মত মতান্তর

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯–১৭ আগস্ট ২০০৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯–১৭ আগস্ট ২০০৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলাম। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠিনি, ব্যাধির থাবা যে ক্ষত রেখে দিয়েছে আমার শরীরে, তার দাগ থেকে হয়তো এ জীবনে কখনো মুক্ত হব না আর। লেখালেখি থেকে, নানাবিধ সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে যত দূর সম্ভব নিজেকে সরিয়ে রেখেছি শারীরিক কারণে। মাঝেমধ্যে পদ্য লিখি; কারণ, না লিখে পারি না। কবিতার কচ্ছপ-কামড় থেকে মুক্তি নেই। সাপ্তাহিক দেশবন্ধু নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকতা থেকেও, বলা যেতে পারে, আমি বিচ্ছিন্ন। তাই গদ্য লেখা বহুদিন থেকে বন্ধ।

এমনিতেই আমি কুড়ের বাদশা, অসুখ আরও বেশি আলসে করে তুলেছে আমাকে। এখন আমার অধিকাংশ সময় বিছানায় শুয়ে-শুয়ে, প্রায় কিছুই না করে মাঝে-সাঝে বই পড়ে কাটে। আমার এই বিবরবাস থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন ঢাকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ইউনুস এবং এই পত্রিকারই নির্বাহী সম্পাদক ও যশস্বী কবি নির্মলেন্দু গ​ুণ। তাঁদের লাগাতার তাগিদেই কলামিস্ট হিসেবে কলম ধরতে হলো। কোনো কোনো পাঠক আমার কলাম পড়তে আগ্রহী—এ কথাও তাঁরা জানালেন। আমাকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই যে তাঁরা এ কথা বলেছেন, তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। এঁদের দুজনের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। এক নৌকার যাত্রী হিসেবে নির্মলেন্দু গ​ুণের সঙ্গে আমার বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। আর আমার কলামের পাঠক যদি একজনও থাকেন, তাঁর ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানানো আমার অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করি।

কথাপ্রসঙ্গে নির্মলেন্দু গ​ুণ বলছিলেন, আপনার প্রথম কলামটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখুন না। পনেরোই আগস্ট এসে পড়েছে, তাই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখলে সেটি সময়োপযোগী হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনি কখনো কিছু লেখেননি, এ কথা অনেকে বলে থাকেন। দু-একটি কবিতা যা লিখেছেন, তা-ও সরাসরি কিছু নয়, তাঁকে আড়ালে-আবডালে রেখে লেখা।বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক মহান পুরুষ, আমার মতো নগণ্য মানুষ তাঁর বিষয়ে কিছু বলুক আর না–ই বলুক, তাতে তাঁর কিছু এসে–যায় না। ইতিহাসের কণ্ঠে চিরদিন উচ্চারিত হবে তাঁর কথা। যত দিন বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড ভূপৃষ্ঠে টিকে থাকবে, তত দিন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন জনচিত্তে। সময়ের ধুলো তাঁর ভাবমূর্তিকে অনুজ্জ্বল করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

যা হোক, আমি শেখ মুজিব সম্পর্কে কখনো কিছু বলিনি, এ কথা ঠিক নয়। অন্তত চারটি কবিতা লিখেছি, যেগুলোর কেন্দ্রবিন্দু হলেন তিনি। তা ছাড়া একাধিক সাক্ষাৎকারে তাঁকে নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য গড়ে উঠেছে। তবে সেই বক্তব্য, কবুল করি, খুবই সংক্ষিপ্ত। এই কলামে যা লিখব, তা-ও দীর্ঘ হবে না। হয়তো আমার এই সামান্য লেখা তাঁর মতো অসামান্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের প্রতি সুবিচার করতে অসমর্থ হবে। তাঁর প্রতি সুবিচার করার জন্য একজন নিরপেক্ষ, মেধাবী, বিশ্লেষণধর্মী ঐতিহাসিকের প্রয়োজন। বিতর্কিত লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী, যিনি অসাধারণ পণ্ডিত এবং ইতিহাসের তুখোড় ছাত্র, বলেছেন, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ঐতিহাসিকই সেরা ইতিহাসবেত্তা। আমি ইতিহাসবেত্তাদের পায়ের কাছে বসার যোগ্য নই। তাই কোনো ঐতিহাসিক পুরুষ সম্পর্কে কোনো গভীর সুদূরপ্রসারী বক্তব্য পেশ করতে পারব না। আমার মন্তব্য ভাসা-ভাসা হতে বাধ্য। তবে এ কথা বলতে পারি, আমার মতামত ভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু অসততার আঁচলধরা হবে না। আমি যা বিশ্বাস করি, তা-ই বলতে চেষ্টা করব।

বঙ্গবন্ধুকে কখন প্রথম দেখি? যদ্দূর মনে পড়ে, বহু বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁকে প্রথম দেখি। তখন কী একটা আন্দোলন চলছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাইস চ্যান্সেলর জেনকিন্সের ভবন ঘেরাও করেছিলেন উত্তেজিত ছাত্ররা। সেই ছাত্রদলে আমিও ছিলাম। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দীর্ঘদেহী, কান্তিমান, তেজি ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রদের ধাওয়া করেছিল অশ্বারোহী পুলিশ বাহিনী। আমি একটা হৃষ্টপুষ্ট কালো ঘোড়ার নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। শেখ মুজিবকে দ্বিতীয়বার দেখেছিলাম সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনে। রিকশায় যাচ্ছিলেন তিনি, তাঁর পরনে খদ্দরের গৈরিক পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা এবং কাবুলি চপ্পল। তাঁর সহযাত্রীটিকে শনাক্ত করতে পারিনি। এক পলকের জন্য তিনি তাকিয়েছিলেন আমার দিকে; নিশ্চয়ই চিনতে পারেননি, চেনার কথাও নয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

তৃতীয় এবং শেষবারের মতো তাঁকে দেখেছিলাম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে, গণভবনে। আমরা দৈনিক বাংলার কর্মীরা দল বেঁধে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম আমার বন্ধু মরহুম হাসান হাফিজুর রহমান ও আবদুল তোয়াব খানের চাকরির তদবির করার উদ্দেশ্যে। তাঁরা দুজনই চাকরি খুইয়েছিলেন দৈনিক বাংলা থেকে সরকারবিরোধী একটি বিলম্বিত টেলিগ্রাম প্রকাশের অপরাধে। আমি দূরে বসে ছিলাম অনেকের সঙ্গে, সেখান থেকে লক্ষ করছিলাম বঙ্গবন্ধুকে। তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান হয়েছেন। হাসান হাফিজুর রহমান ও আবদুল তোয়াব খানকে চাকরিতে পুনর্বহাল করার আবেদন তাঁকে জানানো হয়েছিল। সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। ইচ্ছে করলে তিনি তাঁদের আরও কঠোর শাস্তি দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তাঁদের ভালো চাকরিতে নিয়োগ করেছিলেন। এই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাতেই বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের এক বিশেষ দিক ফুটে উঠেছে বলে আমি মনে করি।

তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ করার সুযোগ আমার কোনো দিন হয়নি। দূর থেকেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেছি। ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাসী নই। ফলে, তিনি ভালো কাজ করলে প্রশংসা করেছি যেমন, তেমনি তাঁর কোনো কাজ সমর্থনযোগ্য মনে না হলে সমালোচনা করেছি। তবে তিনি যে অত্যন্ত বড় মাপের মানুষ ছিলেন, বাঙালি জাতির বরণীয় নেতা ছিলেন, তিনি না হলে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূর্যোদয় অনেক পিছিয়ে থাকত, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অসামান্য হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন, ফলে শত্রুকেও হাসিমুখে ক্ষমা করতে পারতেন। কারা তাঁর মিত্র আর কারা শত্রু, এটা সব সময় ঠাওর করতে পারতেন না। কিছু কিছু ভুল তিনি করেছেন, যার খেসারত তাঁকে এবং বাঙালি জাতিকে দিতে হয়েছে, হচ্ছে, হবে। এই খেসারতের গতি কবে রুদ্ধ হবে, জানি না।

এ দেশের জনসাধারণ তাঁকে ভালোবাসতেন, তাঁকে তাঁরা বসিয়েছিলেন তাঁদের হৃদয়ের রাজাসনে। পৃথিবীর কম নেতার ভাগ্যেই এমন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা জোটে। তাঁর জনপ্রিয়তায় এ দেশের বর্ষীয়ান নেতাগণও (মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নন) ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন বলে আমার মনে হয়। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে শেখ মুজিবের একটি নিবিড় ও কৌতূহলোদ্দীপক সম্পর্ক ছিল। কে না জানে শেখ মুজিবকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিল, তখন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এ দেশের জনগণ কারার লৌহ কপাট ভেঙে ফেলে লোপাট করে বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। দুঃখের বিষয়, প্রশাসক হিসেবে এই জনগণের কাছ থেকেই তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়েই আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী কুচক্রীর দল এবং তাদের এদেশীয় স্যাঙাৎরা মহান নেতা শেখ মুজিবকে সপরিবারে নিহত করে।

অনেকে মনে করেন, বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে এবং বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে শেখ মুজিব ভুল করেছিলেন (আমি তাঁদের একজন), যখন বাংলাদেশের সাংবাদিকগণ দলে দলে বাকশালে সোৎসাহে যোগ দিচ্ছিলেন, তখন স্বল্পসংখ্যক সাংবাদিকের মতো আমিও সেই হট্টরোলে শামিল হইনি। এমনিতে বাকশাল একটি মৃদু বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। কিন্তু তখন সেই পদক্ষেপ ছিল বেখাপ্পা এবং সময়ের অনুপযোগী। আপনারা লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই, কোনো কোনো মুজিববিদ্বেষী লেখকও বাংলাদেশের স্থপতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাকশালের প্রশংসা করেছে। আজকাল কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে অনেকেরই কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই, এমনকি, আমার ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন, কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধারও নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র—এই চার মূলনীতিকে ভিত্তি করেই যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বাঙালি জাতি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এ কথা কি আমরা সব সময় মনে রাখি? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই এই চার নীতি। দুঃখের বিষয়, শেখ মুজিবকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই নিহত করা হয়েছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই চার নীতিকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবন থেকে, যার পরিণাম ভয়াবহ। এ দেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বাংলাদেশকে ‘বাংলাস্তানে’ পরিণত করে চলেছেন বিলকুল পাকিস্তানি কায়দায়। এই কায়দার কলকবজাগুলোর কথা, আশা করি, সচেতন পাঠকদের খুলে বলতে হবে না।

৯ আগস্ট ১৯৮৮

সংগ্রহ ও ভূমিকা: হাসান হাফিজ

শোকের মাস আগস্ট। এ মাসের ১৫ তারিখে যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদিন, তেমনি দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুদিবস ১৭ আগস্ট। ২০০৬ সালের এই দিনে মারা গিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শামসুর রাহমানের অনুরাগ ছিল সুবিদিত। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন একাধিক কবিতা, গদ্যও।

১৯৮৮ সালের আগস্ট সংখ্যায় (১১ বর্ষ, ২৮ সংখ্যায়) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি বিশেষ আয়োজন করে শফিকুল ইসলাম ইউনুস সম্পাদিত সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকা। এখানে ‘মত মতান্তর’ নামে কলাম লিখতেন শামসুর রাহমান। ১২ আগস্ট প্রকাশিত পত্রিকাটির ওই কলাম তিনি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। এ কলামের আলাদা কোনো শিরোনাম নেই এবং কলামের নিচে রচনাটি লেখার তারিখ দেওয়া আছে ৯ আগস্ট ১৯৮৮। তখন ঢাকা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গ​ুণ। সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকের অনুরোধে শামসুর রাহমান ওই কলাম লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ঢাকা এখন দৈনিক পত্রিকা। আর কবির অগ্রন্থিত এই লেখা সম্পাদকের সৌজন্যে পাওয়া। লেখায় সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।