মধ্যযুগে বর্ষ আরম্ভে খাজনা আদায়ের কথা

মধ্যযুগে মোগল সম্রাট আকবর যখন ‘ইলাহি সন’ ঘোষণা দিলেন, তখন থেকে কখন, কীভাবে আদায় করা হতো খাজনা? আকবরনামার সূত্রে জানা যাক সেই কাহিনি।

আকবরের সময় ‘ইলাহি’, ‘বাংলা’, ‘ফসলি’, ‘বিলায়তি’ ও ‘আমলি’ সন প্রবর্তিত হয়েছিল। এই অব্দ প্রবর্তনের কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, রাষ্ট্র শাসনে মুসলমান শাসকেরা হিজরি সন ব্যবহার করতেন। হিজরিতে চাঁদের মাস ও বর্ষ অনুসরণ করা হয়। চাঁদের বর্ষ সৌরবর্ষের চেয়ে প্রায় ১১ দিন কম। সৌরবর্ষ ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ফলে চাঁদের মাসগুলো প্রতিবছর প্রায় ১১ দিন ঋতুচ্যুত হয়। কিন্তু ফসল উৎপাদিত হয় সৌরবর্ষ অনুযায়ী। সৌরবর্ষের মাসগুলো নির্দিষ্ট ঋতুতে সংঘটিত হয়ে থাকে। তাতে ফসল তোলার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা হিজরি তারিখ অনুযায়ী বিঘ্ন ঘটত। সুতরাং হিজরি তারিখ অনুযায়ী কৃষকদের খাজনা পরিশোধেও অসুবিধা হতো। এ জন্য আকবর হিজরি বাতিল করে সৌরবর্ষ মানের অব্দ ইলাহি প্রবর্তন করেন। বাংলা সনও এই কারণে প্রবর্তিত হয়। কিন্তু এই বিবরণ যে একেবারেই ঠিক নয়, সেটাই এ লেখায় বর্ণনা করব।

ইলাহি সন প্রবর্তনের জন্য আকবরনামায় প্রকাশিত আকবরের ‘ফরমান’ দিয়েই বিষয়টি শুরু করা যায়। ফরমানের অংশবিশেষ অনুবাদ করলে নিম্নরূপ হয়:

‘ইতিমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে আমাদের যা জ্ঞাত করা হয়, তা হলো, “প্রত্যাদিষ্ট কারোরই এটা অজানা নয় যে একটা নবযুগ বা অব্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ও ঘটনাবলি সবার কাছে যেন সহজবোধ্য হয় এবং কেউ যেন সেসব পরিবর্তন করার অবকাশ না পায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: কোনো ব্যক্তি যদি চার বছর চার মাসের চুক্তিতে কোনো ব্যবসা বা সম্পত্তির মালিকানা অর্জন অথবা ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করে, আর যদি তাদের উভয় পক্ষের কাছে ওই চুক্তি আরম্ভ করার সঠিক দিন-তারিখ জানা না থাকে, তাহলে ওই চুক্তি শেষ করার চূড়ান্ত তারিখ নির্ণয় করা তাঁদের পক্ষে কষ্টকর তো বটেই, এমনকি অসম্ভব হয়ে পড়বে’’।’

ফরমানের ভাষ্য অনুযায়ী দেখা যায়, হিজরি চান্দ্রবর্ষ মানের অব্দ বলে সে অনুযায়ী খাজনা আদায়ে অসুবিধা হওয়ায় সম্রাট আকবর সৌরবর্ষ মানের অব্দ প্রচলন করেছিলেন বলে যা বলা হয়, তা সঠিক নয়। ফরমানে খাজনা আদায়ের অসুবিধার কথা একেবারেই বলা হয়নি। কিন্তু সমস্যা হলো না কেন?

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালে, যেখানে বাংলা সন আর বাংলা পঞ্জিকা রাষ্ট্রীয়ভাবেই স্বীকৃত। এখানে বাংলা সন আর বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী ভূমির রাজস্ব আদায় হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং সেটা হচ্ছেও। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানে বাংলা সন আর তার পঞ্জিকার কোনো সরকারি স্বীকৃতি ছিল না। তবু সে সময়ও খাজনা আদায় হয়েছে বাংলা বর্ষ আর বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী। ব্রিটিশ যুগের সূর্যাস্ত আইনে চৈত্র মাসের শেষ দিনে সূর্যাস্ত হওয়ার আগেই জমিদারকে প্রতিশ্রুত খাজনা অবশ্যই পরিশোধ করতে হতো, না হলে জমিদারি নিলাম হয়ে যেত। সুতরাং ব্রিটিশ আমলেও জমিদারেরা দেশীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করত। ব্রিটিশ যুগের ভূমিসংক্রান্ত দলিলেও বাংলা বর্ষ আর তারিখের ব্যবহার হতে দেখা যায়।

মধ্যযুগ বা মুসলিম যুগের খাজনা আদায়ের কোনো রশিদ এখন টিকে নেই। তাই সেটা বুঝতে সাহায্য নিতে হবে সরকারি ভূমি হস্তান্তর দলিলের। সেখানে সরকারি সন হিজরির তারিখই ব্যবহার করার কথা। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ বসুর বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস–এ উল্লেখিত শিবরাম চক্রবর্তী কুতুব খাঁর নিকট যে ২০ বিঘা জমি ব্রহ্মোত্তর পেয়েছিলেন, তার পাট্টায় আছে ১০৪৭ বাংলা সনের ১লা ফাল্গুনের তারিখ। ১৯৯১ সালে জ্যোতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত পুরোনো বাংলা দলিলপত্রে ১৬৩৮-১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের মোট ১১৯টি চিঠি ও দলিলের পাঠ মুদ্রিত হয়েছে। এখানে ১৭ শতকের ২৫টি দলিল রয়েছে। তার মধ্যে ৫টি পরগনাতি, ২টিতে বাংলা ও পরগনাতি এবং বাকি ১৮টিতে বাংলা সনের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ দেখা যায়, মোগল আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন প্রচলিত থাকলেও ভূমিসংক্রান্ত দলিলে দেশীয় অব্দ আর পঞ্জিকার তারিখই ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং খাজনা আদায় যে দেশীয় অব্দ আর পঞ্জিকার মাস অনুযায়ীই সম্পন্ন হয়েছিল, তাতে সন্দেহ থাকে না। এর সমর্থনে মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল-এর একটি কবিতার অংশবিশেষ নিম্নে উল্লেখ করা যায়:

সব প্রজাগণ মিলি করয়ে বিচার

কলিঙ্গ রাজার ঠাঞি না পাব নিস্তার॥

বুলান মণ্ডল সনে জত প্রজাগণ

বিরলে বসিয়া সভে করে নিবেদন॥

এ দেশে শত নাঞি চাস নদীকূলে

হাজির সকল শস্য বরিষার কালে॥

মসাত করিল রাজা দিয়া খাট দড়ি

প্রথম আঘানে চাহি তিন তেহাই কড়ি॥

(‘মসাত’ শব্দের মানে হলো পরিমাপ। সূত্র: গৌতম ভদ্রের মুঘলযুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক-বিদ্রোহ, কলকাতা, ১৪২০)।

এখানে দেখা যায়, রাজা প্রথম অগ্রহায়ণে কড়িতে খাজনা দেওয়ার জন্য প্রজাকে বলে রাখছেন। বলা দরকার, তখন অগ্রহায়ণে ঘরে ফসল তোলা হতো। কৃষকের হাতে টাকাপয়সা থাকত। তাই অগ্রহায়ণেই খাজনা আদায় করা হতো। সে কারণে সরকারিভাবে হিজরি ব্যবহৃত হলেও খাজনা আদায়ে কোনো অসুবিধা হয়নি। আর তারই প্রতিফলন দেখা যায় আকবরনামায় প্রযুক্ত মোগল সম্রাট আকবরের ফরমানে। হিজরি সন প্রচলিত থাকায় কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ে অসুবিধা হচ্ছিল বলে কোনো কিছুরই উল্লেখ সেখানে নেই। অথচ চান্দ্রবর্ষ মানের অব্দ হিজরি ব্যবহারে খাজনা আদায়ে অসুবিধা হচ্ছিল বলে আকবর সৌরবর্ষ মানের অব্দ ‘ইলাহি সন’ প্রবর্তন করেছিলেন, এমন সব কথা নানাজনই লিখে গেছেন এবং এখনো অনেকে লিখছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে যার কোনো ভিত্তি নেই।

মধ্যযুগে জমিদারেরা খাজনা আদায়ের জন্য যে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান করতেন, সেটা হতো পয়লা বৈশাখে (ড. আবদুল করিমের মুর্শিদকুলী খান ও তাঁর যুগ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং ভারতজুড়ে খাজনা আদায় হতো স্থানীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী। মাঠে যাঁরা ফসল ফলাতেন, তাঁরা হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় স্থানীয় পঞ্জিকার তারিখ অনুযায়ী ফসল উৎপাদন করে এসেছেন। আর তাঁরা এটা শিখেছিলেন প্রকৃতির পাঠ থেকে। হিজরি পঞ্জিকার তারিখের সঙ্গে ওই প্রকৃতির পাঠ মেলানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে এ ব্যাপারে তাঁরা প্রচলিত পঞ্জিকাই অনুসরণ করেছেন এবং সরকারও সেই পঞ্জিকা অনুযায়ীই তাঁদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করেছে। তাই সংগত কারণেই রাষ্ট্রীয় হিজরি পঞ্জিকা খাজনা আদায়ে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বলে চিহ্নিত হয়নি। বস্তুত খাজনা আদায়ের ব্যাপারে ওই পঞ্জিকার কোনো ভূমিকাই ছিল না।

তাহলে ওই সব মনগড়া কথা লেখা হয় কেন? এর কোনো জবাব নেই।