রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব বসুর কত না স্মৃতি

একসময় ঢাকা শহরের পাড়া–মহল্লার শোভা ছিল গণগ্রন্থাগার। কবি–লেখকেরা এসব পাঠগৃহকে আশ্রয় করেই বেড়ে উঠেছেন। ঢাকার শতবর্ষী তিনটি প্রাচীন গণগ্রন্থাগারের আদ্যোপান্ত

দুঁদে সাংবাদিক-লেখক সরলানন্দ সেন পরিচিত ছিলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ঢাকার চিঠির জন্য। ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো গ্রন্থাগার নর্থব্রুক হল লাইব্রেরির হাল জানিয়ে ১৯৫৩ সালের ৭ নভেম্বর কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন তিনি। ‘নর্থব্রুক হল গ্রন্থাগার প্রায় উদ্বাস্তু’ শিরোনামের ওই লেখায় তিনি জানাচ্ছেন, ‘ব্রিটিশ আমলে এই লাইব্রেরিটি বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট এলাকার বহু বিদ্যানুরাগীর প্রিয় স্থান ছিল। কয়েক শ সভ্য এর হলে ও প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে একটা জমজমাট ভাব বজায় রাখতেন। বুড়িগঙ্গার তীরে লালকুঠি ঘাটে অবস্থিত এই লাইব্রেরিতে ইনডোর গেমের ব্যবস্থাও ছিল। তারপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে এখানে একটি সরকারি অফিস স্থানান্তরিত হয়। ফলে লাইব্রেরির বইভরা আলমারিগুলো সরকারি দপ্তরের ফাইলের ধাক্কায় ছোট ঘরে ও বারান্দায় এক কোণে গিয়ে কোনো প্রকারে আত্মরক্ষা করে। লাইব্রেরির এই অসহায় অবস্থা দেখলে বিদ্যোৎসাহীদের মনে স্বতঃই ক্ষোভ সঞ্চার হয়।’

বিদ্যোৎসাহীদের এই ক্ষোভ-হাহুতাশ এখনো বিদ্যমান। ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরিটির সুসময় ছিল পরবর্তী ৫৫ বছর। ১৯২৮ সাল থেকে ৯৩ বছর ধরে মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগছে চার শ বছরের প্রাচীন রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বয়সী লাইব্রেরিটি। এর মধ্যে কত সরকার বাহাদুর এসেছেন–গেছেন। কারও বিশেষ সুদৃষ্টি এই জ্ঞানগৃহটির ওপর পড়েছে বলা যাবে না। ভবনের অবস্থা শোচনীয়, বই-পুঁথিপত্র হারাচ্ছে, চাঁদা আদায় হয় না, কমছে সভ্যসংখ্যা। অবশ্য ঢাকার বেশির ভাগ গণগ্রন্থাগারের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য।

এই লাইব্রেরিটিরই একসময় যৌবন ছিল। বিলেত থেকে আনা হয়েছিল অনেক মূল্যবান পুস্তক। রানি ভিক্টোরিয়ার চিঠি থেকে শুরু করে বিলেতের ইতিহাস, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের নানা দলিল, প্রতাপশালী ব্রিটিশ শাসকদের জীবনী, ভারতবর্ষের সীমান্ত নির্ধারণ কমিটির প্রতিবেদনসহ ইংরেজি সাহিত্যের নানা বই, দুই শতাধিক পুরোনো বাংলা বইসহ ১৫ হাজারের মতো দুর্লভ বইয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছিল এই লাইব্রেরিটি। ১৭টি কাঠের আলমারি ভরা ছিল বই। সরলানন্দ সেনের লেখায় পাওয়া যায়, ‘এই লাইব্রেরির জীবনে ১৯২৭ সালেই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি দেখা দেয়। তখন এর বার্ষিক আয় ছিল ৩ হাজার ৭শ ৫২ টাকা। বইয়ের সংখ্যা ছিল আট হাজার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় একাধিক সংগঠনের আমন্ত্রণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এলে ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে এই নর্থব্রুক হলেই সংবর্ধনা দেয় তৎকালীন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকার মানুষের পক্ষ থেকে মানপত্র দেওয়া হয়েছিল। এরপর আরও অনেক বিশিষ্ট মানুষের পদধূলি পড়েছে এই নর্থব্রুক হলে। বলা যেতে পারে, তখনকার দিনে সংবর্ধনাসহ যাবতীয় অনুষ্ঠান হতো এই হলেই।

ঢাকার প্রাণপুরুষ নাজির হোসেনের কিংবদন্তির ঢাকা এবং খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ঢাকা অভিধান থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুকের ঢাকা আগমনকে ঘিরে নির্মিত হয় একটি টাউন হল। ফরাশগঞ্জের এই টাউন হলকে নর্থব্রুকের নামে নামকরণ করা হয়। দালানটি লাল রঙের হওয়ায় লালকুঠি নামেই এটি সমধিক পরিচিত। পরবর্তী সময়ে নর্থব্রুক হলকে গণগ্রন্থাগারে রূপান্তর করা হয়।

মূল নর্থব্রুক হলটি বন্ধ আছে বহু বছর। এখানকার কিছু বইপত্র পার্শ্ববর্তী একটি ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলরের জিম্মায়। সব পুরোনো আলমারির খাঁচায় বন্দী ইতিহাসের আকর বইগুলো ইঁদুর-তেলাপোকার মধ্যাহ্নভোজ হচ্ছে সন্দেহ কী!

নর্থব্রুকসহ রাজধানী ঢাকায় তিনটি শতবর্ষী লাইব্রেরির তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুটিরই নাম আছে তবে ঘ্রাণ নেই। বাংলা অঞ্চলে প্রথম লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা যশোর ও মেদিনীপুর জেলায় ১৮৫১ সালে। এরপর ১৮৫৪ সালে বগুড়া, রংপুর, বরিশাল ও হুগলিতে। লক্ষণীয়, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা পূর্ব বাংলার সবচেয়ে বড় শহর ঢাকায় লাইব্রেরি স্থাপন না করে যশোরে করেছিলেন।

দুই.

রাজা রামমোহন রায় যে সমাজসংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার কিছুটা ঢেউ এসে পড়েছিল বাংলাদেশেও। ঢাকায় তাঁর ব্রাহ্মধর্মমতের অনুসারীরাই গড়ে তোলেন রামমোহন রায় লাইব্রেরি ও পাঠগৃহ।

১৯৫১ সালে প্রকাশিত বঙ্গবিহারী করের লেখা পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত বই থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে রামমোহন রায় লাইব্রেরি ও পাঠগৃহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাশ, ১৮৬৯ সালে। ব্রাহ্মমন্দিরের দোতলার একটি কক্ষে পাঠাগারটির সূচনা করেন তিনি। যদিও এই ভবনের গায়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সালটি লেখা রয়েছে ‘১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি’।

এর আগে ‘যদি কোনো ব্যক্তি পুস্তকালয়ের জন্য ১০ হাজার টাকা এককালীন দান করেন তবে কার্যনির্বাহক সভা ওই পুস্তকালয় তার নামে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন’—এমন একটি প্রস্তাব গৃহীত হলেও যথাসময়ে উপযুক্ত অর্থের সংস্থান না হওয়ায় কারও নামে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার আশা বাদ দিতে হয়। পাঠাগারটি ব্যক্তিগত ছোট ছোট দান এবং কিছু বই-জার্নাল সংগ্রহের মাধ্যমে একসময় বড় আকার ধারণ করে। ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য খাজা আজমও এই পাঠাগারে অর্থ দিয়েছিলেন। ১৯১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঠাগার ভবনে প্রবেশ উপলক্ষে শহরের শিক্ষিত পদস্থ ব্যক্তিবর্গকে নিমন্ত্রণ করে একটি সভার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব ও পাঠাগারটি উদ্বোধন করেন পূর্ববঙ্গের প্রথম আইসিএস, ভাইসরয় কাউন্সিলের সদস্য ও ভাটপাড়ার জমিদার স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত বা কে জি গুপ্ত। ওই সভাতেই পাঠাগারটির নাম রাখা হয় রামমোহন রায় লাইব্রেরি ও পাঠগৃহ। সে সময় পাঠাগার ভবনের সংগ্রহে ছিল ১০ থেকে ১২ হাজার বই।

কত লড়াই আর সংগ্রামের ইতিহাস এই পাঠাগারের পাতায় পাতায়। ১৯৪৭ সালেও এখানে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার। আর এখন হাজারের কম!

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবনের সবচেয়ে মধুর একটি উপলক্ষে এখানে এসেছিলেন ১৯৩০ সালের ৯ মে। লাবণ্য দাশগুপ্তের সঙ্গে এখানেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ইডেন কলেজের ছাত্রী লাবণ্য ছিলেন ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক অমৃত লাল গুপ্তের ভাইঝি। এই বিয়েতে জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দাশ, কবি বুদ্ধদেব বসু, অজিত কুমার দত্ত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিয়েতে বরিশালের ছেলে জীবনানন্দ ঢাকার মেয়ে লাবণ্যকে উপহার দিয়েছিলেন ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় থেকে কেনা একটি গোলাপি বেনারসি শাড়ি। প্রচলিত গল্পমতে, বিয়ের খাবারে কালাচাঁদ গন্ধবণিকের পরানহরা, মাওয়ার চোসিসহ অন্যান্য আইটেমের সঙ্গে নাকি ছিল জীবনানন্দের অতি প্রিয় ‘সেদ্ধ ডিমে’র ছড়াছড়ি, যা দেখে নাক কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন লাবণ্য।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দাশও। ব্রাহ্মবাদী নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকায় এসে এই লাইব্রেরিতেও এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লীলা রায়ের শ্রী সংঘের নারী সমাবেশে প্রধান অতিথি হয়ে কবিগুরু আসেন এখানে ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। ৯ ফেব্রুয়ারি কবিগুরু ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এতে স্বকণ্ঠে, স্বরচিত ব্রাহ্মসংগীত, ‘আমায় অনেক দিয়েছ নাথ, আমার বাসনা তবু পুরিল না’ পরিবেশন করেন তিনি।

এখানকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। এখানে বসে তিনি নিমগ্ন থাকতেন গবেষণায়।

পোগোজ স্কুলে কোনো আমন্ত্রণে এলে কবি শামসুর রাহমান তাঁর প্রিয় রামমোহন রায় পাঠাগারে একবার ঘুরে যেতেন। স্কুলজীবনে তিনি সাহিত্যচর্চার দরজা খুঁজে পেয়েছিলেন এ পাঠাগারে। জীবনীগ্রন্থ কালের ধুলোয় লেখায় স্মৃতির অতল থেকে কবি লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত এ গ্রন্থাগার আমার সামনে খুলেছিল আলাদা এক জগৎ। বেড়ে গেল আমার পাঠস্পৃহা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার বেশি পরিচয় তো হলোই, বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠলাম।’

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, সুফি মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামালসহ আরও অনেক খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই জ্ঞানগৃহের সঙ্গে।

রামমোহন রায় পাঠাগারে গেলে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধি রণবীর পাল তালা খুলে দিলেন। বর্তমানে ব্রাহ্মমন্দির ভবনের দোতলার একটি অংশে কোনো রকমে চালু করা হয়েছে পাঠাগারটি। কাঠের পাটাতন। পুরোনো আমলের অপ্রশস্ত খাড়া সিঁড়ি। দিনের বেলায়ও কিছুটা অন্ধকার। চার বছর ধরে এখানে পাঠাগারটি চলছে।

* নর্থব্রুক হল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা: ১৮৭৪ স্থান: ফরাশগঞ্জ ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর * রামমোহন রায় লাইব্রেরি ও পাঠগৃহ প্রতিষ্ঠা: ১৮৬৯ স্থান: পাটুয়াটুলী ১৯৩০ সালের ৯ মে এসেছিলেন জীবনানন্দ দাশ * রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগার প্রতিষ্ঠা: ১৯১১ স্থান: ফরাশগঞ্জ (প্রথমে), গোপীবাগ (পরে) বালক বয়সে এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প করা হয়েছিল পাঠাগারটিতে। এ সময় লুট হয়ে যায় এবং পুড়িয়ে ফেলা হয় শত বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগৃহীত মূল্যবান নথিপত্র, অসংখ্য সাময়িকী, দুষ্প্রাপ্য নানা বইপত্র। পাঠাগারটির দরজা-জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় লুটেরারা। স্বাধীনতার পর পাঠাগার আবার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। লুট হওয়া বইপত্র উচ্চমূল্যে কিনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রবাসী পত্রিকার দুটি কপি ছাড়া আর কিছুই ফেরত পাওয়া যায়নি। সে সময় বিজ্ঞাপন দেখে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন ওমর পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে জানান, এখানকার একটি দুর্লভ বই তাঁর হাতে এসে পৌঁছেছে। এবং তিনি সেটা পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিতে আগ্রহী। কিন্তু পাঠাগার কর্তৃপক্ষ বইটি ফেরত না নিয়ে, স্মারকগ্রন্থ হিসেবে তাঁকে উপহার দেয়।

পাঠাগারে উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে এখনো রয়েছে বিশ্ববাণী প্রকাশিত (বঙ্গাব্দ ১৩২৪) মহাভারত–এর ২১ পর্ব, বিশ্বভারতী প্রকাশিত (বঙ্গাব্দ ১৩৫০) রবীন্দ্র রচনাবলী, ব্রাহ্মধর্মভিত্তিক সব বই, রাজা রামমোহন, স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী। আছে সব ধর্মগ্রন্থ। এ ছাড়া বঙ্কিম, বিভূতি, শরৎ থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইও কিছু কেনা হয়েছে। তবে পুরোনো বইগুলোর কিছু কিছু বাঁধাই নষ্ট হয়ে পড়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

তিন.

ঢাকায় শতবর্ষী তিন পাঠাগারের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল অবস্থায় আছে গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগারটি। রামকৃষ্ণ মিশনের সহকারী সম্পাদক স্বামী স্থিরাত্মানন্দ মহারাজের সঙ্গে এই লেখকের কথা হয়েছিল করোনাকালের আগে, তাঁর অফিসে বসে। প্রসন্ন মুখে তিনি বলেছিলেন, পাঠক বাড়ার মূল কারণ এখানকার কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। অনেক পাঠক একসঙ্গে বসে বই পড়েন। আর এখানে অনেক পুরোনো ও মূল্যবান বই আছে, যা হয়তো অন্য কোথাও নেই। তাঁদের হিসাবে, বছরে প্রায় ৩৫ হাজার পাঠক পাঠাগারটি ব্যবহার করেন।

ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন ও এর লাইব্রেরি প্রসঙ্গে মুগ্ধতা প্রকাশ করে কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতিকথা আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন বইতে লিখেছেন—‘সেই বালক বয়সে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীর সঙ্গেও আমার ক্ষীণ যোগাযোগ ঘটেছিলো।...আমি যাই মাঝে-মাঝে রামকৃষ্ণ মিশনে-লাইব্রেরি থেকে বই আনতে, অন্য কারণেও। টিকাটুলীর পূর্ব প্রান্তে, শহরের বাইরে মন্দির মঠ প্রাঙ্গণ নিয়ে অতি মনোরম ও নির্জন একটি স্থান-রমনার বাইরে সারা ঢাকায় সবচেয়ে সুন্দর, আমি তখনো রমনা দেখিনি। সামনের রাস্তাটি ঘন গাছপালায় ছায়াচ্ছন্ন; ভেতরে আছে বাঁধানো দিঘি, ফুলের বাগান, হেঁটে বেড়াবার পথ অজস্র।’

১৮৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বক্তৃতার পর স্বামী বিবেকানন্দ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে বের হন। চার বছরেরও বেশি সময় ভ্রমণ শেষে কলকাতায় নিজের আস্তানায় ফিরে আসেন তিনি। ওই বছরই কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন। এ বিষয়ে বিবেকানন্দ লেখেন তার অমর বাণী, ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’

ঢাকায় রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালে ফরাশগঞ্জে মোহিনী মোহন দাশের ভাড়া বাড়িতে। সেখান থেকে বর্তমানের গোপীবাগের ঠিকানায় আসে ছয় বছর পরে, ১৯১৪ সালে। মিশনে পাঠাগার স্থাপন করেন বিবেকানন্দের শিষ্য স্বামী পরমানন্দ, ১৯১১ সালে।

পাঠাগারে ৪৭টি তাকে বইয়ের সংখ্যা কমবেশি ১৭ হাজার। কেবল সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্মের বই নয়, এখানে আছে সংগীত, আইন ও চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে প্রচুর মৌলিক বই। পড়ুয়া ও গবেষকদের জন্য যা চির–আরাধ্য। এর বাইরে বাচ্চাদের গল্প, কৌতুক, চিত্রাঙ্কন বিষয়ে বই তো আছেই। বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি ভাষারও কিছু বই এখানে আছে। আছে প্রচুর অভিধান।

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের বাসিন্দা প্রকৌশলী বি বি ভুপৎকার ১৯৫৬ সালে লাইব্রেরি ও ছাত্রাবাস করার জন্য ৭০ হাজার টাকা দান করেছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশন থেকেও মাঝেমধ্যে কিছু বই দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থাও ফি বছর তাদের নতুন বই এখানে পাঠিয়ে থাকে। কর্তৃপক্ষও কিছু কিছু করে কেনার চেষ্টা করেন। এ কারণেই সংগ্রহশালাটি এত সমৃদ্ধ আর বৈচিত্র্যপূর্ণ।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট হয়ে যায় রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগার। পরে অবশ্য সামান্য কিছু বই ফেরতও পাওয়া যায়।

ঢাকার প্রাচীন গণগ্রন্থাগারগুলো দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। কিন্তু অতি সফলভাবে আমরা আমাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পেরেছি। অবকাঠামো উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছি আমরা, কিন্তু নাগরিকের মনের অবকাঠামো বিনির্মাণে ব্যয় নিতান্তই যৎকিঞ্চিৎ। এ কারণে শতবর্ষী গণগ্রন্থাগারগুলো সম্পর্কে আমরা এখন প্রায় বিস্মৃত।