বিরল গবেষক ভূঁইয়া ইকবাল

সম্প্রতি মারা গেছেন গবেষক ভূঁইয়া ইকবাল। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা

ভূঁইয়া ইকবাল (২২ নভেম্বর ১৯৪৬—২২ জুলাই ২০২১)

অধ্যাপক ভূঁইয়া ইকবাল ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী। তবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার বেশ কিছুকাল আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁর সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস পরিবারের সম্পর্ক ছিল বেশ গভীর। অধ্যাপক ইউনূসের ছোট ভাই অকালপ্রয়াত সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ছিলেন আমার বন্ধু। তাঁর সূত্রেই অধ্যাপক ইকবালের সঙ্গে আমার আলাপ ও পরিচয় ১৯৬৯ সালে। তখন তিনি দৈনিক পাকিস্তান–এ (পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলা) সাংবাদিকতা করতেন।

অধ্যাপক ভূঁইয়া ইকবাল জীবনের প্রথম দিকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর মনোযোগ ছিল গবেষণার দিকে। প্রকাশনার ব্যাপারেও তিনি আগ্রহী ছিলেন। স্কুলজীবনেই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে প্রকাশ করেছিলেন একটি সাহিত্য পত্রিকা। সেই সময়েই তাঁর সঙ্গে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্​র সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই গবেষণামনস্কতার জন্যই অধ্যাপক আনিসুজ্জান তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। এই পদটিকে তিনি নিছক চাকরি হিসেবে গ্রহণ করেননি, মনোযোগ দিয়েছিলেন সত্যিকার গবেষণায়। প্রথমেই ভারতের কলকাতায় গেলেন পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণার জন্য। অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের উপন্যাসে সমাজচিত্র’। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রচিত এই অভিসন্দর্ভের বৈশিষ্ট্য ছিল তথ্য আহরণ ও সন্নিবেশের পারঙ্গমতা। পরবর্তী গবেষণাগুলোতেও দেখা গেছে, তথ্য অনুসন্ধানে ভূঁইয়া ইকবাল ছিলেন বেশ নিষ্ঠ ও পরিশ্রমী। এরপর তিনি একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। সেটি হলো সিলেকশনস ফ্রম দ্য মুসলমান (১৯০৬-১৯০৮)। মৌলভি মুজিবুর রহমান সম্পাদিত দ্য মুসলমান-এ বিশ শতকে বাঙালি ও ভারতীয় মুসলমানদের জীবন ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। স্মরণীয়, বিশ শতকের গোড়ার দিকে বঙ্গদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে মুসলমানরা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মুসলমান সমাজের জীবন ও চিন্তার প্রতিফলনের জন্য দ্য মুসলমান পত্রিকা তখন বেশ সমাদৃত হয়েছিল। দ্য মুসলমান-এ প্রকাশিত রচনা, সম্পাদকীয় ও বিভিন্ন মতের প্রতিফলনে উদ্​ঘাটিত হয়েছে তৎকালীন মুসলমানদের শিক্ষাচিন্তা, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সংহতি-প্রয়াস, শিক্ষার ভাষা-মাধ্যম, ধর্মীয় চিন্তার পার্থক্য ও বিরোধ, জমিদারদের অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে প্রজাদের প্রতিরোধ ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, বিনয় ঘোষ উনিশ শতকের বেশ কয়েকটি ইংরেজি সাময়িকপত্রের রচনার সংকলন করেছিলেন কয়েক খণ্ডে। মুসলমানদের জীবনচিত্র সেই সংকলনগুলোতে অনুপস্থিত। সেদিক থেকে ভূঁইয়া ইকবালের এই কাজটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব কী ছিল, বিষয়টি অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। এই নিয়ে নানা বিতর্ক ও বিভ্রান্তিও আছে। এই নিয়ে ভূঁইয়া ইকবাল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করেছেন। বিশিষ্ট মুসলমানদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের সংকলন রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র–তে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও মনোভাবের পরিচয় মেলে। বিশ্বভারতী থেকে বেশ কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে মুসলমানদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ পাওয়া যায় না। সেই দিক থেকে ভূঁইয়া ইকবালের এই পত্র-সংকলন রবীন্দ্র মানসের এক অনুদ্​ঘাটিত দিক উন্মোচন করেছে আমাদের সামনে। এই নিয়ে তিনি আরেকটি বড় কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ শিরোনামে। লেখক তাঁর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান সমাজের যোগাযোগ ও সম্পর্কের খতিয়ান তৈরির প্রয়াস এই বই।’ বলা যায় এই খতিয়ান তৈরির কাজ তিনি বেশ যোগ্যতার সঙ্গেই করেছেন। এই বইতে সংকলিত হয়েছে মুসলমান প্রসঙ্গে এবং মুসলমান সম্পাদিত সাময়িক পত্রে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের রচনাদি, কবির উদ্দেশে লেখা মুসলমানদের চিঠিপত্র, মুসলমানদেরকে উপহৃত রবীন্দ্র-কবিতা, মুসলমানদের প্রতি লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির যোগাযোগের তথ্যাদি, রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে রচিত মুসলমানদের কবিতাসহ আরও অনেক বিষয়। বাংলা ভাষায় আরবি-ফার্সি শব্দের প্রয়োগ, শিক্ষাভাবনা, শিক্ষার ভাষা-মাধ্যম, মুসলমানদের বিভিন্ন গ্রন্থ ও রচনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার পরিচয় আমরা এই সংকলনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় এই বইতে সংকলিত কয়েকজন মুসলমান লেখকের রচনায়। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভূঁইয়া ইকবালের আরেকটি বই বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা।

ভূঁইয়া ইকবাল বেশ কয়েকটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্বাচিত রচনা: আবুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আনিসুজ্জামান: সংবর্ধনা স্মারক, সমাজ ও সংস্কৃতি: আনিসুজ্জামানের সম্মানে প্রবন্ধ সম্ভার, শামসুর রাহমান: নির্জনতা থেকে জনারণ্যে। জীবনী রচনায়ও তিনি বেশ উৎসাহী ছিলেন, কাজ করেছেন বুদ্ধদেব বসু, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আনোয়ার পাশা, শশাঙ্ক মোহন সেন ও স্যার আজিজুল হকের জীবন নিয়ে। একালের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণা হয়ে থাকে সাধারণত চাকরি ও পদোন্নতির প্রয়োজনে; ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ব্যতিক্রম তো প্রচলিত নিয়ম নয়। এ ক্ষেত্রে ভূঁইয়া ইকবালের গবেষণা উদ্যমকে ব্যতিক্রমই বলা যেতে পারে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও তিনি গবেষণায় ব্রতী ছিলেন। মৃত্যুর আগেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অপ্রকাশিত গদ্য রচনা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই নিয়ে কাজ করছিলেন।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ভূঁইয়া ইকবালের বইয়ের প্রচ্ছদ

নিজে তো গবেষণায় ব্রতী ছিলেনই, অন্য গবেষকদেরও সাহায্য করতেন অনেকটা অযাচিতভাবে, নিজের তাগিদে। কোনো তথ্য বা বই কোনো গবেষকের প্রয়োজন হতে পারে মনে করলে, নিজেই সেই তথ্য বা বই সংগ্রহ করতেন সংশ্লিষ্ট গবেষকের জন্য। অন্যের বই প্রকাশের ব্যাপারেও উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের অভিসন্দর্ভ দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটেরেরি রাইটিংস প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনিই।

ভূঁইয়া ইকবাল দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলা সাহিত্য সমিতি’র সম্পাদক ছিলেন। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি সমিতি থেকে অধ্যাপক আবদুল করিম সম্পাদিত নাসির উদ্দীন খোন্দকারের শরীয়তনামা ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আঠারো শতকের বাংলা চিঠি নামে দুটো বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেন। বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি পদাধিকারবলেই বাংলা সাহিত্য সমিতির সভাপতি হন। তাঁর সভাপতিত্বকালে সাহিত্য সমিতি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের নামে দুটি স্মারক বক্তৃতার প্রচলন করে। বাংলাদেশ ও বিদেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এই স্মারক বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। প্রতিবছর এই স্মারক বক্তৃতা দুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে তা আর অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।

বাংলা বিভাগের অবসর গ্রহণের পর ভূঁইয়া ইকবাল কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করেন। জাদুঘরের প্রথম কিউরেটর জনাব শামসুল হোসেনের অবসর গ্রহণের পর এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। ভূঁইয়া ইকবাল তাঁর স্বল্প সময়ের দায়িত্বকালে জাদুঘরের কর্মকাণ্ডকে আবার সক্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন।

ভূঁইয়া ইকবাল বেশ কিছুদিন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সুপ্রভাত–এর সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করতেন। এই পাতার জন্য বিষয়বস্তু ও লেখক নির্বাচনে তাঁর বিবেচনাবোধ ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁর যোগ্য সম্পাদনার কারণে সুপ্রভাতের সাহিত্য পাতা হয়ে উঠেছিল দেশের দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেরা। এর আগে তিনি দৈনিক পূর্বকোণ–এর সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করতেন। তখনো তাঁর সম্পাদকীয় নিষ্ঠা ও যোগ্যতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন।

আমরা উল্লেখ করেছি, গবেষণার ব্যাপারে তাঁর তথ্যনিষ্ঠা ছিল অসাধারণ। এই ব্যাপারে তিনি পুলিন বিহারী সেনকে আদর্শস্থানীয় মনে করতেন। নিজের কাজের ব্যাপারে তিনি কখনোই উচ্চকিত ছিলেন না, নীরবেই কাজ করে গেছেন। আজ যখন তাঁর কাজের খতিয়ান নিতে চেয়েছি, তখন দেখছি তিনি কাজ করেছেন অনেক। গবেষণার রসদও সংগ্রহ করেছেন বিপুল। তাঁর গবেষণাকাজ ও সংগৃহীত তথ্য উপাদান ভবিষ্যতের গবেষকদের অনেক প্রয়োজন মেটাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। গবেষণাকাজের জন্য ভূঁইয়া ইকবাল বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও বাংলাদেশ লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তবে তিনি কাজ করে গেছেন নিজের তাগিদেই কোনো রকম স্বীকৃতি-সম্মানের প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষা না করেই। এ রকম গবেষক এখন বাঙালিদের মধ্যে সত্যিই বিরল।