সুচক্রদণ্ডীর মনীষী

১১ অক্টোবর ছিল আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের জন্মদিন। এবার উদ্‌যাপিত হচ্ছে এই মনীষীর জন্মের সার্ধশত বছর।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১১ অক্টোবর ১৮৭১—৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

শান্তিনিকেতনের পাঠভবন ও বিশ্বভারতীর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০) শাস্ত্রীর ওপর। তিনি কাশীর সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হলেও ব্যক্তিগত চিন্তাচেতনায় ছিলেন উদার মানবিক ধারার মানুষ। এর উৎস তাঁর ভারতের মধ্যযুগের হিন্দু-মুসলিম সন্ত-কবিদের সাধনায় আগ্রহ এবং সেই সূত্রে গবেষণা ও দীর্ঘ চর্চা। তিনি ভারতসভ্যতাকে হিন্দু-মুসলিমের যৌথ অবদান হিসেবেই মান্য করতেন। এমন যে ব্যক্তি, তিনি একবার চট্টগ্রাম এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণে সহায়তায় নিয়োজিত ছিলেন এক সরকারি কর্মকর্তা। তাঁকে শাস্ত্রীমশাই এক সকালে জানালেন, তিনি একবার আবদুল করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। আমলা চিনতে পারলেন না আবদুল করিমকে, কিন্তু মনের ভাব মনে রেখেই উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরের অভ্যাসেই বললেন, সে আর কঠিন কি, তাঁকে কালই সকালে আপনার কাছে হাজির করব। ভদ্রলোকের এমন কথা শুনে জিব কাটলেন পণ্ডিত ব্যক্তিটি। বললেন, ছি ছি তা হয় না, আমিই তাঁর কাছে যাব। আরও বললেন, ‘তিনি তো ব্যক্তি নহেন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান।’ ক্ষিতিমোহন তাঁর কাছে যাওয়াকে তীর্থে যাওয়ার সঙ্গেই তুলনা করেছিলেন।

পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করে আবদুল করিম পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস পাস করেছিলেন ১৮৯৩ সালে। তার পরে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর এগোয়নি। নানা স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, সেই সূত্রে সন্ধান পেয়েছেন মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যের, যার অধিকাংশই মুসলিম কবিদের রচিত হলেও তিনি ধর্মভেদ না করে সব ধর্মের কবিদের রচনা সংগ্রহ করেছিলেন—তখনো যাঁরা ছিলেন বিদগ্ধজনের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। আবদুল করিম পুঁথির ঐতিহাসিক ও সাহিত্যমূল্য বুঝতে পেরে সংগ্রহের কাজে মনোযোগ দিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে তিনি অক্ষয়চন্দ্র সরকারের (১৮৪৬-১৯১৭) পূর্ণিমা (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—ডিসেম্বর ১৮৯৯) পত্রিকায় সাহিত্যের ইতিহাস এবং সাহিত্যমূল্য দুই বিচারেই অত্যন্ত মূল্যবান একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। শিরোনাম, ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’। এই প্রথম আলাওল, সৈয়দ সুলতান, নরোত্তম ঠাকুর, মুক্তারাম সেন, শেখ ফয়জুল্লাহ প্রমুখের নাম জানলেন কলকাতার বিদগ্ধ পণ্ডিত মহল। লেখাটি পড়ে মুগ্ধ কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁকে নিজের দপ্তরে কেরানির চাকরি দিয়ে থিতু করেন। কিন্তু চাকরি টিকল না, আবদুল করিমেরই অত্যুৎসাহী একটি কাজে। তিনি সরকারি পদে এসে পুঁথি সংগ্রহের কলেবর বৃদ্ধির ইচ্ছা থেকে চট্টগ্রামের জ্যোতি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপান। এর জের ধরে ইংরেজ বড়কর্তার হাতে তাঁর চাকরিচ্যুতি ঘটে এবং নবীন সেনকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করা হয় কুমিল্লায়। পরে তিনি অবশ্য সরকারি চাকরিতে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টরের অফিসে দীর্ঘ ২৮ বছর কাজ করে ১৯৩৪ সালে অবসরে যান। তবে একবার জ্ঞানের নেশা যাঁর হয়েছে এবং যিনি জ্ঞানের নতুন ভান্ডারের সন্ধান পেয়েছেন, তাঁর সেই কাজকে কে দমাতে পারবে। নতুন কাজে এসে আবদুল করিমের পুঁথি সংগ্রহ এবং এ নিয়ে লেখা কেবল অব্যাহত থাকেনি, তা জোরদার হয়েছিল। তিনি চট্টগ্রামে বসে কাজ করে তখনকার ইংরেজশাসিত ভারতের রাজধানী ও বাঙালির শিক্ষা–সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতার বিদ্বজ্জনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন।

বাংলার ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ইতিহাসকার ড. দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) সাহিত্যবিশারদের সংগ্রহের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। তাঁর অনেক লেখায় এ সংগ্রহের উপাদান ব্যবহার করেছেন। তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান আর স্যার আশতোষ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৪-১৯২৪) উপাচার্য। দীনেশ সেনের সুপারিশে ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুমোদনে সুচক্রদণ্ডী গ্রামের এন্ট্রান্স পাস আবদুল করিম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স ও পরে বিএ–এর একটি পত্রের পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বাংলা অনার্সের একটি পত্রের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। পাণ্ডিত্য কোন স্তরের হলে পরে উচ্চশিক্ষার এ পর্যায়ে একজন স্কুলের গণ্ডি পেরোনো গ্রামীণ ব্যক্তি এতটা সমাদৃত ও মান্য হতে পারেন, তা ভাবলে আজ বিস্মিতই হতে হয়।

একসময় ভাবা হতো বাংলার ইতিহাসেও ইউরোপের মতো একটি অন্ধকার মধ্যযুগ রয়েছে, যা মুসলিম আগমনের পরের শাসনকাল থেকে ইংরেজ শাসনের আগপর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল। পণ্ডিত মহলের এই ভ্রান্ত ধারণা কাটানোর ক্ষেত্রে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাঁর প্রাচীন পুঁথি ও কাব্যসংগ্রহের ভান্ডার যেমন বিশাল, তেমনি তা বৈচিত্র্যেও ভরপুর। তিনি যেমন সংগ্রহ করে গেছেন, তেমনি সংগৃহীত সাহিত্যকীর্তি নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখেছেন অনেক, যা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাহিত্য পত্রিকার মতো উচ্চ মানের গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হতো। এই গ্রামীণ মানুষটি ঠিক ক্ষিতিমোহনের মতোই নিজ ধর্মের অনুশীলন বজায় রেখেও উদার মানবতাবাদী ছিলেন। হিন্দু-মুসলমানে কোনো বিভেদ করেননি, বরং তাদের যৌথ সাধনায় গুরুত্ব দিয়েছেন। মধ্যযুগের হিন্দু লেখকদের অনেক রচনাও তিনি উদ্ধার করেছেন এবং সম্পাদনা করে ব্যাখ্যা–বক্তব্যসহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর সম্পাদিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো নরোত্তম ঠাকুরের রাধিকার মানভঙ্গ, কবি বল্লভের সত্যনারায়ণের পুঁথি, দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ, রামরাজার মৃগলুব্ধ সম্বাদ, দ্বিজ সাধনের পদ্মামঙ্গল, আলী রাজার জ্ঞানসাগর, শেখ ফয়জুল্লাহর গোরক্ষবিজয়, বাসুদেব ঘোষের শ্রী গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস, মুক্তারাম সেনের সারদামঙ্গল। তিনিই সেকালের সবচেয়ে সফল কবি আলাওলের পদ্মাবতী (খণ্ডাংশ) প্রথম প্রকাশ করেন। এসবই প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে।

বলা দরকার, আরাকান রাজসভায় যে মধ্যযুগজুড়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হয়েছে, সেই বিপুল ভান্ডারের সন্ধান প্রথম আবদুল করিমই লাভ করেছিলেন। পরে তিনি এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন ড. এনামুল হকের (১৯০২-১৯৮২) সঙ্গে মিলে। তাঁদের যৌথ গবেষণাগ্রন্থ আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য বিদগ্ধমহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর (১৮৬৪-১৯১৯) অনুরোধেই তিনি প্রথম এই পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ তাঁকে বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে সম্মান দেয় এবং একসময় (১৯১৯ সালে) পরিষদের সহসভাপতি মনোনীত করা হয়।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। মুসলিম লীগের রমরমা কিংবা মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবল জোয়ারের সময়ও এই অসচ্ছল পণ্ডিত মানুষটি নিজ গ্রামে থেকে আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক বড় মাপের ঐতিহাসিক কাজে অভিভাবক হিসেবে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। এ তাঁর অসাম্প্রদায়িক উদার মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনারই ফল। তিনি যেমন পাকিস্তানের ভাষাবিতর্কের সময় বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছেন, পাশাপাশি নতুন রাষ্ট্রে ইসলামি বাংলা নামে কৃত্রিম ভাষা তৈরির প্রয়াসের কঠোর সমালোচনা করে বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা ও মাতৃভাষাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করার দাবি তুলে ধরেছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন বৃদ্ধ বয়সেও। চট্টগ্রামে প্রগতিশীল চেতনা থেকে ১৯৫১ সালে এবং কুমিল্লায় ১৯৫২–তে যে দুটি ঐতিহাসিক সংস্কৃতি সম্মেলন হয়েছিল, সেই দুটিরই সভাপতি ছিলেন পুঁথি সংগ্রাহক ও গবেষক আবদুল করিম। দুই সম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর ভাষণ আজও সাধারণভাবে বিভ্রান্ত বাঙালি এবং বিশেষভাবে বাঙালি মুসলিম সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক। তিনি সুস্পষ্টভাবে যারা চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরোধিতায় লিপ্ত, তাদের ‘পরভোজী’ আখ্যা দিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘ঐতিহ্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি ধ্রুব নক্ষত্রবিশেষ। ঐতিহ্যের অনুসরণ ও সেই স্রোতোধারাকে চিরবহমান করিয়া তোলাই সংস্কৃতিসেবীদের কাজ।...ঐতিহ্যের পটভূমির সহিত যাহাদের যোগ নেই, তরুলতার ক্ষেত্রে যেমন পরভোজী শব্দ ব্যবহার করা হয়—এখানে এই জাতীয় ব্যক্তিদের জন্য তেমনি বিশেষণ আরোপ করা চলে।’ কুমিল্লা সম্মেলন ঠিক ভাষা আন্দোলনের পরপর হওয়ায় তাঁর বক্তব্য ছিল আরও তীক্ষ্ণ, লক্ষ্যভেদী; সাহসী ও দূরদর্শী। তখন তাঁর বয়স ৮১ বছর।

লেখা শুরু করেছিলাম আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর বক্তব্য দিয়ে। শেষ করব মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তাঁর সম্পাদনাকর্মের প্রশংসা করে শাস্ত্রীমশাই বলেছেন, ‘গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহৃদয়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা সমস্ত বাঙ্গালায় কেন, সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যেন কোনো জর্মান এডিটর গ্রন্থ সম্পাদনা করিয়াছেন।’

এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মনীষীকে বিস্মৃত হওয়া কিছুতেই সুবুদ্ধির কাজ হবে না। তাঁরই বক্তব্য স্মরণ করে বলা যায়, দেশ আজ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আপন মাটিতে প্রোথিত শিকড়বিহীন ‘পরভোজী’ মানুষে ছেয়ে গেছে। তাই সার্ধশত বছরেও তাঁকে স্মরণ করার মতো মানুষের অভাব আমাদের জাতীয় দৈন্যেরই প্রকাশ ঘটায়।