মানুষ কেন প্রেমের উপন্যাস পড়ে

বিশ্বজুড়ে প্রেমের উপন্যাসের বাজারমূল্য ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। সেই সূত্রে বলা যায়, বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রেমের উপন্যাস পড়ে। প্রেমের উপন্যাস পড়ার পেছনে পাঠকের কী কী কারণ রয়েছে, তা জানাচ্ছেন শাকের এহসান

যত দিন পৃথিবী থাকবে, তত দিন প্রেমের গল্প-উপন্যাস থাকবেছবি: কবির হোসেন

সারা বিশ্বে প্রেমের উপন্যাসের বাজারমূল্য কত জানেন? ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার! এ সংখ্যাই বলে দিচ্ছে, কত বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রেমের উপন্যাস পড়ে। প্রেম এমনই এক চিরন্তন ও শ্বাশত অনুভূতি যে এর আবেদন কখনো শেষ হয় না। সভ্যতা উন্নত হলো, গুহা ছেড়ে লোকালয়ে এল মানুষ, শহর-নগর-বন্দর স্থাপন করল—কত বদল ঘটল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের, তবু প্রেমের অনুভূতির কোনো বদল হলো না। মানুষ যখন লিখতে শেখেনি, তখন মুখে মুখে বলে গেছে প্রেমের গল্প। তারপর যখন লেখার কৌশল আবিষ্কার করেছে, তখন থেকে লিখে যাচ্ছে প্রেমের গল্প ও উপন্যাস, যে ধারা অদ্যাবধি চলমান। ধারণা করা যায়, যত দিন পৃথিবী থাকবে, তত দিন প্রেমের গল্প-উপন্যাস থাকবে। লাইলি-মজনু, রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনি তো সেই অমর প্রেমেরই উপাখ্যান, আজও যা মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

আপনি যদি সর্বকালের সেরা দশটি উপন্যাসের তালিকা করেন, সেখানে অন্তত পাঁচটি প্রেমের উপন্যাস থাকবে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক তালিকায় দেখা গেছে, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দশটি উপন্যাসের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে রয়েছে, ভ্লাদিমির নবোকভের ললিতা, গুস্তাভ ফ্লোবার্টের মাদাম বোভারি, ডিএইচ লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিস লাভার, জেন অস্টেনের প্রাইড অ্যান্ড প্রিজুডিস, লিও তলস্তয়ের আনা কারেনিনা, বরিস পাস্তেরনাকের ডক্টর জিভাগো ইত্যাদি।

এ তো গেল বিদেশি উপন্যাস। এখন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের দিকে তাকান—কপালকুণ্ডলা, চোখের বালি, শেষের কবিতা, শ্রীকান্ত, দেবদাস, পুতুলনাচের ইতিকথা, কবি, শবনম, ন হন্যতে, রাত ভ’রে বৃষ্টি, নবনী। সবই তো প্রেমের উপন্যাস।

প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন প্রেমের উপন্যাস পছন্দ করে? জনপ্রিয় মার্কিন লেখক ও ব্লগার এমিলি সিনক্লেয়ার মন্টেগু বলেন, প্রেমের উপন্যাস মানুষকে আলাদা এক অনুভূতি দেয়। এই অনুভূতি জীবনের সঙ্গে সংযোগ ঘটায়। মানুষ প্রবৃত্তিগতভাবেই আবেগপ্রবণ। আর প্রেমের উপন্যাস মানুষের যাবতীয় আবেগ নিয়েই নাড়াচাড়া করে। সে জন্য পৃথিবীব্যাপী প্রেমের উপন্যাসের এত কদর।

প্রেমের উপন্যাসের ক্ষেত্রে আরও একটি ব্যাপার ঘটে। প্রতিটি মানুষের ভেতরে থাকে অজস্র অব্যক্ত কথামালা। প্রেমের উপন্যাস সেই কথামালাকে শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করে। পাঠক যখন সেই লেখা পড়েন, তখন মনে করতে থাকেন, ‘আরে!, এ তো আমারই কথা!’ প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ অনুভূতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে প্রেমের উপন্যাসের। তাই প্রেমের উপন্যাস এত জনপ্রিয়, বলেছেন এমিলি।

প্রেমের উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে বিদেশি লেখক এমিলি সিনক্লেয়ার মন্টেগু যে ধারণা পোষণ করেন, প্রায় একই রকমের বক্তব্য বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনেরও। সাপ্তাহিক সাময়িকীর এক সাক্ষাৎকারে একসময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা প্রেম ও ভালোবাসাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে এসেছি। তা হলো নারী-পুরুষের সম্পর্ক। নারী-পুরুষের মনোদৈহিক সম্পর্ক। যেখানে মনও আছে, শরীরও আছে। এই ব্যাপারটাকে আমরা আসলে সাহিত্যে স্পর্শ করার চেষ্টা করি।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ‘স্পর্শ করা’ ব্যাপারটি সবচেয়ে সফলভাবে প্রয়োগ করা যায় প্রেমের উপন্যাসগুলোর ক্ষেত্রেই।

নারীরা প্রেমের উপন্যাস বেশি পড়েন—এমন একটি কথার প্রচলন আছে পৃথিবীজুড়েই। ব্রিটিশ লেখক জেসিকা আভেরিকে একবার এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি ভীষণ অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিলেন। রেগেমেগেই বলেছিলেন, ‘একটি অযৌক্তিক প্রশ্ন।’ পরে অবশ্য মাথা ঠান্ডা করে বলেছেন, ‘নারীরা প্রেমের উপন্যাস বেশি পড়েন—কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। আদতে নারীরা প্রকৃতিগতভাবেই একটু আবেগপ্রবণ। তাই ভালোবাসা, রোমাঞ্চ, কল্পনা, সম্পর্ক, সুখবিলাস—এসব তাঁদের বেশি টানে।’ হয়তো এ জন্যই প্রেমের উপন্যাস নারীর বেশি পড়ার কথাটি বাজারে বড়ভাবে চাউর হয়েছে।

তবে পুরুষেরা যে প্রেমের উপন্যাস পড়েন না, এমন নয়। এস্কোয়ার সমায়িকীর সহকারী সম্পাদক আদ্রিয়েনে ওয়েস্টেনফেল্ড এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যত রোমান্টিক উপন্যাস লেখা হয়, তার ১৮ শতাংশ পড়েন পুরুষ পাঠকেরা। ওই একই প্রতিবেদনেই ‘দ্য বুকসেলার’ ওয়েবসাইটের গবেষণার বরাত দিয়ে আদ্রিয়েন লিখেছেন, প্রেমবিষয়ক উপন্যাসের যত ই-বকু প্রকাশিত হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ ডাউনলোড করেন পুরুষ পাঠক। তাঁর মতে, সহধর্মিণী, সম্পর্ক, যৌনতা, প্রেম, বান্ধবী, অবৈধ সম্পর্ক, বহুগামিতা, বৈচিত্র্যময় ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়ে পুরুষের আগ্রহ প্রচুর। এ কারণে প্রেমের উপন্যাস পুরুষ পাঠকের কাছে বরাবরই সমাদৃত ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছে যে কিশোর বা কিশোরী, তারা কি প্রেমের উপন্যাস পড়ে না? সুনির্দিষ্ট গবেষণা না থাকলেও বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পাঠকদের দিকে তাকালে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে বিপুলসংখ্যক কিশোর–কিশোরীও প্রেমের উপন্যাস পড়ে। হুমায়ূন আহমেদের মেঘ বলেছে যাব যাব কিংবা তেঁতুল বনে জোছনা বোধকরি বাঙালি কিশোর-কিশোরীদের সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস। উথালপাতাল প্রেমের অনুভূতিতে পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এ দুই উপন্যাস।

প্রেম নিয়ে মানুষের আকুলতার শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ ভাষায়, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।’ তারপরও মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে। প্রেম-ভালোবাসা তার প্রবৃত্তির অন্তর্গত বলেই শেষমেশ নির্মলেন্দু গুণের কবিতার সুরে সুরে মানুষ বলতে পারে, ‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে/ মন বাড়িয়ে ছুঁই,/ দুইকে আমি এক করি না/ এককে করি দুই।’ তাই মানুষের ভেতরে যত দিন প্রেমের অনুভূতি থাকবে, তত দিন প্রেমের উপন্যাস জনপ্রিয়ই থাকবে—এ কথা হলফ করে বলা যায়। পৃথিবীতে উথালপাতাল জোছনা নামবে, আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি ঝরবে কিংবা একাকী বিষণ্ন বিকেল চুপচাপ মিলিয়ে যাবে দিগন্তে, অথচ কোনো পাঠক হৃদয়ে প্রেম অনুভব করবেন না, প্রেমের গল্প-উপন্যাস পড়বে না, তা কী আর হবে!

সূত্র: মিডিয়াম, বুকরায়ট, বুকসেলার, এস্কোয়ার