শ্রদ্ধা
হাবীবুল্লাহ সিরাজী সে-ও এক বিস্ময়
২৪ মে প্রয়াত হয়েছেন ষাটের দশকের অন্যতম কবি ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী
আশির দশকের শুরুর দিকে যখন কবিতার অমোঘ টানে প্রবলভাবে আলোড়িত, সে সময়েই ‘কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী’ নামের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ঢাকার নিউমার্কেটের মূল প্রবেশফটক পার হয়ে বাঁ পাশের বারান্দায় পা ছুঁলেই শুরু হয়ে যেত সারিবদ্ধ বইয়ের দোকান। টানা বারান্দার শেষে ডান দিকে মোড় নিয়ে আরও প্রায় কয়েক শ গজ পর্যন্ত ছিল বইয়ের রাজ্য। বুক ভিলার শোকেসে থরে থরে সাজানো থাকত ঝকঝকে সব কবিতার বই। সেই সব বইয়ের ভেতর দাও বৃক্ষ দাও দিন, মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি, মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাশ, হাওয়াকলে জোড়া গাড়ি—এই গ্রন্থগুলোর নামের মধ্যে ভিন্ন রকম আকর্ষণ বোধ করি—কবিতার পাশাপাশি বইয়ের প্রচ্ছদ ও সাইজ দেখে অন্য বইগুলো থেকে একটু আলাদা মনে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কবির এক সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম তাঁর প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা। কীভাবে নিজের আগ্রহে বইয়ের টাইপ যে হবে পাইকা ফন্টে, কাগজ হবে কার্ট্রিজ পেপারের আর প্রচ্ছদ করবেন শিল্পী কালাম মাহমুদ—এই সব বিষয়ে প্রকাশককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এরপর মধ্য আশিতে কবিতার নানা আয়োজনের ভেতর একসময় সিরাজী ভাইয়ের স্নেহ-সান্নিধ্যে চলে আসি।
একটি সন্ধ্যার কথা এখনো মনে পড়ে। ঢাকায় ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কবি সংগঠন ‘পদাবলী’র কবিতা পাঠের আসর। গেল শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের উজ্জ্বল কবিদের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত সেই অনুষ্ঠানে আমাদের কয়েকজন তরুণ কবিবন্ধুকে যুক্ত করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রকাশনা, মঞ্চসজ্জা—এই কাজগুলোর দায়িত্ব ছিল সিরাজী ভাইয়ের। এর কয়েক বছর পর ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে ‘শৃঙ্খলমুক্তির জন্য কবিতা’—এই মর্মবাণীকে বুকে ধারণ করে যাত্রা শুরু হয় জাতীয় কবিতা উৎসবের। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী জাতীয় কবিতা পরিষদের চার মেয়াদের (২০০৭-২০১৫) সভাপতি থাকাকালীন শেষ বছরে ২০১৫ সালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতির ভাষণ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:
‘একদিন নবীনের আবেগ ও প্রতিবাদ শৃঙ্খলমুক্তির যে ডাক দিয়েছিল, তাতে যুক্ত হয়েছিল প্রবীণের বোধ ও বিচার। সমন্বিত সে আহ্বানে জাতীয় কবিতা উৎসব-পরবর্তী সময়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ নামের সংগঠনের পতাকা সমুন্নত করেছিল। আর তা বহনের দায় ছিল ’৫২-র অঙ্গীকারে, ’৬৬-এর চেতনায়, ’৬৯-এর আন্দোলনে এবং সর্বোপরি ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। তারপরও শেষ নয়, ’৭৫-এর নৃশংসতা এবং তৎপরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসন বাংলাদেশের কবিতার স্বর পাল্টে দিয়েছিল—জাতীয় কবিতা পরিষদ পালন করেছিল এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। বিশ্বাস করি, অবস্থানের সেই দণ্ড এখনো তার হাতে দৃঢ় এবং ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে। চাই কেবল সম্মুখদর্শনের শক্তি, সহনশীলতা এবং আত্ম-উন্মোচনের পাশাপাশি বিশ্ব-দর্শনের ক্ষমতা।’
বক্তব্যটি সংগঠনের সভাপতির হলেও এর ভেতর ব্যক্তি ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যবিশ্বাস ও রাজনৈতিক বীক্ষণের দিকটিও অনুধাবন করা যায়।
১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে তাঁর কবিতা লেখার শুরু। ১৯৬৮-৬৯ সালে বুয়েটের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক। সে সময় বন্ধুরা মিলে স্বরগ্রাম নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলেন। সাহিত্যিক আড্ডার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতেন। ঢাকা শহরের কয়েক দশকের সাহিত্যিক আড্ডার ইতিহাস ছিল তাঁর নখদর্পণে। শুধু পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার লোভে ঢাকার বাইরে চলে যেতেন—এমনকি কলকাতা, আগরতলাতেও যেতে দেখেছি। আড্ডার সঙ্গী করে নিতে পারতেন কয়েক প্রজন্মের কবি-লেখকদের। নিজের লেখা ও জীবনযাপনে তারুণ্যের শক্তিকে ধরে রাখার ‘সিক্রেট’ বোধ হয় তিনি এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন। পেশায় একজন প্রকৌশলী হওয়ায় গুছিয়ে কাজ করার সহজাত গুণ সব সময় তাঁর ভেতরে লক্ষ করেছি। নিজেই বলতেন, ‘কবিতাই হচ্ছে তাঁর মূল প্রাণ।’ যদিও বেশ কিছুসংখ্যক গদ্যের বই প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন নানা বিষয়ে প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস, আত্মজীবনীমূলক লেখা, বইয়ের সমালোচনা আর প্রচুর কবিতার অনুবাদ। বেরিয়েছে রসুল হামজাতভের কবিতার অনুবাদের বই। এ ছাড়াও সোলঝেনেৎসিনের কবিতা ও আফ্রিকান কবিদের কবিতার অনুবাদ করেছেন।
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ দাও বৃক্ষ, দাও দিন থেকে অদ্যাবধি প্রকাশিত প্রায় ৪০টি মৌলিক কাব্যগ্রন্থে বিষয় ও প্রকরণে বারবার বদলেছেন নিজেকে। এই নিরীক্ষাধর্মী প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে তাঁর কবিতার শক্তি। বিভিন্ন প্রজন্মের কবিদের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের কবিদের সঙ্গেও ছিল নিবিড় যোগাযোগ। ভিন্ন ভাষার কবিদের অনেকের সঙ্গে ছিল সখ্য। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভাষায়।
কর্মসূত্রে ইরাক ও মালয়েশিয়ায় বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন। অসংখ্য বিদেশভ্রমণের ভেতর ইরান ভ্রমণের স্মৃতি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক সময় উল্লেখ করতেন। পারস্যের কবি ও কবিতার প্রতি অন্তর্গত টানের কারণে এই ভ্রমণ তাঁকে খুব আনন্দ দিয়েছিল।
২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে। করোনার সংকটকালেও বাংলা একাডেমির বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও প্রকাশনায় নব প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা তৃতীয় মৌলিক গ্রন্থ আমার দেখা নয়াচীনসহ মুজিব বর্ষকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪০টি গ্রন্থ প্রকাশে তাঁর আন্তরিকতা ও শ্রমনিষ্ঠ উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১৯ সালের বইমেলায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শঙ্খ ঘোষকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এ লেখায় উল্লেখ করছি। এ কথাগুলো আগে কোথাও বলা হয়নি। বইমেলার প্রাক্কালে ব্যক্তিগত কাজে কলকাতায় যাচ্ছি, এটা শোনার পর সিরাজী ভাই আমাকে অনুরোধ করলেন, ‘তুমি যদি বাংলা একাডেমির হয়ে কবি শঙ্খ ঘোষকে মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাও, আমরা খুব খুশি হব।’ আমি সানন্দে এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। কলকাতায় পৌঁছে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং বাংলা একাডেমির অভিপ্রায় তাঁকে জানালাম। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় স্যার প্রথমে সম্মতি দিচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে আমার পীড়াপীড়িতে মৌন সম্মতি দেন। এরপর দেরি না করে সেদিনই কলকাতা থেকে সিরাজী ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দেন। দূতাবাসের আন্তরিক উদ্যোগে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে স্যারের পাসপোর্ট নবায়নসহ ভিসা ইত্যাদির ব্যবস্থা হয় এবং নির্ধারিত দিনে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। সে বছর শুধু বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে নয়, তিনি প্রাণের তাগিদে জাতীয় কবিতা উৎসবেও যোগ দেন। মাত্র কিছুদিন আগে এই অসামান্য মানুষকে আমরা হারিয়েছি। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান এই কবি আমৃত্যু জন্মভূমি বাংলাদেশকে অন্তরে লালন করেছেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়েই হৃদয়ের অর্ঘ্য ঢেলে আমাদের সবার হয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে একটি অসাধারণ কাজ করেছিলেন।
বইমেলার উদ্বোধনী মঞ্চে শঙ্খ ঘোষ যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার কিছুটা উদ্ধৃত করি, ‘বহুবার এসেছি আমি বাংলাদেশে, কিন্তু বহুবার এড়িয়ে গিয়েছি এখানকার নানা আনুষ্ঠানিক আহ্বান। এবারে স্বরের আর শরীরের জীর্ণতা সত্ত্বেও এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মনে হলো আমার জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সংকোচবশত হলেও আমি আজ আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই সেই একুশের স্মৃতিকে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার এত দূর বিশ্বজনীন মর্যাদা আজ। ১৯১৩ সালের বিশ্বসাহিত্যজগতে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব, ১৯৫২ সালে ঢাকা শহরে একুশে আন্দোলন, ১৯৭১-এ নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম আর ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে সেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বজগতের স্বীকৃতি—আমার কাছে, আর আশা করি, আরও অনেকেরই কাছে এই চারটি মুহূর্ত হলো আমাদের ভাষার জন্য এক জয়গর্বের মুহূর্ত।’
সেই জয়গর্বের অংশীদার সিরাজী ভাই নিজেও। তাঁর জীবন ও কাব্যদর্শনে এর প্রতিফলন আমরা দেখেছি। সিরাজী ভাইয়ের আদর্শিক অবস্থানটুকু উপলব্ধি করতে তখন অসুবিধা হয় না, যখন তিনি বলেন, ‘বাঙালির যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমার্থক। ইংরেজ শাসন দিয়ে শুরু করে পাকিস্তানি শাসক পর্যন্ত এসে ১৯৭১-এ আমাদের যে মহান মুক্তিযুদ্ধ, তা দুই শ বছরের অধিক সময়ের অন্তিম বোঝাপড়ার লড়াই। আমাদের যাবতীয় বিকাশের মূল নিহিত ছিল এই যুদ্ধে। ভৌগোলিক মুক্তি, মানবিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি, সর্বোপরি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উৎসমূলের মাটি-জল-আগুন-হাওয়া-আকাশের মুক্তি। তাই অর্জনগুলো চিহ্নিত করতে গেলে বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয়ের আবরণটি প্রথমেই উন্মুক্ত করতে হয়—আর তা হলো বাঙালি। পৃথিবীর মানচিত্রে একখণ্ড ভূমি, যার নাম বাংলাদেশ—একটি নিজস্ব পতাকা—একটি জাতীয় সংগীত এবং সর্বসঙ্গে একজন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
‘জীবন ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হতে থাকে, অনন্ত অব্দি প্রবাহিত হয় তার যুদ্ধ। চলমান এই সময়-ধারণায় মুক্তিযুদ্ধ এক স্থানে দাঁড়িয়ে নেই; যেমন দাঁড়িয়ে নেই ভাত-রুটির অনিবার্য উপস্থিতি। খাদ্যাভ্যাস থেকে জীবনাচার নিত্যদিন যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি বদলাচ্ছে জীবনযুদ্ধের প্রকরণ। মুক্তিযুদ্ধ যে সংগ্রামের ডাক দিয়েছিল, বাঙালির যে সামগ্রিক রূপটি প্রকাশিত করার আহ্বান জানিয়েছিল, সে একা যেমন সত্য, আবার সবাইকে নিয়েও সত্য এবং সারা বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম—এই বোধটিই থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।’
জীবনের অন্তিম পর্বে এসে শরীরে তীব্র রোগযন্ত্রণা নিয়েও তিনি হাসিমুখে কাজ করে গেছেন। আমাদের বুঝতে দেননি তিনি অগ্রসর হচ্ছেন মহাপ্রস্থানের পথে। এক অর্থে তিনি মৃত্যুকে জয় করেছেন হাসিমুখে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার শুরুর কয়েকটি চরণ এ মুহূর্তে মনে পড়ছে:
‘সে-ও এক বিস্ময়! জন্মের কাছাকাছি কোনো গাছ
শিকড় ছিঁড়েই দেখে ঝুলে আছে চাঁদ
পশ্চিম আকাশে
নক্ষত্র জাগার আগে তাকে আমি বলি:
প্রাণ, তুমি কার কাছে লুকিয়েছ দেহের ভূভাগ?’