মুখোমুখি বসিবার ডট ডট ডট...

আজ জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুদিন। এ লেখায় আছে তাঁর প্রতি এ সময়ের একজন কবির অনুভব।

কোলাজ
মনিরুল ইসলাম

‘তারপর থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার ডট ডট ডট’—   বাকিটা না বলে একটুখানি থামলেন কবি হুমায়ুন ফরীদি। হুমায়ুন ফরীদি কি কবি? অভিনেতা, সেটা সব্বাই জানে কিন্তু তিনি কবি? কেউ কেউ জানেন। যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি, সে সময়কার কিছু সংকলনে তাঁর কবিতা মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়।
যশোর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক লাইব্রেরির ভেতরের দেয়ালে দেখেছিলাম, অনেক কবির দুই পঙক্তি করে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড ঝুলছে। নব্বইয়ের দশকের প্রকাশিত কবি টেড হিউজের কবিতার অনুবাদক আবেদীন কাদের বর্তমানে প্রবাসী। তিনি তাঁর হিউজ-অনুবাদের ভূমিকায় নিজের ছাত্রজীবনের কিছু কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে: মধ্যরাতে নীলক্ষেতের টলায়মান রাস্তায় আমরা প্লাথের কবিতা গলায় চড়িয়ে হেঁটে গেছি। আমি, কবি হুমায়ুন ফরীদি...এ কথা পড়ামাত্রই চমকে উঠবেন আজকের বিখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি?

জীবনানন্দ দশ
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারে মোস্তফা সর‌য়ার ফারুকীর প্রথম সিনেমা ‘ব্যাচেলর’-এর শুটিংয়ে গিয়ে আমরা ছিলাম হোটেল সি-গালে। এর বাংলা হলে হতে পারত হোটেল শঙ্খচিল! তো এক রাতে আমরা হয়তো সেই শঙ্খচিলের ডানায় ভাসছি কিংবা স্যুটে বসেই আড্ডা দিচ্ছি সারা রাত প্রায় মিলিয়ে যাওয়া একদার কবি ও বাংলাদেশে সবাই চেনেন, এমন অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে। সে রাতে আড্ডায় আছেন তিনজন—হুমায়ুন ফরীদি ছাড়া আমি ও মারজুক রাসেল। মারজুক রাসেল তখন কবিজীবনের মহাসড়কে হেঁটে হেঁটেই সদ্য অন ক্যামেরা অভিনয় শুরু করেছে। সেই রাতে চাঁদ ছিল সমুদ্রের আকাশে। সি-গালের এই স্যুট থেকেই ফরীদি একবার নোটিশ করলেন। তবে চাঁদ ছিল, মেঘও ছিল। বরং মেঘই ছিল বেশি। অন্ধকার ছিল। অন্ধকারকে ইংরেজিতে বলে ব্ল্যাক। কোনো একটা স্তরে যাওয়ার নাম লেভেলে যাওয়া। ব্ল্যাক কি কোনো লেভেলে নিয়ে যায়?

বরিশালে জীবনানন্দ দাশের বাড়ির প্রবেশপথ
ছবি: সংগৃহীত

তো ফরীদির সঙ্গে সারা রাত আড্ডায় কত কথাই হচ্ছিল। উঠল কবিতার কথা। আমি আবেদীন কাদেরের টেড হিউজ কবিতার অনুবাদের ভূমিকাই ফরীদি সম্পর্কে যা লেখা, বললাম। আমার স্মৃতি কিছু ঝাপসা হয়ে যেতে পারে, মারজুকের কিছু মনে থাকবে। সেখানে ওই আড্ডায় ফরীদি ভাই বললেন, ‘শুধু বনলতা সেন শব্দ দুইটা উঠিয়ে দাও। দেখো, তোমাকে কোথায় নিয়ে যায় জীবনানন্দ দাশ।’
বললাম, ‘বনলতা সেন উঠিয়ে দিলে কী দাঁড়াচ্ছে?’
ফরীদি বললেন, ‘উঠিয়ে নতুন শব্দ বসাও না! আগে বসাও, তারপর চোখ বুজে একবার ভাবো। তারপর বলো এর চেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন আর হয় কি না!’

‘তারপর থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার ব্ল্যাকলেভেল। এই তো। হুম, সাউন্ড গুড।’
‘শুধু সাউন্ড?’
‘সাউন্ড-কম্পাউন্ড সব গুড। যদি জীবনানন্দ দাশ এই পঙক্তির কপিরাইট আমাদের দেন আর কি। নইলে বনলতা সেনের বদলে ব্ল্যাকলেভেল—এনার্কির একটা মাত্রা থাকা উচিত।’

ব্ল্যাকলেভেল। কালোস্তর। জীবনানন্দ দাশ।
দীননাথ বাংলা কবিতার প্রতি কি ভালোবাসা কমে যাচ্ছে?
মোটেও না, মোটেও না। আরও বাড়ছে। বন্যার পানি যেমন বাড়ে, নদী উপচে ঢুকে পড়ে জনপদে। জীবনানন্দ দাশ সেই রকম করে ঢুকলেন বাংলা কবিতায়। বাংলা কবিতাই তাঁকে আজও অতিক্রম করে যায়নি। আর পরবর্তী কবিরা এখনো জীবনানন্দের বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে এক বেলা না খেয়ে কেউ উঠতেই পারেন না।

হুমায়ুন ফরীদি, যিনি বলেছিলেন, ‘তারপর থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার ডট ডট ডট...’
ছবি: অন্য আলো

দুই
বরিশালে জীবনানন্দ দাশের বাড়ি দেখতে বরিশালে গেছি। ব্রজমোহন কলেজের বিস্তীর্ণ ক্যাম্পাস। এই কলেজে দাশবাবু পড়তেন ও পরে পড়াতেন। কলেজ ক্যাম্পাসে একটি ক্যানটিন দেখেছি, নাম—‘জীবনানন্দ ক্যাফে’। এরপর দেখতে গেলাম যে বাড়িতে কবি জন্মেছিলেন, বড় হয়ে উঠেছিলেন কবি কুসুমকুমারী দাশের কোলে, সেই বাড়ি। না, হতাশ হতেই হয়, আমিও হয়েছি। সেই বাড়ি আর নেই। সেই সময়টায় তো নেই। দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা-উৎপীড়ন—কতভাবেই না বদলে গেছে কাঠামো। ‘অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল’ জানি, কিন্তু সেই রোদ আর নেই। জীবনানন্দ দাশের বাড়িটারও রূপান্তর ঘটেছে। কবি হেনরী স্বপন আমাকে একটি নতুন বিল্ডিং দেখাল, ‘এইডা হইতেছে মনু জীবনানন্দ দাশ পাঠাগার।’
‘অফিস খোলা হয়? পাঠক আসে?’
‘অফিস তো মাঝেমদ্যি ওরা খোলেই, নইলে অগো কামডা কী? অবশ্য অগো তো বেতন-টেতনও তেমন নেই। যা হয় আরকি, বুঝিসই তো!’
‘তাইলে ধানসিড়ি নদীটা কোথায়?’
স্বপন বলল, ‘ব্যাডা, ধানসিড়ি তুই এইহানে পাইবি কই? ওইডা তো পড়ছে ঝালুকাঠির মদ্যে। বরিশালে আইসোস ব্যাডা, কীর্তনখোলারে দেইখা যা।’

কীর্তনখোলা দেখে বনলতার টানে গিয়েছিলাম নাটোরও। ‘নাটোরের বনলতা সেন’ একটা মানদণ্ড, এখন। সেটা ‘বনলতা সেন’ কবিতাসূত্রেই। জীবনানন্দ দাশ গণ থেকে বিচ্যুত—এই অমূলক ধারণার অবসান হয়েছে আগেই। নাটোরের পরিত্যক্ত রাজবাড়ির ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল, দাশবাবু কি এখানে এসেছিলেন? ‘বনলতা সেন’ কি ফাঁকা মাঠের মধ্যে মনে মনে স্বরচিত ইমারতখানি? জীবনানন্দ দাশ কি অশোকের ধূসর জগতে? লিখেছেনই তো, ‘সেখানে ছিলেম আমি’।—মালয় সগরের তীরে তিনি হেঁটেছেন? এভাবে জিজ্ঞাসা ছুড়লে স্বভাবতই তো প্রশ্ন চলে আসবে, যে মহাজাগতিক জার্নির মধ্যে তিনি ছিলেন, যে গ্রহ-নক্ষত্রে তিনি পরিভ্রমণ করেছেন, দার্শনিকভাবে যে সংকটের মধ্যে পড়েছেন—আমরা সেই সব ভাবব, নাকি পড়তে থাকব—‘সাতটি তারার তিমির’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’, ‘মাল্যবান’, ‘কারুবাসনা’...?

জীবনানন্দ দাশ পাঠাগারের বর্তমান অবস্থা
ছবি: সংগৃহীত

তাই দেখতে গিয়েছিলাম শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার রাস্তায় চলা ট্রামগাড়ি। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তিনি ২২ অক্টোবর প্রয়াত হলেন। ১৪ অক্টোবর তিনি চলন্ত ট্রামের সামনে পড়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়তে পড়তেও আবার ধাক্কা খেলেন; এবং অক্টোবরের ২২ তারিখটি আমাদের মুখস্থ হয়ে গেল। ট্রামের মতো এমন শ্লথ গতির যানবাহনে আর দ্বিতীয় কেউ মারা গেছে—এমনটা আমার জানা নেই। কলকাতায়, বাংলা আকাদেমির মধ্যে ‘জীবনানন্দ সভাঘর’-এ কবিতা পড়ছিলাম। পাশেই বসা ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। কলকাতা জীবনানন্দকে হয়তো বিকশিত করেছিল, কিন্তু মেরেও তো ফেলেছিল।

কবি বিয়ে করেছিলেন ঢাকায়, ইডেন কলেজের স্বদেশি করা মেয়ে লাবণ্যকে। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল পুরান ঢাকার এক ব্রাহ্মমন্দিরে, সেই মন্দিরটি আজও আছে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রতাপশালী কবি জীবনানন্দ দাশ। ঢাকায় এই কবির নামে তেমন কোনো স্থাপনা চোখে পড়েনি আমার। ঢাকায় তাঁদের বিয়ে হয়েছিল, লাবণ্য পড়তেন ইডেনে—ব্যস, এটুকুই। কবির কি সেদিনই মৃত্যু রচিত হয়েছিল, যেদিন এমন একজন ‘অন্য স্তরের’ মানুষের সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে হলো! বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের চাপ কি জীবনানন্দ নামের একটি শালিক পাখি নিতে পারে?
এই কবি, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতাকে এমন একটা স্তরে তুলে দিয়ে গেলেন, তা আর অতিক্রম করতে পারল না বাংলা ভাষা স্বয়ং। জানি না সেটাই ভেবেই হুমায়ুন ফরীদি সেদিন বলেছিলেন কি না, ‘তারপর থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার ডট ডট ডট...’

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]