরো নাম, ‘আমগাছ’ (বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে থাকা এক নাগরিক)। সন্ধ্যায় একটা আমগাছের জমাটবাঁধা সবুজ অন্ধকারে তিনি ইতিহাসের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন:

এই ভয়াবহ রাতেও যেন অস্ফুট

স্বরে কী বলো তুমি

অনাগত প্রভাতের যেন একই পথে

পা ফেলো তুমি

...

সুন্দরের রক্তে বাংলার তুলনারহিত

এক সৃষ্টি তুমি

শিক্ষার ফাঁকা গ্রন্থের বাইরে

এক অর্থপূর্ণ অধ্যায় তুমি

সন্ধ্যায় আমগাছের জমাটবাঁধা সবুজ অন্ধকারে সেদিন যে কবি ইতিহাসের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন, তাঁর নাম নওশাদ নুরী। তিনি জন্মেছিলেন ইংরেজ আমলের ভারতবর্ষের বিহারে, ১৯২৬ সালে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর জন্মভূমি ছাড়েননি। কিন্তু ১৯৪৯ সালে মামলা হলো। বাদী রাষ্ট্রপক্ষ। অভিযোগ তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন। তখন তিনি তরুণ। বিহারের পাটনার বিএন কলেজ থেকে সবে স্নাতক হয়েছেন। তাঁর নামে একেবারে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক পড়লে দেখা যায় কী প্রবল দারিদ্র্য আর বঞ্চনায় জীবন কাটায় বিহারের মানুষ। সেই বিহারেই সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়া কবি নওশাদ নুরী শোষণমুক্ত সমাজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ছিলেন সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘ, বিহারের সাধারণ সম্পাদক। সেই সময় জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গ ছেড়ে ভারত রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। ‘ভিখারি’ নামে একটি কবিতা লিখলেন নওশাদ নুরী। এটি তিনি পাঠ করলেন লেখক সঙ্ঘের প্রকাশ্য সভায়। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সেই কবিতা। ভিখারিরা গাইতে লাগল পথে, ট্রেনে। নওশাদ নুরীর বিরুদ্ধে মামলার এই হলো কারণ। হুলিয়া মাথায় নিয়ে ভারত ছেড়ে তখনকার পূর্ব বাংলায় এলেন নওশাদ। তাঁর স্ত্রীও পরে এলেন এই বাংলায়। কিন্তু কন্যা রয়ে গেল। একটু বড় হয়ে সে তো আর বাবা-মাকে চেনে না। চেনে দাদা-দাদিকে। সে রয়ে গেল ভারতেই। বাংলাদেশে জন্মানো ভাই–বোনদের সঙ্গে বড় বোনের দেখা হলো প্রথম ১৯৯৬ সালে।

নওশাদ নুরী এই বাংলায় এসে খুঁজে বের করলেন প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী, কবি আর লেখকদের। খুব অল্পদিনের মধ্যে তিনি কাছের মানুষ হলেন রণেশ দাশগুপ্ত, শামসুর রাহমানদের। তাঁর প্রিয় বন্ধু ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আসা সালাউদ্দিন মাহমুদ। চিন্তার দিক দিয়ে নওশাদের সঙ্গে তাঁর মিল ছিল। নওশাদ তাঁকে বললেন, ‘গমের খেত আর ভুট্টার খেতের কথা ভুলে এখন ধানখেতের চিন্তাটা করো।’ ভাষা আর ভূগোলের বন্ধনের চেয়ে তাঁর কাছে মানুষের মূল্য ছিল বেশি।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সে নজির পাওয়া গেল। ভাষা আন্দোলনকে তিনি এক রাষ্ট্রীয় দুর্যোগে বাংলার মানুষদের আপন অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে দেখলেন। লিখলেন কবিতা ‘মহেনজোদারো’। ফলে বছর কয়েক আগে কবিতা লেখার দায়ে হুলিয়া নিয়ে দেশ ছাড়া কবি এবার সেই সময়ের পাকিস্তানের পূর্ব বাংলা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে নির্বাসনে রইলেন রাষ্ট্রের হুকুমে। চাকরি নিয়েছিলেন কিছুদিন আগে। সেই চাকরিও গেল।

একসময় দেশে ফিরলেন। এবার চলল পুরোদমে সাংবাদিকতা। সম্পাদনা করতে লাগলেন সাপ্তাহিক রুদাদ। কবিতা তাঁর পৃথিবী। কিন্তু পূর্ব বাংলার আকাশে–বাতাসে তখন চলছে স্বাধীনতা নামের কবিতা লেখার আয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে নওশাদ নুরী ১৯৬৯ সালে প্রকাশ করলেন উর্দু পত্রিকা জারিদা। তাজউদ্দীন আহমদ এ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক। পত্রিকাটি বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামের উর্দু মুখপত্র। সম্পাদক নওশাদ নুরী তাতে ছেপে যাচ্ছেন পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের পরিচিতি আর রচনার উর্দু অনুবাদ। ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে হলো সাধারণ নির্বাচন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭০-এ জারিদার শিরোনাম ছিল, ‘দুটো মাত্র পথ, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়তো কেন্দ্রের দাসত্ব’। প্রধান সংবাদ ছিল, ‘হামারি নাজাত তুমহারি নাজাত, ছে নুকাত ছে নুকাত’, মানে, আমার মুক্তি তোমার মুক্তি, ছয় দফা ছয় দফা। এর কিছুদিন পরেই তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুর পর দিন লিখলেন কবিতা ‘লোহু মেঁ শারাবোর দিন’, রক্তে ভেজা দিন:

রক্তের স্রোতে ভেসে যায় শীতলপাটি

তীক্ষ্ণ ক্ষতের মতো ঢাকায় এখন করাচির কথা

কাগান থেকে রাঙামাটি এখন অনেক দূর

...

যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো

পথ নেই বাকি

আর কিছু নেই দেওয়ার

শুধু ঘৃণা ছাড়া

মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় জারিদার অফিস ছিল বাংলার বাণীর পাশেই। সেই অফিস এলাকা আক্রান্ত হলো সেনাবাহিনীর হাতে। নওশাদ নুরী সেদিন দপ্তরেই ছিলেন। ভাগ্যিস, জারিদার সাইনবোর্ড আগেই নামিয়ে রাখা হয়েছিল। হয়তো ঠাহর করতে না পেরে মাঝখানের পিপলস ইনস্যুরেন্সের অফিস মর্টার দিয়ে উড়িয়ে চলে গেল সাঁজোয়া গাড়ি।

এরপরও নওশাদ নুরী থেমে থাকেননি। লিখলেন কবিতা, ‘সশস্ত্র সৈনিকেরা’ (পাকিস্তানি ফৌজি নীতি)। উর্দু নাম ‘মাসসালাহ ফৌজ’:

এত যে সবুজ ধীরে ধীরে আজ

রক্তের লালে হচ্ছে ঘেরাও

...

অন্ধ তোমরা চোখেও পড়ে না

লাশেরা এখন তুলছে দেয়াল

কবি নওশাদ নুরী বাংলায় আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যে মাওলানা ভাসানী, কমরেড আবদুল হকসহ আরও ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। আবদুল হকের প্রয়াণে লিখেছেন কবিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডেকে বলেন, ‘নওশাদ, আবার জারিদা বের করা শুরু করো।’ কবি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আর কিছুদিন অপেক্ষা করি।’ সেই অপেক্ষা আর ফুরায়নি। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। ১৭ আগস্ট নওশাদ নুরী লিখলেন বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত তাঁর ‘টুঙ্গিপাড়া’ কবিতা:

জানো কি তোমরা?

এইখানে শুরু হয়েছিল পথ একদিন

সেই পথ খোয়া গেল সেও এইখানে।

নওশাদ নুরী দীর্ঘ দুই বছর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে ১৮ জুলাই ২০০০ সালে ঢাকায় গত হন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ছেলে হাইকাল হাশমিকে ডেকে বলেন, ‘শোন আমার কিছু দেনা আছে বাজারে, শোধ করতে হবে।’ ছেলে ভাবলেন না জানি কত টাকা দেনা। জানা গেল আড়াই শ টাকা, আম কিনে টাকা দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর আগে এই ছিল তাঁর পৃথিবীর কাছে ঋণ। তবে আমাদের তিনি ঋণী করে গেছেন। কবি শব্দের একটি অর্থ জ্ঞানী। সেই জ্ঞানেই তিনি জানতে পেরেছিলেন যে একদিন পৃথিবী তাঁর ঋণ স্বীকার করবে। সেই ইঙ্গিত নওশাদ নুরী রেখে গেছেন ‘কথিত আছে’ নামের কবিতায়:

পবিত্র গ্রন্থের মতো পৃথিবীতে এসেছি নেমে

...

আমাকে সামলে রেখো দুর্লভ পাণ্ডুলিপির মতো

ভবিষ্যতে ইতিহাসবিদেরা খুঁজে ফিরবে আমায়

যন্ত্রণাক্লিষ্ট এই কালের না বলা সকল সত্য

পাবে প্রকাশ শুধু আমার মাঝে।