মুজিবের কলকাতা, কলকাতার মুজিব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান কলকাতা শহরে। সেখানেই তিনি বাংলার বৃহত্তর রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল হাশিমদের মতো চিন্তানায়কদের সান্নিধ্যে আসেন।
১৯৪২ সালে উচ্চমাধ্যমিকে পাঠ গ্রহণের জন্য কলকাতায় আসেন বঙ্গবন্ধু। ভর্তি হন বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে, যা বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু মাঝের এই চারটি বছর ছিল তাঁর জীবনের খুবই ঘটনাবহুল সময়। এর বিস্তারিত বর্ণনা তিনি লিখেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর দীর্ঘ অবস্থিতির জন্য তাঁর আর কলকাতা যাওয়া হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার পথে হয়তো যাত্রাবিরতি দিয়েছেন কখনো-সখনো।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরছিলেন, সে সময় তাঁর সফরসূচিতে কলকাতায় যাত্রাবিরতির কথা ছিল। কিন্তু সময়স্বল্পতার জন্য সেটা তা হয়নি। তবে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় নগরীতে তিনি আবার আসবেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় আসেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর আগমন উপলক্ষে ওই দিনই অধুনালুপ্ত কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিক সুশীল মিত্র দারুণ একটি প্রতিবেদন লেখেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক, সহপাঠী ও কর্মচারীদের স্মৃতিচারণা ছিল। ৫০ বছর পর ওই লেখাটি জয়দীপ দে তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জয়’ বইয়ে সংকলিত করেন। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য সেই মূল্যবান প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস মনিরুল ইসলামমনিরুল ইসলাম

এই কলকাতা, সেই আপনি। কতকাল পরে। তবু এই কলকাতা আপনার কত চেনা। আপনি বঙ্গবন্ধু, কলকাতা আপনাকে পরমাত্মীয়ের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। রাত্রির তপস্যা শেষে আপনি সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছেন, এই উপমহাদেশের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা আপনাকে বীরের সম্মান জানাতে উদ্‌গ্রীব। স্বাধীনতাকামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা ও রূপ দিয়েছেন আপনি। সংগ্রামের পীঠস্থান কলকাতা আপনাকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে গর্বিত।

এই শহর কলকাতার সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতা সেদিন গভীর ছিল। এর রাস্তাঘাট, মহল্লা, ময়দান, এর মানুষ, মিছিল—সবকিছুই সেদিন আপনাকে আকর্ষণ করেছিল। তখন আপনার বয়স নবীন, কলকাতার মেজাজকে আপনি সেদিন সহজেই আপনার করে নিতে পেরেছিলেন।

সেদিনের কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসের সেশনে আপনি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন সে কলেজের নাম ছিল ইসলামিয়া কলেজ। এখন এর নাম হয়েছে মৌলানা আজাদ কলেজ। সেদিন যাঁরা আপনার শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের অনেকের মুখই আজ আপনি কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে দেখতে পাবেন না। তাঁদের কেউ কেউ কলেজ থেকে বিদায় নিয়েছেন, কেউ কেউ দুনিয়া থেকেই। আচ্ছা, অধ্যাপক তায়েবকে আপনার মনে আছে? তাঁর কাছে আপনি ইংরেজির ক্লাস করেছেন। অধ্যাপক তায়েবজি এখন কলকাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তাঁর কিন্তু আপনাকে বেশ মনে আছে।

মনে পড়ে আপনার?
সেদিন কলেজে আপনারই সতীর্থ ছিলেন। তাঁরও নাম মুজিবুর রহমান। মৌলানা আজাদ কলেজে তিনি এখন ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রবীণ অধ্যাপক। এক বছর নয়, দুবছর নয়, ২৫/৩০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু আপনার অনেক কথাই তাঁর স্মৃতিপটে আজও উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। সেদিনকার ওয়েলেসলি স্ট্রিটের আজ অবশ্য নামবদল হয়েছে। আজ তা রফি আমেদ কিদোয়াই রোড। ওয়েলিংটন স্কয়ারের মোড়, সে তো বলতে গেলে আপনার কলেজের দোরগোড়াতেই। তারও অন্য নাম হয়েছে, এখন তার নাম রাজা সুবোধ মল্লিক স্কয়ার। আড়াই দশক আগে, কলকাতার রসিদ-আলী-দিনের কথা মনে আছে? সকাল থেকেই আপনি ব্যস্ত। ঘুম ভাঙার পর থেকেই আপনি হোস্টেলে হাজির। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, প্রোগ্রাম করে দিচ্ছেন।

কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
ছবি: সংগৃহীত

সেখান থেকে কলেজে। রাস্তাটা পার হয়েই কলেজের লাল কাঁকরের পথ। চওড়া কয়েকটা ধাপ। তার ওপরে দাঁড়িয়ে আপনি কত বক্তৃতা দিয়েছেন। পরনে পাজামা, পাঞ্জাবি বা কোর্তা। রোগা, ছিপছিপে, চোখমুখে দুর্জয় সাহসের ছাপ। সেদিন রসিদ-আলী-দিনে আপনার নাবার-খাবার ঠিক ছিল না। ছাত্ররা সেদিন এই শহরকে অনন্যরূপে প্রকাশ করেছিল। একদা আপনার সতীর্থ, অধ্যাপক রহমান আপনাদের দেখেছেন। ছাত্রদের মিছিলের পর মিছিল, তারপর আরও মিছিল, অগুনতি, অসংখ্য, যেন শেষ নেই। আপনি সেদিনের ওয়েলিংটন স্কয়ারের চৌমাথার কাছে দাঁড়িয়ে। বেলা তখন একটার কাছাকাছি। আপনার সঙ্গে আপনার নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আপনার অনেককালের বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা জহীরুদ্দিন এবং কামাল। আপনারা তখন ছাত্রদের মিছিল দেখছিলেন।

কলকাতায় বঙ্গবন্ধু যে কলেজে পড়তেন, সেই বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজ এখন মৌলানা আজাদ কলেজ
ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক রহমানের আরও মনে আছে, হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনে ছাত্রনেতা হিসেবে আপনার শরিক হওয়ার কথা। ছাত্র মিছিলে নেতৃত্ব করার কথা, গ্রেপ্তার হওয়ার কথা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন আপনি বহু মিছিল ময়দানে মনুমেন্টের ধারকাছ দিয়ে নিয়ে গেছেন। সেদিনকার অক্টারলোনি মনুমেন্ট আজ শহীদ মিনার। সেদিনকার ডালহৌসি স্কয়ারে অভিযান করার পথে এখন রানি রাসমণি রোড ধরে যে পথটা চলে গেছে, আগে রাস্তাটার একটা বিদেশি নাম ছিল। রানি রাসমণি রোড বরাবর এগিয়ে এলে আপনি দেখতে পাবেন আপনার প্রিয় নেতা নেতাজির স্ট্যাচু। আপনি যে বিদেশি মূর্তি সেদিন দেখতেন, তা আজ অপসারিত। ডালহৌসি এখন বিনয়-বাদল-দীনেশবাগ।
কলেজে সেদিন এমন ছাত্র আন্দোলন ছিল না, যাতে আপনি নেতৃত্ব দেননি, যার পুরোভাগে আপনি ছিলেন না। অধ্যাপক রহমান এখনো বেশ মনে করতে পারেন, কলেজের ইউনিয়নের পরিচালনায়, ইউনিয়নের ভোটাভুটি—সর্বত্রই আপনি। সেদিন আপনি ছাড়া কলেজে যেকোনো অনুষ্ঠানের অঙ্গহানি ঘটত বলে অধ্যাপক রহমানের মতো সেদিনকার অনেক সতীর্থই মনে করতেন। ইউনিয়নের ভোটযুদ্ধের সময় আপনার বক্তৃতা কত জোরালো ছিল। বিরুদ্ধপক্ষকে আক্রমণ কত তীক্ষ্ণ ছিল। কিন্তু সে পর্ব শেষ হলেই, আপনি দল-মতনির্বিশেষে সব ছাত্রকে জড়ো করতেন। সবাইকে বলতেন, আরে ওসব তো এখন মিটে গেছে, আসলে আমরা সবাই ভাই ভাই, সবাই আপনা-আপনি।

পুরো একটা যুগ আপনি এই শহরে কাটিয়েছেন, কলকাতায়ই আপনার পাবলিক লাইফের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে। আপনি এই শহরের ধ্যান, ধারণা এবং মেজাজের সঙ্গে পরিচিত। তাই অনেককাল পরে কলকাতা তার পরমাত্মীয়কে ফিরে পেয়েছে। কলকাতার পথ-ঘাট-মহল্লা-পাড়া আপনার জয়ধ্বনিতে মুখরিত।

কিন্তু কলেজে ক্লাসের বাইরে সাইক্লোনের মতো আপনার এই জীবনে বাড়ির যত্ন ও শান্তি দেওয়ার লোকও এই শহরে ছিল। মোসলেম ইনস্টিটিউট হলের সামনাসামনি গির্জার কথা আপনার মনে পড়ছে তো? তারই প্রায় গা ঘেঁষে ৮ নম্বর স্মিথ লেনে বেকার হোস্টেলে আপনি ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কাটিয়ে গেছেন। ২৭ নম্বর যে ঘরে আপনি থাকতেন, সেখানে প্রায়ই ছাত্রদের মজলিশ বসত। আরও একটি লোকের নিশ্চিত উপস্থিতি নিশ্চয় লক্ষ করতেন। সেই গোলাম রসুল যেদিন জানতে পেরেছেন যে আপনি কলকাতায় আসছেন, সেদিন থেকেই তাঁর মুখে একমাত্র বুলি, আপনি যদি একবার আসতেন, তাহলে কলেজের অনেকের সঙ্গে গোলাম রসুলও একবার আপনাকে দেখতেন। গোলাম রসুলকে একবারও দেখতেন! গোলাম রসুলকে আপনার প্রিয় খাবার জিলাপি-শিঙারা-কলা আনতে বাইরে কতবার যেতে হতো! আপনাকে সেবা করতে, যত্ন করতে তার সেদিন এতটুকু কার্পণ্য ছিল না। আজ তাকে সবাই বড় মিঞা বলে। গেঞ্জি আর লুঙি আর কোমরে গামছা বাঁধা সে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কত মমতা নিয়ে এসব কথা ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলছিল।

কলকাতার বেকার হোস্টেল। কলকাতায় এখানে ছিলেন বঙ্গবন্ধু
ছবি: সংগৃহীত

পুরো একটা যুগ আপনি এই শহরে কাটিয়েছেন, কলকাতায়ই আপনার পাবলিক লাইফের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে। আপনি এই শহরের ধ্যান, ধারণা এবং মেজাজের সঙ্গে পরিচিত। তাই অনেককাল পরে কলকাতা তার পরমাত্মীয়কে ফিরে পেয়েছে। কলকাতার পথ-ঘাট-মহল্লা-পাড়া আপনার জয়ধ্বনিতে মুখরিত।