
একজন বোহেমিয়ান কবি হয়েও আমার বাবা বেলাল চৌধুরী ভীষণ করে সংসারী হয়েছিলেন আমাদের নিয়ে।
সংসারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের কত কিছু বিসর্জন দিয়েছিলে তুমি, তা এখন উপলব্ধি করি।
তোমার কাছাকাছি অসাধারণ একটা আনন্দময় শৈশব ও কৈশোর কেটেছে আমার, প্রতীক, পাবলো—আমাদের ভাইবোনের। ঘরভর্তি কত শত দারুণ সব বই, কত নামকরা গুণী মানুষের সমাগম, কত আজব সব চরিত্রের মানুষ, মুহূর্তেই কত মজার অদ্ভুতুড়ে গল্পের আসর-জমানো! ‘সপ্তরত্নের কাণ্ডকারখানা’ বইটা উৎসর্গ করেছিলে তোমার প্রিয় তেইশ রত্নকে। কুমির নিয়ে ছিল তোমার কত যে গল্পের ঝাঁপি। নাবিক হবার শখ ছিল।

আমি স্কুলের বই খুলতে কোনো আগ্রহ পেতাম না।
আর যখন হাতের কাছে পরে থাকে ‘টিনটিন’, ‘দেশ’ পত্রিকার শেষের পাতায় ‘অরণ্যদেব’, শারদীয় ‘দেশ’, ‘আনন্দমেলা’য় প্রোফেসর শঙ্কু, সন্তু ও কাকাবাবুর রোমাঞ্চকর সব গল্প , তখন কারই-বা ভালো লাগে স্কুলের বই পড়তে! এসবের সঙ্গে আমাদের সোনালি বেড়ে ওঠা তো তোমারই সূত্রে বাবা।
তোমার প্রিয় কলকাতা থেকে ফিরতে যখন তুমি, একটা গন্ধ লেগে থাকত, ব্যাগ থেকে বের হতো বই আর বই, বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকার সঙ্গে জবাকুসুম, বরোলিন, স্যানডাল উড সাবান, পিয়ার্স সাবান। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাতে প্রতুলের দরদি কণ্ঠে ‘আমি বাঙলায় গান গাই’, ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো’; শুনে তখন হেসে গড়াগড়ি...অনেক পরে এই গান এখনো যতবার শুনি, ততবার আমার গায়ে, প্রাণে কাঁটা দেয়, প্রেরণা জোগায়।
আতাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে কতবেল খুঁজেছি ...ম্যাজিকের মতো তুমি ওই মুহূর্তে তা এনে দিয়েছ...পুরান ঢাকায় প্রেসের কাজে গেলে নিয়ে আসতে পুরোনো খবরের কাগজের ছোট প্যাকেটে একটু শক্ত টাইপের মজার শনপাপড়ি, বাখরখানি।
তোমার কাছে শুয়ে সুকুমার রায়ের সমগ্রটা কতবার শুনেছি, কত হাসির ছড়া বলতে, আর সাতসকালে ঘুম ভাঙত রেডিওর তীব্র যান্ত্রিক গোলযোগের আওয়াজসহ আকাশবাণীর খবর ও রবীন্দ্রসংগীতে।
তোমার দেওয়া উপহারগুলো আমাকে চমৎকৃত করত বরাবর। ছোটবেলায় একটা কাপড়ের তৈরি পাহাড়ি মেয়েপুতুল এনেছিলে আমার জন্য, যদিও পুতুল নিয়ে খেলার মতো মেয়ে বাচ্চা ছিলাম না আমি।
আধঘণ্টার মধ্যে সেটা ভেঙে ফেলেছিলাম। অনেক দিন পর, দূরের এক দেশে, একটা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ছোটবেলার ওই পাহাড়ি পুতুলটার কথা মনে পড়াতে তোমাকে ফোনে বলেছিলাম...তারও বছর দুয়েক পর যখন তোমার সঙ্গে দেখা হলো, কী যে অবাক হয়েছিলাম...কোত্থেকে একটি পাহাড়ি মেয়েদের মালা জোগাড় করেছিলে আমার জন্য। আর সঙ্গে করে এনেছিলে রবীন্দ্র রচনাবলির সেট ।

তোমার সেলাই করা ছায়াটা আজ নিরুদ্দেশে হাওয়ায় হাওয়ায়...আমি পুরানো বইয়ের দোকানে ঘুরতে যাই তোমার গন্ধ পাব বলে।
একটা সময় তোমার লেখা কবিতাগুলো পড়ে কিছু বুঝতাম না, তুমি চলে যাবার পর আমি আশ্চর্য এক রসায়নে যেন তোমার কবিতাগুলো এখন বুঝি।

আরও বেশি আশ্চর্য হই এগুলো আমার বাবার লেখা বলে।
কী আশ্চর্য উপহার রেখে গেছ বাবা!
সবাই বলে, ২৪ এপ্রিল নাকি তোমার দ্বিতীয় প্রয়াণবার্ষিকী, বাবা। মিথ্যা বলে তারা, বাবাদের কখনো প্রয়াণ হয় নাকি?
লেখক: কবি বেলাল চৌধুরীর কন্যা, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।