শামসুজ্জামান খানের জন্য এলিজি

গতকাল মারা গেছেন লোকসংস্কৃতিবিদ এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান সভাপতি শামসুজ্জামান খান। শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখায় থাকল তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা।

আমি পিয়নকে বললাম, ‘জামান ভাইকে আমার নাম বলেন, ভেতরে যাব।’ পিয়ন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের রুমের ভেতর থেকে এসে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে কি আরেকজন...মানে আপনাদের কি দুজনের আসার কথা?’
পিয়নকে বললাম, ‘না। আমারই আসার কথা। জামান ভাই আসতে খবর পাঠাইছেন। এলাম। আড্ডা-টাড্ডা দেব আরকি!’

পিয়ন আমাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘বইসা থাকেন। আপনাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলে যাইতে পারবেন।’

বসে থাকলাম। জামান ভাই ভেতর থেকে তো ডাকেন না। অস্বস্তি লাগছিল। মনে হচ্ছিল, জামান ভাই আমাকে তাঁর রুমে ঢুকতে অনুমতি দিলেন না? বসিয়ে রাখলেন? অথচ এই মানুষটি আমার কবিতা অনেক পছন্দ করেন, আমাকে অনেক প্রশ্রয় দেন, জ্ঞাত আমি। তবে হয়তো এখন তিনি একাডেমির কাজে ব্যস্ত আছেন!

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি, পিয়ন বাবাজি সামনে নেই। ভাবলাম, অনুমতি-ফতির জন্য আমার বসে থাকলে চলবে না। তাই সোজা ঢুকে পড়ি মহাপরিচালকের রুমের দরজা ঠেলে। দেখি, জামান ভাই একলা বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘এসেছ শুনেছি, এতক্ষণ রুমে না ঢুকে কোথায় ছিলে?’
বলি, ‘আপনার পিয়ন তো অনুমতি দেয়নি। তাই অপেক্ষা করছিলাম। কই যেন গেল দেখে আমি নিজেই ঢুকে পড়লাম।’

জামান ভাই বলেন, ‘পিয়ন এসে বলল, টোকন ঠাকুর দেখা করতে চান। তখন তাকে আমি বললাম, হুম, ঠাকরণসহ দুজনকেই আসতে বলো।’

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি, পিয়ন বাবাজি সামনে নেই। ভাবলাম, অনুমতি-ফতির জন্য আমার বসে থাকলে চলবে না। তাই সোজা ঢুকে পড়ি মহাপরিচালকের রুমের দরজা ঠেলে। দেখি, জামান ভাই একলা বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘এসেছ শুনেছি, এতক্ষণ রুমে না ঢুকে কোথায় ছিলে?’

তাঁর কথা শুনে এবার আমি বললাম, ‘আর পিয়ন আমাকে বলল, আপনাদের কি দুজন আসার কথা? বললাম, না, আমি একলাই। তখন পিয়ন বলল, তাহলে বসেন।’
জামান ভাই হা হা করে হাসতে থাকেন। আমিও ঘটনা বুঝে হাসতে থাকি। তারপর জামান ভাই বলেন, ‘তোমার নির্বাচিত কবিতার পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করো, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করব।’

যদিও এলোমেলো জীবন ব্যবস্থাপনা ও ভরপুর আলস্যের কারণে আমার সে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা আর হয়নি। অনেক অনেক স্মৃতি আছে আমার এই বর্ষীয়ান ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষটিকে নিয়ে। সেসব পাথেয়, সম্পদ, জীবনের প্রাপ্তি।

এই করোনাকাল অনেক প্রিয়জনকে আমরা হারাচ্ছি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কবি মনজুরে মওলা, শিল্পী মিতা হক বা শামসুজ্জামান খান—যেনবা টুপ করে ঝরে গেলেন। কত মানুষ চলে গেলেন! এই মুহূর্তে আমরা ঠিক জানিও না আর কতজনকে আমরা হারাব।

লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির গুণীজন সদ্য প্রয়াত শামসুজ্জামান খান। দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। ছিলেন জাতীয় জাদুঘর ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই ছিলেন তাঁর আত্মজীবনী সম্পাদনার দায়িত্বে, যদিও সেই আত্মজীবনী তখন আর প্রকাশিত হয়নি। তবে কয়েক বছর আগে সেটি যখন প্রকাশিত হয়, সেখানেও শামসুজ্জামান খানের ভূমিকা থাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ ছিল একটি ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সাময়িকী। জামান ভাই একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার পর সেই আন্ডারগ্রাউন্ড ‘উত্তরাধিকার’ হয়ে ওঠে প্রকাশ্য আলোর ঝলকানি। মনোরম, সুদৃশ্য ও তারুণ্যনির্ভর। একে ‘উত্তরাধিকার’-এর নবপর্যায় হিসেবে গণ্যযোগ্য বলা যায়। এখন পত্রিকাটি সেই নবপর্যায় আকারেই প্রকাশ হয়ে চলেছে।

এক বড় প্রকাশক বইয়ের কোনো রয়্যালটি না দিয়েই বইমেলায় স্টল নিয়ে চলছিলেন। আমার বই, বন্ধু আলফ্রেড খোকনের বই ও লেখক মুনীর ভাই—আমাদের সঙ্গে সেই প্রকাশকের দ্বন্দ্ব বেধে গেল। আমরা তিনজন বাংলা একাডেমিতে একটা অভিযোগপত্র দিলাম এবং সেই বড় প্রকাশকের স্টল বরাদ্দ বাতিল হয়ে গেল। জামান ভাই সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সেই প্রকাশক আমাদের তিনজনের কাছে কেঁদেকেটে একসার হলেন। ক্ষমা চাইলেন। সব রয়্যালটি দেবেন কথা দিলেন এবং সেই অনুযায়ী কদিন পর উপযুক্ত কাফফারা দিয়ে স্টল পেলেন। যদিও আমরা আর রয়্যালটি পাইনি শেষ পর্যন্ত। তবু জামান ভাই ছিলেন লেখকদের রয়্যালটি ঠকানোর বিরুদ্ধে। তরুণ লেখকদের খুব ভালোবাসতেন তিনি। সেই মানুষটাকে করোনার ধাক্কায় আমরা হারিয়ে ফেললাম। খুব শোকার্ত হয়ে উঠি অজান্তেই, জামান ভাইকে হারিয়ে ফেলার পর। আজ মনে হয়, বেঁচে থাকতে কেন তাঁর সঙ্গে আরেকটু নিলাম না?

একবার এক নবীন প্রকাশক বইমেলায় স্টল পাচ্ছিলেন না এ কারণে যে তাঁর প্রকাশনায় ‘ভালো বই’ নেই। জামান ভাই প্রকাশককে বললেন, ‘ভালো লেখকদের বই করেন, স্টল পাবেন।’ প্রকাশক বললেন, ‘তাঁরা তো অনেক টাকা চান। কী করব?’ জামান ভাই বলেন, ‘কিছুটা কম টাকায় তরুণদের পাণ্ডুলিপি জোগাড় করেন, বই ছাপেন, স্টল পাবেন।’ তার পরের ব্যাপারটি এ রকম যে সেই প্রকাশক এলেন আমার বাসায়। বললেন, ‘একটা পাণ্ডুলিপি দেন, নগদ টাকা দেব।’ আমি আমার একটি কবিতার খাতা ফটোস্ট্যাট করে দিলাম সেই প্রকাশককে। প্রকাশক হাসতে হাসতে চলে গেলেন এবং সেই ফটোস্ট্যাট করা কবিতার পাণ্ডুলিপি জামান ভাইকে দেখিয়ে স্টল বরাদ্দ নিয়ে বাংলাবাজারে গেলেন।

আমার একটি কবিতার সংকলন ‘শিহরণসমগ্র’ উৎসর্গ করেছিলাম শামসুজ্জামান খানকে। বিশেষভাবেই তিনি আমাকে পছন্দ করতেন, এটা আমি জানতাম। তাঁর দপ্তরের তরুণ কবি পিয়াস মজিদ জানেন ব্যাপারটি। কিন্তু হারিয়ে ফেললাম তাঁকে। আর কোনো দিন তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি বসে আড্ডা হবে না। দেখাই হবে না। আমাদের প্রকাশ্য দেখা যেনবা চিরদিনের মতো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে স্মৃতির বোঝাপড়া চলতেই থাকবে আমার।
মন থেকে তাঁকে কোনো দিন হারাব না।