রাজসভার সাহসী কণ্ঠ ভূষণ

কবি ভূষণ
কবি ভূষণ

সিংহাসনে তখন পরম পরাক্রমশালী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। একদিন তিনি দরবারে উপস্থিত সভাকবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনাদের কবিতায় আমি চাটুকারিতা আর স্তুতি ছাড়া কিছু খুঁজে পাই না, বাস্তব অবস্থার চিত্র কেউ আপনারা কবিতায় তুলে আনেন না বা আনতে সাহস পান না।’

একজন বর্ষীয়ান কবি উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘জাঁহাপনা ঠিক বলেছেন। যে কবিতায় সমাজ-রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা ফুটে ওঠে না, সেই কবিতা আসলে কবিতা নয়। তবে আলমপনা অভয় দিলে আমি একটা কবিতা পেশ করতে চাই।’

আওরঙ্গজেব নিজের ফাঁদে নিজেই পড়লেন। ‘ইরশাদ’ বলতেই কবি যা পেশ করলেন, তাতে সভাসদসহ আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল স্বয়ং সম্রাটেরও। কবিতাটা ছিল এ রকম:

‘কী করে বলি বল

পিতা শাহজাহাঁ

কে করল কয়েদ,

একই নদীর শাখা

সহোদর দারাকে হত্যা,

কোরানের কসমে কেনা

বন্ধুত্ব মুরাদবক্সের

চুকিয়ে দিল সহসা।

ভূষণ কবি বলে—

শোনো হে, আওরঙ্গজেব

এভাবেই হলো বাদশাহ।’

(‘কি বলে কে ঠাউর বাপ বাদশাহ শাহীজাঁহা

তাকো কোয়েদ কিয়ো মানো আগি লাই হ্যায়।।

বড়ো ভাই দারা ইয়াকো পকড়ি কৈ কোয়েদ কিয়ো

মেহরূহ নদী ইয়াকো জোয়ো সগে ভাই হ্যায়।।

বন্ধু তৌ মুরাদবক্স বাঁদি চুক করবি কো

বিচ লৈ কুরআন কুদ কি কসম খাই হ্যায়।।

ভূষণ সুকবি কহৈ সুনৌ নবরঙ্গজেব

এতে কাম কিনহে ফেরি পদশাহি পাই হ্যায়।।)

ওপরের এ দুঃসাহসী কবিতার রচয়িতার নাম কবিরাজ ভূষণ। জন্ম খ্রিষ্টাব্দ ১৬১৩, মৃত্যু ১৭১৩, ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর ডিস্ট্রিক্টের বর্তমানের টিকোয়াপুরে। পিতা রত্নাকরজি নিজেও ছিলেন কবি। চার পুত্রের মধ্যে ভূষণ ছিলেন মধ্যম। ভূষণ মুলত সংস্কৃত আরবি এবং ফারসিতে তার কাব্য রচনা করেছেন। এ ছাড়া তাঁর কাব্যে ব্রজবুলি ও বুন্দেলা শব্দের সমাহার দেখা যায়।

এই কবিতা পাঠের ফলে যা হবার তাই হলো, সাম্রাজ্য থেকে তাঁকে বহিষ্কার করলেন ক্ষুব্ধ আওরঙ্গজেব। কবি ভূষণ বুন্দেলাখণ্ডের বিদ্রোহী শাসক শাহজাদী জাহানারার রাখি ভাই ছত্রসালের কাছে আশ্রয় নিলেন। এখানেই কবি ভূষণ লিখলেন ‘ছত্রসাল দশক’।

‘ইক হাড়া বুঁদি ধিনি মরদ মহেবা বাল

সালাত নৌরংজেবকো য়ে দোনো ছত্রসাল।।

ওই দেখো ছত্তা পত্তা ওই দেখো ছত্রসাল।।

ওই দিল্লি কি ঢাল ওই দিল্লি ঢাহনবাল।।’

মারাঠা বীর শিবাজির সঙ্গে দেখা করার জন্য এরপর পুনায় এলেন ভূষণ। পথে এক অশ্বারোহী যোদ্ধা তাঁর এই এলাকায় আসার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। ভূষণ বললেন, শিবাজির সঙ্গে দেখা করবেন, কবিতা শোনাবেন তাঁকে। জবাবে অশ্বারোহী বললেন, ‘শিবাজি অশিক্ষিত, কবিতার কিছু বোঝেন না, তাকে কী কবিতা শোনাতে চান কবি আপনি?’

ভূষণ আবৃত্তি করলেন সেই কবিতা—

‘যেমন ইন্দ্র জম্ভাসুরকে

আগুন সমুদ্রকে

শ্রীরাম রাবণের অহংকারকে

পবন মেঘকে

শম্ভূ রতিপতি কামদেবকে

পরশুরাম সহস্রবাহুকে,

গাছের গুড়ি দাবাগ্নিকে আটকে দেয়;

হরিণের দলকে লণ্ডভণ্ড করে চিতা

সিংহ আটকে দেয় হাতিকে ,

অন্ধকারকে আলোর একটি রশ্মি,

কংসকে দমন করেন কৃষ্ণ

ঠিক তেমনি ম্লেচ্ছ বংশকে

বশ করবেন সিংহরূপী শিবাজি।’

(ইন্দ্রোজনী জম্ভা পর বাড়বসে অম্ভা পর

রাবনসে দন্ত পর রঘুকুল রাজ হ্যায়।।

পবন বারিবহাপর শম্ভু রতি নাহ পর

তোঁ সহস্র বাহুপর রামধিজ রাজ হ্যায়।।

দাবাগ্নি মে দন্ডপর চিতামৃগ ঝুন্ড পর

ভুখান বিতুন্ডপর জৈসে মৃগরাজ হ্যায়।।

তেজতম অংস পর কানহাজি মে কংস পর

তেঁও ম্লেচ্ছবংশপর শের শিবরাজ হ্যায়।।)

কবিতাটি শোনার পর কবিকে আবার আবৃত্তি করতে বললেন সৈনিক, এরপর আবার, তারপর আবারও, এভাবে বায়ান্নবার আবৃত্তির পর ক্লান্ত কবি অস্বীকার করেন পুনরাবৃত্তির। মুচকি হেসে সৈনিক তাঁকে শিবাজির কেল্লা দেখিয়ে দিলেন। পরের দিন রাজসভায় এসে কবি মুখোমুখি হলেন চরম বিস্ময়ের, দেখেন সিংহাসনে বসে আছেন সেই অশ্বারোহী। তিনিই ছত্রপতি শিবাজি। আসলে কবির কবিতা তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে প্রতিবার আবৃত্তির জন্য একটি করে গ্রাম বরাদ্দ করবেন বলে ভেবেছিলেন শিবাজি, আর সেই অর্থে কবির ভাগ্যে নির্ধারিত হয়েছিল মাত্র ৫২টি গ্রাম।

অনেকে বলেন যে এই বায়ান্নবার আবৃত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন চরণ পাঠ করেছিলেন ভূষণ, যা মূলত তাঁর বৃহৎ রচনা ‘শিবরাজ-ভূষণ’-এর ৪৪২ চরণ।

জীবদ্দশায় বহু কবিতা রচনা করেন ভূষণ। তার মধ্যে শিবরাজ-ভূষণ, শিবা-ভবানী, ছত্রশাল দশক উল্লেখযোগ্য। শিবা-ভবানী মূলত শিবরাজ-ভূষণের দ্বিতীয় ভাগ। ছত্রশাল দশক বুন্দেলাখণ্ডের রাজা ছত্রশালের প্রশস্তিগাথা।

মারাঠি নববর্ষে, শিবাজির জন্মদিনে শিবাজিবন্দনায় আজও ধ্বনিত হয় এই পঙ্ক্তি মালা। হিন্দি কবিতার ইতিহাসে এই পঙ্ক্তিগুলো অমর হয়ে গেছে। শিবাজিকে অমর করে রেখেছেন চারণকবি ভূষণ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যেমন নবীনচন্দ্র সেন তাঁর ‘পলাশী’র মাধ্যমে অমর করে রেখেছেন সিরাজ-মীরমদন-মোহনলালকে।

সার্বিকভাবে ভূষণ ছিলেন একজন ছন্দের যাদুকর। ঐশ্বরিক উপমায় ভরপুর ছিল তাঁর বেশির ভাগ কবিতা, যেখানে অনুপ্রাস, রূপক অতিশয়োক্তি, সমোচ্চারিত শব্দের ব্যবহার ছিল অপূর্ব এবং অর্থপূর্ণ। একই সঙ্গে ধর্মীয় উদাহরণ, উপকথা পৌরাণিক গল্পগাথার সঙ্গে প্রাকৃতিক রূপক তার কাব্যকে দিয়েছে অন্য রকম এক মাত্রা।

(প্রথম কবিতার অনুবাদের প্রয়াস আমার বিফল প্রচেষ্টা। দ্বিতীয়টি সুলেখিকা সুচরিতা ঘোষের অনুবাদ)