হিমেল বরকতের লেখালেখির পরিক্রমা

হিমেল বরকতের আলোকচিত্র অবলম্বনে কোলাজ: আমিনুল ইসলাম

আজকের এই সময় যদিও আর্তনাদের, যদিও ছেয়ে আছে শোক ও বিষাদ, তবু লিখতে বসেছি; এ লেখা আর কিছু নয়, শোক বিমোক্ষণের সামান্য উপায়মাত্র—সদ্য প্রয়াত হিমেল বরকতের লেখার মাধ্যমে হিমেলকে মনে করা; যে হিমেলকে আমার সামনে পরিস্ফুট হতে দেখেছি, তার কিছু চিহ্ন হাজির করামাত্র। হয়তো তাই আমাকে যেতে হবে স্মৃতিতে, স্মৃতি থেকে হিমেলের লেখায়।

২০০১ সাল। হিমেল বরকতের প্রথম কবিতার বই বের হবে ‘চোখে ও চৌদিকে’। আমি তখন সদ্য দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হয়েছি; হিমেল বরকত স্নাতকোত্তরে পড়েন। আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন বইটির পুরো পাণ্ডুলিপি। যাচাইবাছাই করে ফেলে দিতে বললেন কবিতা। মন্তব্য করতে বললেন। সবশেষে বললেন, ফ্ল্যাপ লিখতে। বিস্মিত এই আমি সেবার জীবনে প্রথম বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখেছিলাম। ওখানে লিখেছিলাম:
‘বাংলা কবিতায় তাত্ত্বিক-হুল্লোড় এবং দুর্বোধ্যতা চর্চার সমকালীন প্রতিযোগিতা ও প্রবণতা এড়িয়ে হিমেল বরকত একটি পৃথক স্বর। ভাষার সহজ সৌন্দর্যে, ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপে—এ শতকের শুরুতে নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি কখনোই কবিতার বিষয়বহির্ভূত নয়। চৌদিকের মিথ্যা ভাষণ, স্তুতি, মধ্যবিত্তীয় দোদুল্যমানতা, আপস, আত্মবিক্রয়ের দৌড়পাল্লা, সুনিপুণ শোষণ—এই সব নানামাত্রিক অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে গড়ে উঠেছে তার কবিতার অন্তর্ভূমি।’

আমি বিশ্বাস করি, এটিই ছিল হিমেলের মৌল স্বভাব। শুধু কবিতা নয়, তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের বীজ নিহিত এই উক্তিতে। ‘চোখে ও চৌদিকে’, ‘বৈশ্যবিদ্যালয়’ ও ‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’—তিনটি কবিতাগ্রন্থের উক্তি ও উপলব্ধির পটভূমিতে আছে মূলত এই মর্মশাঁস। আর একই সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিলেন আকুল প্রেম এবং তীব্র সংবেদনশীলতাকে।

একই হিমেল একদিকে লিখছেন, ‘তুমি আঙুলে ছিঁড়ছ ঘাস/ আমি বসে আছি খুব কাছে/ যতটা নিকটে হলে খোলা যায় অভিমান/ যতটা নিকটে হলে পিপাসারা মেলে বাহু...।’

অন্যদিকে লিখছেন, ‘১০১ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষরসহ স্মারকলিপি’, ‘একখানা প্রলেতারিয়েত প্রচারপত্র’-এর মতো কবিতা, যেখানে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ধস, রাজনৈতিক সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে তীব্র বিদ্রূপ। দারুণ এক পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে গোটা বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিকে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন। সেই বোঝাপড়ার প্রথম প্রকাশ ‘চোখে ও চৌদিকে’। দ্বিতীয় প্রকাশ তাঁর ‘বৈশ্যবিদ্যালয়’। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি জ্ঞান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কী করে অচলায়তনে পরিণত হয়ে গেছে, তার একটি ব্যঙ্গচিত্র ‘বৈশ্যবিদ্যালয়’। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে ২০২০ সালে পুরোনো-নতুন ব্যঙ্গকবিতাগুলো যুক্ত করেছিলেন। এই সংস্করণে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদশাসিত জীবন ও সংস্কৃতির সমালোচনা হাজির।

আধার ও আধেয়—দুদিক থেকেই ‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’ বইটিকে আলাদা হিসেবে শনাক্ত করতে হবে। এ বইয়ে অন্য দুই কবিতাগ্রন্থের চেয়ে হিমেল অনেক বেশি অন্তর্মগ্ন, তাঁর অনুভূতিশীল পৃথিবীটি আরও বেশি উন্মোচিত। এই বইয়ে ব্যক্তির মুখটিই যেন বেশি ধরা পড়ে। যদিও ব্যক্তিবিশ্বের বাইরের পৃথিবীটি অস্পর্শিত থেকে যায়নি। ‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’র আরও একটি বৈশিষ্ট্য এই যে প্রতিটি কবিতা দশ পঙ্‌ক্তির। প্রতি পঙ্‌ক্তির মাত্রা সংখ্যা দশ। পরিকল্পিত বিন্যাসের বই এটি। দশ পঙ্‌ক্তির সুমিত অবয়বে আটকে রেখেছেন ছোট ছোট অনুভব। হিমেলের কবিতার ভুবন ছোট হলেও তাঁর কবিতাকে হিমেলের বলে চেনা যায়; যাকে বলে আত্মমুদ্রিত ভাষা, পাওয়া যায় তাঁর স্বাক্ষর।

হিমেলের সামগ্রিক আয়োজন ও তৎপরতা ছিল বিউপনিবেশের তাড়নাজাত ব্যাপার। জাতিগত, লৈঙ্গিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়নের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারাগুলোকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সাহিত্য ও ক্ষমতা–সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন তিনি। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক পরিসরে কত শতাংশ একাডেমিশিয়ান প্রায়োগিকভাবে গবেষণা ও বিদ্যাচর্চাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক দায়িত্বের অংশ মনে করেন? সম্ভবত খুব কমসংখ্যক গবেষক মনের গভীর থেকে এই দায়িত্ব বোধ করেন। কিন্তু হিমেলের অন্তরমহল জুড়ে ছিল তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দায়িত্বশীলতা। সমকালীন বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক চর্চায় বিরলতরদের একজন হয়ে থাকবেন তিনি, যিনি শিল্প, সাহিত্য, গবেষণা, শিক্ষাকে প্রতিদিনকার লড়াই ও যাপনের অংশ ভাবতেন এবং সে অনুযায়ী প্রয়োগ করতেন।

বই যে কেবল ‘বই’ নয়, একটি আইডিয়া, সামগ্রিক চিন্তনের একটি প্রকাশ, সে বিষয়ে হিমেল ছিলেন সচেতন ও তৎপর। ‘চোখে ও চৌদিকে’ থেকে আরম্ভ করে তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘বৈশ্যবিদ্যালয়’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ পর্যন্ত পাওয়া যাবে কোনো না-কোনো চিন্তন বা আইডিয়ার প্রকাশ। উল্লেখ্য, মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্প সম্পর্কে হিমেলের ভালো জানাশোনা ছিল। আর তাই বিষয়বস্তু, চিন্তা এবং প্রকাশনার উপস্থাপনার সুচারু সমন্বয় লক্ষ করা যায় তাঁর প্রতিটি বইয়ে। বইগুলোর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ, ভেতরকার বিন্যাস আলাদা মনোযোগ দাবি করে।

এবার চোখ রাখা যাক হিমেলের ভাবনার দুনিয়ায়। আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, হিমেল বরকতের সব কাজের মর্মমূলে নিহিত ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা।

তাঁর কবিতা, গদ্য, সম্পাদনা, গবেষণায় দায়বদ্ধতাগুলো প্রকাশিত। ধরা যাক, বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কিত গবেষণাটির কথা। এই গবেষণায় হিমেল বুঝতে চেয়েছেন বাংলা অঞ্চলের আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের প্রধান স্থপতি বুদ্ধদেব বসুকে; কীভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করলেন, আধুনিকতার খাতকে জোয়ারে ভাসিয়ে দিলেন, সমালোচনার কোন কোন পদ্ধতিগত দিকের প্রয়োগ ঘটালেন—এসব প্রশ্নের মীমাংসা করতে চাইলেন। অন্তর্নিহিত কারণ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিসুলভ ব্যক্তিত্বের মনোজগৎটিকে উন্মোচন করা। এটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাডেমিক দায়িত্ব, বিশেষ করে যাঁরা বাংলা সাহিত্য ও শিল্পকলার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাঁদের জন্য।

বুদ্ধদেবকে আমাদের গভীরভাবেই জানা দরকার; কেননা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি এক ‘মিথ’; হিমেল এই মিথের গল্পগুলো ভেঙে দেখাননি, কিন্তু মিথের ভেতর মহলে ঘুরে এসেছেন।

হিমেল কাজ করেছেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকভাবে তৈরি হওয়া অপর বা আদারদের নিয়ে। এ কারণে আমরা পেয়েছি ‘প্রান্তস্বর: ব্রাত্যভাবনা’র মতো বই; তাঁরই হাতে সম্পাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ এবং ‘বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষাসমূহের কবিতা’। হিমেল কাজ করেছেন তৃতীয় লিঙ্গবিষয়ক সাহিত্য নিয়ে। দীর্ঘ একটি কাজ প্রকাশের জন্য অপেক্ষমাণ, সেটি বাংলাদেশের পথ-কবিতাবিষয়ক।

উন্নয়ন ডিসকোর্সের জোয়ারে প্রান্তিকায়িত হয়ে পড়া সুন্দরবনবিষয়ক একটি গবেষণা আছে তাঁর। তিনি হাত দিয়েছিলেন সুন্দরবনবিষয়ক সাহিত্য সংকলন ও সম্পাদনার কাজে। ইকোক্রিটিসিজমের আলোকে সুন্দরবনকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এই সংকলন নিঃসন্দেহে সহায়ক হয়ে উঠত। হিমেলের গবেষণাবস্তু নির্বাচন এবং উপস্থাপনের বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতা অপ্রথাগত। বাংলাদেশের সাহিত্য সমালোচনায় তিনি প্রচলিত পথে হাঁটেননি। সাহিত্যকে শুদ্ধ নন্দনতত্ত্বের চশমা দিয়ে তিনি দেখেননি। তাই পথ-কবিতার মতো জনপ্রিয় শিল্পাঙ্গিককে ঔপনিবেশিক নন্দনতত্ত্বের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপেননি। দেখিয়েছেন, সমান্তরাল ধারা হিসেবে কীভাবে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত আছে পথ-কবিতা।

বুদ্ধদেব বসু দিয়ে তাঁর আরম্ভ হলেও তিনি ক্রমশ ধাবিত হয়েছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যার দিকে। হিমেল বরকতের গবেষণা ও সাহিত্য-সমালোচনাগুলো হয়ে উঠছিল প্রতিরোধের ডিসকোর্স। কবি চন্দ্রাবতীর দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্য-ইতিহাস ও সমালোচনার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়াবার জন্য। তৃতীয় লিঙ্গবিষয়ক কাজেও আছে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’কে ‘কেবলই’ বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক সংজ্ঞায়ন দ্বারা মোড়কবদ্ধ করার যে জাতীয়তাবাদী প্রয়াস দেখা যায়, তার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল হিমেল বরকতের।

বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষার কবিতাসমূহের সংকলন প্রকাশের পেছনে ছিল সেই প্রতিরোধী মত।

হিমেলের সামগ্রিক আয়োজন ও তৎপরতা ছিল বিউপনিবেশের তাড়নাজাত ব্যাপার।

জাতিগত, লৈঙ্গিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়নের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারাগুলোকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সাহিত্য ও ক্ষমতা–সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন তিনি। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক পরিসরে কত শতাংশ একাডেমিশিয়ান প্রায়োগিকভাবে গবেষণা ও বিদ্যাচর্চাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক দায়িত্বের অংশ মনে করেন? সম্ভবত খুব কমসংখ্যক গবেষক মনের গভীর থেকে এই দায়িত্ব বোধ করেন। কিন্তু হিমেলের অন্তরমহল জুড়ে ছিল তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দায়িত্বশীলতা। সমকালীন বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক চর্চায় বিরলতরদের একজন হয়ে থাকবেন তিনি, যিনি শিল্প, সাহিত্য, গবেষণা, শিক্ষাকে প্রতিদিনকার লড়াই ও যাপনের অংশ ভাবতেন এবং সে অনুযায়ী প্রয়োগ করতেন।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]