‘মেঘদূত’ ও প্রসঙ্গত
‘কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত প্রদোষে, বরষে
কোন পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত।’
রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘মেঘদূত’ কবিতাটি শুরু হয়েছে এইভাবে। এই যে কবিতাটির শুরুতেই কবি পয়লা আষাঢ়ের কথাটি নিয়ে এলেন, এর তাৎপর্য কী? পয়লা আষাঢ়ের সঙ্গে কালিদাসের লেখা ‘মেঘদূত’–এর ঠিক সম্পর্কটা কোথায়? রবীন্দ্রনাথের কবিতার ওই অংশটুকু পড়ে মনে হয় যেন আষাঢ়ের প্রথম দিবসেই ‘মেঘদূত’ লেখা শুরু ও শেষ হয়েছিল, বাস্তবে তা আদৌ নয়। কবিতাটির গঠনবিন্যাস, ছন্দ, ভাষা ইত্যাদি বিচার করে অনায়াসেই বলা যায়, কম–বেশি পাঁচ শ পঙ্ক্তি রচনায় কালিদাসকে হয়তো ব্যয় করতে হয়েছে কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর লাগাও খুব একটা অবাক হওয়ার ব্যাপার নয়। তা ছাড়া এ কাব্য রচনা পয়লা আষাঢ় অথবা আদৌ আষাঢ় মাসে লেখা শুরু হয়েছিল কি না, সেটাও স্থির করে বলা যাবে না। তাহলে ‘মেঘদূত’ এবং আষাঢ়ের প্রথম দিন, সম্পর্কটি কোথায়?
আছে এবং তা নিবিড়ভাবেই আছে। কিন্তু সেটা জানার আগে ‘মেঘদূত’ এবং তার রচয়িতা কালিদাস সম্পর্কে খানিক অবহিতি জরুরি। আমরা বরং সেই পর্বটি সেরে নিই।
রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধও কি পুনর্বিবেচনায় জীবন দিয়ে দেখা নয়? তাঁর জীবনে কাদম্বরীর মৃত্যু তাঁর নিজের ভাষাতেই ছিল ‘আত্মখণ্ডন,’ আর তাই ‘শ্যামলতমাল বনে যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলি ক্ষণে। বেদনা ছড়ায়ে আছে তারি ঘাসে। কাঁপে নিঃশ্বাসে।’ আমাদের, মনে হয়, কী জানি, হয়তো কালিদাসের ‘মেঘদূত’–এর উৎসেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কোনো বিধুর প্রতিচ্ছায়া পড়েছে কিনা।
কালিদাসও এক বিশ্বকবি, যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। এবং শেক্সপিয়ার, ওমর খৈয়াম, রুমি, গ্যেটে, কিটস বা হাফিজ। অর্থাৎ সর্বকালীন পাঠকের কাছে আবেদনসঞ্চারী প্রতিভা। কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটক সমগ্র বিশ্বে নন্দিত আজও। মহাকাব্যও লিখেছেন তিনি। রামায়ণের কাহিনি নিয়ে ‘রঘুবংশ’, ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য নিয়েও রয়েছে তাঁর ‘ঋতুসংহার’ কাব্য এবং অবিনাশী মাহাত্ম্য নিয়ে রয়েছে তাঁর ‘মেঘদূত’, নন্দনতত্ত্বের বিচারে যাকে খণ্ডকাব্য বলা হয়।
‘মেঘদূত’ কেবল এই উপমহাদেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বে আদৃত। জার্মান কবি শিলার ‘মেঘদূত’কে অনুকরণ করে কাব্য রচনা করেছেন। ‘মেঘদূত’ আবার ‘দূতকাব্য’ নামেও পরিচিত। এ কাব্যের জনপ্রিয়তা এতই উত্তুঙ্গ যে কালিদাসের অনুকরণে বহু কবি সংস্কৃত ভাষায় কাব্য লিখতে শুরু করলেন এবং সংস্কৃত ভাষায় এভাবে ‘দূতকাব্য’ ধারা গড়ে উঠল ‘হংসদূত’, ‘পবনদূত’ আরও। ‘মেঘদূত’ এতই জনপ্রিয় বাঙালি পাঠকের কাছে যে উনিশ–বিশ শতকে এ কাব্যের অনুবাদ করেন শতাধিক অনুবাদক—দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজশেখর বসু, বুদ্ধদেব বসু, পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য—এঁদের মধ্যে কতিপয় নাম। সংস্কৃত সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি সৃজনশীল রচনার (রামায়ণ–মহাভারত–শকুন্তলা–কাদম্বরী ইত্যাদি) টীকা রচিত হয়। কালিদাস রচিত ‘মেঘদূত’–এর টীকাকার ছিলেন মল্লিনাথ। নিজের সম্পর্কে তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘মাঘে মেঘে গতং ময়’। অর্থাৎ কবি মাঘ–এর (‘শিশুপালবধ’ কাব্য রচয়িতা) এবং ‘মেঘদূত’–এর টীকা রচনা করতে করতেই তাঁর আয়ু ফুরিয়ে এল। এই উক্তির মধ্যেই নিহিত আছে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ রচনা–মাহাত্ম্য।
বিষয়বস্তু কী এ কাব্যের? ‘মেঘদূত’ এক বিরহের কাব্য। স্বর্গে কুবেরের যে বাগান, তার মালি যক্ষ। বাগান পরিচর্যার কাজ করতে করতে যক্ষ স্ত্রীর কথা ভাবছিল বলে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল পরিচর্যার কাজে। কুবের খেপে গিয়ে যক্ষকে অভিশাপ দেয়, যে স্ত্রীর কথা ভেবে কাজে অবহেলা, তার সঙ্গে এক বছরের বিরহ ঘটবে তার। এই এক বছর পৃথিবীতে গিয়ে বাস করতে হবে যক্ষকে। পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট স্থানে, রামগিরিতে। রামগিরিতে নির্বাসনের বার্তায় পাঠকমনে যক্ষের বিরহবেদনাজনিত শোক দ্বিগুণ হয়ে দেখা দেয়। কেননা রামায়ণে আছে, রাম–সীতার বনবাস পর্বে এই রামগিরিবাসে তাদের কাছে অরণ্যও মধুময় হয়ে উঠেছিল। ‘ছিনু মোরা সুখে। কপোতকপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষচূড়ে। বাঁধি নীড়, থাকে সুখে,’ এই হচ্ছে রাম–সীতার রামগিরিবাসের মধুসূদনীয় ভাষ্য। সেই রামগিরিতে যক্ষের নির্বাসন, মরণের অধিক মরণ।
অতএব যক্ষের দ্রুত রামগিরিবাস। এ সময়ে যক্ষের বিরহবেদনার সামান্য অথচ খুব মরমী চিত্র এঁকেছেন কালিদাস। স্ত্রীর শোকে যক্ষের শরীরের হাল বোঝাতে গিয়ে কবি লিখেছেন, তার হাতের বালা বারবার খুলে খুলে পড়ছে। অর্থাৎ যক্ষ রোগা হয়ে গেছে। ওইটুকু বর্ণনার মধ্য দিয়ে যক্ষের পত্নীপ্রেমের গভীরতাটি অনুভব করা যায়। আর পাঠক হিসেবে মনে হয় আমাদের বৃক্ষ পরিচর্যার অবকাশে, পত্রপুষ্পফলের অনুষঙ্গে দয়িতার মুখ ভেসে আসা কী এমন অন্যায়, যেখানে বাগান পরিচর্যা রোগীকে সেবা করার মতো প্রতিমুহূর্তের যত্ন তৎপরতার কাজ নয়? কুবের কি শাস্তিদানে কঠোর নয়?
যাহোক, কান্তাবিরহে এভাবে দশ দশটি মাস কাটল। বিরহটা অনেকটা গা–সহা হয়ে এসেছিল। কবি বলেছেন, ‘বিরহ হ্যায় এক সুলতান।’ যক্ষের সুলতানিয়াত সঙ্গ কাটছিল না। কিন্তু বাদ সাধল আষাঢ়। আরও নির্দিষ্ট করে পয়লা আষাঢ়। ওই দিন বৃষ্টির ধারায় প্লাবিত হয়ে উঠল রামগিরি পাহাড় এবং ওই বর্ষার আবহেই যক্ষের এতদিনকার ছাইচাপা বিরহবেদনা কিছুতেই বাঁধ মানতে চাইল না। কালিদাস লিখেছেন, মেঘ দেখে তো সাধারণভাবেই মানুষ আকুল হয়ে ওঠে, আর যে প্রণয়ীযুগল পরস্পরের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে থাকতে অভ্যস্ত, তাদের কাছে বিরহের অভিভব কত তীব্র, জ্বালাময় আর দুর্বহ, তা সহজেই অনুমেয়। যক্ষের মনে হলো, আমি তো কায়ক্লেশে বেঁচে আছি, তা–ও কিন্তু আমার প্রিয়া, হাল কী তার? আমার কথা ভেবে ভেবে রাতের পর রাত নিদ্রাহীন পার করছে সে। আর তো দুই মাস। আমি বেঁচে আছি, এই সংবাদটি মেঘ–মারফত তাঁকে পৌঁছে দেওয়া যায় না স্বর্গের রাজধানী অলকায়, যক্ষপত্নীর কাছে?
মেঘকে দূত হতে আহ্বান জানাল যক্ষ। তাকে বাতলে দিল পথ, অলকায় যাওয়ার। এই অবকাশে কালিদাস আমাদের ভারত–মানচিত্র অবলোকন করান, সেখানকার নদ–নদী, বৃক্ষশোভা, একেক অঞ্চলের নারীদের রমণীয়তা–নান্দনিকতাসমেত। তারপর আছে স্বর্গের বর্ণনা, কল্পিত কিন্তু কী অপরিসীম কবিত্বময়, সৌন্দর্যসঞ্চারী, প্রভাময়, মরমী এবং কাব্যিক। আমরা সামান্য একটু বর্ণনা দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। অলকা স্বর্গের রাজধানী, দেবতাদের বাসগৃহ। সেখানে প্রাসাদের পর প্রাসাদ, সুশুভ্র এবং উদ্যানবহুল। ইডেন, নন্দনকানন। সেই বাগানে শুয়ে আছেন দেবাদিদেব শিব। তাঁর কপালে চাঁদ, আর সেই চাঁদের আলোয় ধৌত হয়ে যাচ্ছে দেব প্রাসাদসমূহ, আলোর শুভ্রত্বের বন্যায়। পূর্ণিমা রাতে চরাচরের জ্যোৎস্না নির্মিত হয় তিন লাখ মাইল দূরের চাঁদের আলোয়। আর এ তো এত কাছ থেকে বিচ্ছুরিত আলো।
এই যে মেঘকে দূত করে পাঠানো, এ কিন্তু অভিনব কিছু নয়। রামায়ণে হনুমানকেও দ্যৌত্য করতে দেখা গেছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, চীন দেশে মেঘদূত জাতীয় রচনা ‘মেঘদূত’–এর উৎস। কালিদাস যে চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তার প্রমাণ ‘শকুন্তলা’ নাটকে চায়নিজ সিল্কের প্রয়োগ, ‘চীনাংশুক’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে।
কালিদাস অগ্রদূত না হতে পারেন, তবে এ–কাব্যের আদ্যন্ত যে কবিত্বময়তা, যে ভাবরাজি, কল্পনার বৈভব, শব্দপ্রয়োগের মাধুর্য এবং শ্লোকের পর শ্লোকে অলংকারের দ্যুতি তা অবিনশ্বর। আজকের পাঠকের কাছেও এর আবেদন অনস্বীকার্য। কবিরা তো বটেই, অবনীন্দ্রনাথের মতো চিত্রশিল্পী, মকবুল ফিদা হুসেনের মতো চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্রকার (তাঁর ‘গজগামিনী’ ছবিতে মেঘদূত–অনুগ নায়িকার সৌন্দর্য অভিনেত্রী মাধুরীর শরীরে আরোপিত হয়েছে, কালিদাসের উদ্ধৃতিসহ) পর্যন্ত কালিদাসের এ কাব্যের কাছে ঋণী।
এতক্ষণে আশা করি পয়লা আষাঢ়ের নিগূঢ় তাৎপর্যটি ধরা গেছে। বিরহী যক্ষকে ব্যথাতুর করে তুলল বর্ষা ঋতুর প্রথম দিনটিতে। আক্ষরিক অর্থে যে পয়লা আষাঢ়েই প্রথম বৃষ্টি নামবে, তা না–ও হতে পারে। তবে যে সময়ের কাব্য এটি, পৃথিবী অনেকাংশেই প্রকৃতিবান্ধব ছিল, যে কারণে হাজার হাজার বছর ধরে নীল নদকেও দেখা গেছে মরশুম নিয়মিত মেনে চলতে। পয়লা আষাঢ়ের বারিপাতকে Poetic License রূপেও মনে করা চলে। বাংলায় একে বলে কবিপ্রসিদ্ধি। সংস্কৃত কাব্যে পাই, বকুল ফুল ফোটে নায়িকার পদাঘাতে,—কবিপ্রসিদ্ধি। কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন, ‘দৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি আগের মতো গোলাপ ফুল।’ আগে কী হতো?—কবিপ্রসিদ্ধি।
পয়লা আষাঢ়ের সঙ্গে কালিদাসের এমনই সংযুক্তি ঘটে গেছে যে এ দিনটিতে কালিদাসের জন্মদিন পালন করা হয়। তাঁর জন্ম কবে এবং কোথায়, তা অদ্যাপি অজানা, কিন্তু তাঁরই লেখার কল্যাণে ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ তাঁর জন্মদিনে পরিণত হয়ে গেল। কবিপ্রসিদ্ধি তো বলা যাবে না একে, তবে বলা যাক জনপ্রসিদ্ধি।
শেক্সপিয়ার–বন্দনায় যেমন ইংরেজ কবিরা মুখর, ভারতীয় কবিরাও কালিদাসকে নিয়ে কম প্রশস্তি রচনা করেননি। প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের মধ্যে বানভট্ট থেকে জয়দেব পর্যন্ত আছে এর তালিকা। বাংলা ভাষাতেও কবিরা বন্দনা করতে কার্পণ্য করেননি কালিদাসকে। মাইকেল মধুসূদন সনেট লিখেছেন কালিদাসকে নিয়ে, বলেছেন, ‘কবিতা নিকুঞ্জে তুমি পিককুলপতি।’ এবং ‘আপনি ভারতী....আপনার স্বর্ণবীণা অরপিলা করে।’ তা ছাড়া ‘মেঘদূত’ নামেও একটি সনেট রয়েছে মধুসূদনের। মেঘকে এই বার্তা দিতে বলছে যক্ষ, ‘কুসুমের কানে কানে মলয়, যেমতি। মৃদু নাদে, কয়ো তারে, এ বিরহে মরি!’ এ লেখায় কি মধুসূদনের কাব্যিক জীবনের ছায়াও লক্ষগোচর নয়, প্যারিসে বলে কলকাতায় থাকা স্ত্রী হেনরিয়েটার সঙ্গে বিরহের, বিধুর সুরও কি লেগে নেই এখানে?
কালিদাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ, অবহিতিও আজানুলম্বিত শ্রদ্ধা সর্বজনবিদিত।
‘শকুন্তলা’ ও ‘মেঘদূত’ নিয়ে প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর, সামান্য কিছু অনুবাদও আছে কালিদাসের রচনার। আর তাঁর কবিতা ও গানে বারবার উঁকি দিয়ে যায় কালিদাসের প্রভাব। ‘চৈতালি’ কাব্যগ্রন্থে ‘কালিদাসের প্রতি’ কবিতা আছে। কালিদাস প্রশস্তিতে তিনি লিখেছেন, কালিদাসের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে ‘কর্ণ হতে বই খুলি স্নেহ হাস্যভরে। পরায়ে দিতেন গৌরীতব চূড়াপরে।’ কবিকল্পনাটির চমৎকারিত্ব এইখানেই যে বই, অর্থাৎ ময়ূরের পালক গৌরী অর্থাৎ গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা, অর্থাৎ দেবী দুর্গা কালিদাসের মাথায় পরিয়ে দেবেন, তা তো সংগৃহীত হবে দুর্গার পুত্র কার্তিকের বাহন ময়ূরের থেকেই।
‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অপরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিরহের। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ আমাদের দেখায় কান্তা বিরহের সাময়িক অভিব্যক্তি, যার অবসান ঘটবে এক বছর পর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে শাশ্বত বিরহ, এক যুগের মানুষ অন্য যুগের মানুষ থেকে যে চিরবিচ্ছিন্ন, এই করুণতর বিধুরতার বার্তাটি দেন। তিনি লেখেন, ‘কেবল অতীত বর্তমান নহে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অতলস্পর্শ বিরহ। আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে আপনার মানসসরোবরের অগমতীরে বাস করিতেছে; সেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেখানে সশরীরে উপনীত হইবার কোনো পথ নাই।’ এর বেদনা আরও গভীর। কালিদাসের কাল, ‘মেঘদূত’–এ বর্ণিত অবন্তী বিদিশা বিন্ধ্য কৈলাস দেবগিরি উজ্জয়িনী রেবা শিপ্রা বেত্রবতী নির্বিন্ধ্যা থেকে চিরবিচ্ছিন্ন আজকের মানুষ এবং এই ব্যবধান কখনোই ঘুচবার নয়। কেননা অতীত কখনো ফিরে আসে না।
এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুলকে মনে পড়বে আমাদের, বিশেষ করে নার্গিসকে লেখা তাঁর চিঠিটির অনুষঙ্গে, যে চিঠিতে ‘মেঘদূত’–এর উল্লেখ আছে। আমরা জানি, নার্গিসের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য সম্পর্কের শুরুতেই তার ছিঁড়ে যায়। ১৯২১–এর ১৭ জুন (সে দিনটিও কি পয়লা আষাঢ় ছিল?) বিয়ের নির্ধারিত তারিখ ছিল তাঁদের। আমরা নিশ্চিত নই সে বিয়ে হয়েছিল কি না আদৌ। কিন্তু এটা ঠিক, ওই তারিখ রাতেই তিনি বিয়েবাড়ি ছেড়ে চলে যান। তার সুদীর্ঘকাল বাদে ১–৭–১৯৩৭–এ তিনি একটি চিঠি লেখেন নার্গিসকে।
চিঠির এক স্থানে আছে, ‘আষাঢ়ের ঘন মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়। এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে।’ আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি নজরুলের ব্যক্তিজীবন রবীন্দ্রনাথ–কথিত ‘আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি, সে আপনার মানস সরোবরের অগমতীরে বাস করিতেছে’,—তারই সমরেখায় অঙ্কিত। চিঠির শেষে নজরুলের যে উষ্মা, তাতেও সেই হাহাকার, সেই হৃদয়–বিদারণ ব্যক্ত, এবং সেই সঙ্গে না–পাওয়ার বেদনার দহের মধ্যেও কিছু আশ্বাসের প্রলেপ, কিছু সান্ত্বনা, কিছু স্বনির্মিত আত্মতৃপ্তি, ‘লাইলী মজনুকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারও প্রিয়তমকে পায়নি।’ এখানে যেন নব মেঘদূত পাঠ করি আমরা। মেঘদূতকে জীবন দিয়ে দেখা। এ চিঠিতে তারই নির্যাস।
রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধও কি পুনর্বিবেচনায় জীবন দিয়ে দেখা নয়? তাঁর জীবনে কাদম্বরীর মৃত্যু তাঁর নিজের ভাষাতেই ছিল ‘আত্মখণ্ডন,’ আর তাই ‘শ্যামলতমাল বনে যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলি ক্ষণে। বেদনা ছড়ায়ে আছে তারি ঘাসে। কাঁপে নিঃশ্বাসে।’ আমাদের, মনে হয়, কী জানি, হয়তো কালিদাসের ‘মেঘদূত’–এর উৎসেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কোনো বিধুর প্রতিচ্ছায়া পড়েছে কিনা।
তবে রবীন্দ্রনাথ–নজরুলের দুঃখাভিভবকে বিরহজনিত না বলে বলা উচিত বিচ্ছেদজনিত। বিরহ, সে সাময়িক। কিন্তু বিচ্ছেদ, সে তো আজীবনের। নার্গিস আর কাদম্বরী তো এক, দুই বা তিন বছরে বা সারা জীবনেও ফিরে আসেনি নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের জীবনে। সে হিসেবে কালিদাসের যক্ষ ভাগ্যবান।
বিরহী যক্ষ তার শোকব্যথার মধ্যেও দয়িতার প্রতি তার একান্ত ভালোবাসা মূর্ত করে দিয়ে গেছে। যে দয়িতার বিরহে স্বামীর হাতের বালা খসে খসে পড়ে, এমন যক্ষপ্রিয়া তো ধন্য। মর্ত্যে নারীর অভাব নেই, আর স্বর্গবাসীরা মর্ত্যে এসে পৃথিবীর নারীদের সঙ্গে প্রেম করেন, ভারতীয় পুরাণে এর উদাহরণ ভূরি ভূরি। তবু যক্ষ স্ত্রীর কাছে দূত পাঠায়, তার বেঁচে থাকার বার্তা পেয়ে স্ত্রী যেন স্বস্তি পায়। যক্ষের বিবেচনায় তার নিজের বেদনা নয়, তার স্ত্রীর উৎকণ্ঠা–উপশম। দূতরূপী মেঘকে সে যে শুভৈষা জানায়, তাতেও যক্ষের প্রেমানুভূতির আগ্নেয়তা,—তোমার সঙ্গে বিদ্যুতের যেন কখনো বিচ্যুতি না ঘটে।’ মেঘ ও বিদ্যুতের মধ্যে দয়িত–দয়িতা সম্পর্ক নির্মাণ, কালিদাস এখানেও অভিনব!