হুমায়ূন আহমেদের কালো পর্দা

হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকে কীভাবে দেখতে পারি আমরা? হুমায়ূন–সাহিত্যের কোনো বিষয়-আশয় কি অধরা রয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছে? আজ তাঁর প্রয়াণবার্ষিকীতে একজন পাঠকের দৃষ্টিতে এ লেখায় খোঁজা হয়েছে এসব প্রশ্নের উত্তর।

প্রশ্নটা ক্লিশে, পুরোনো, বহুল চর্চিত—‘কী আছে হুমায়ূন সাহিত্যে?’ অর্থাৎ হুমায়ূন সাহিত্যে কী এমন গুপ্ত, যার কারণে তিনি এত জনপ্রিয়? মূলত হুমায়ূনের উত্থানের পর থেকে তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও এই প্রশ্নচর্চা প্রবহমান। এর উত্তরও পুরোনো, বহুচর্চিত এবং একই কক্ষপথে ঘূর্ণমান—‘মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট আবেগ–অনুভূতির হাস্যরসাত্মক উপস্থাপন, টেস্টি ও ক্রিস্পি গদ্যে গল্পের বয়ান, বই পড়ে সিনেমাপ্রতিম বিনোদন লাভ, এতে নেই কোনো জীবন ও জগতের গূঢ় দার্শনিক বার্তা, যা মস্তিষ্কে শিরঃপীড়া তৈরি করে ইত্যাদি।’

এসবের বাইরে কি হুমায়ূন সাহিত্যে আর কোনো উপাদান নেই? কেন তাঁর আলোচনাকারী-সমালোচনাকারী-সাহিত্যবোদ্ধাদের অধিকাংশই সেই চিরায়ত ঘূর্ণাবর্তের বাইরে গিয়ে আর কোনো উপাদান চোখে দেখেন না? বোধ করি এ কারণে চোখে দেখেন না যে, তাদের একপক্ষের চোখে রয়েছে মুগ্ধতার চশমা আর অপরপক্ষের চোখে রয়েছে ঘৃণার ঠুলি। ফলে একটা আক্ষেপ নিয়েই মারা গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূনের আক্ষেপ, তিনি তাঁর সমগ্র গল্প-উপন্যাসে একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, কিন্তু সেই ইঙ্গিত ধরতে পারেননি তাঁর পাঠক-সমালোচক কেউই।

কী সেই ইঙ্গিত? হুমায়ূনের জবানিতে সরাসরি জানা যাক—‘এই মহাবিশ্বের বেশির ভাগ প্রশ্নেরই উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা জানতে চেষ্টা করছি। যতই জানছি ততই বিচলিত হচ্ছি। আরও নতুন সব প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা নিদারুণ আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছেন তাঁদের সামনে কালো কঠিন পর্দা, যা কোনো দিনই ওঠানো সম্ভব হবে না। কী আছে এই পর্দার আড়ালে, তা জানা যাবে না। আমার যাবতীয় রচনায় আমি ওই কালো পর্দাটির প্রতি ইঙ্গিত করি। আমি জানি না আমার পাঠক–পাঠিকারা সেই ইঙ্গিত কি ধরতে পারেন, নাকি তারা গল্প পড়েই তৃপ্তি পান?’ (সূত্র: এই আমি; হুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবনিক রচনা)

যাঁরা বলেন হুমায়ূন–সাহিত্যে কোনো বার্তা নেই, নেই কোনো মেসেজ, তাঁরা সম্ভবত হুমায়ূনের রচনায় এই কালো পর্দার তালাশ পান না। নতুন সময়ের পাঠক, সমালোচক ও বোদ্ধারা যদি হুমায়ূনকে নিবিড়ভাবে পাঠ করতে আরম্ভ করেন এবং অতি অবশ্যই মুগ্ধতার চশমা ও ঘৃণার ঠুলি খুলে তা করেন, তবে নিশ্চিভাবেই বলা যায়, হুমায়ূনের কালো পর্দা তাঁদের আঁখিপটে তীব্রভাবে উন্মোচিত হবে।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর অসংখ্যবার সূর্য ডুবে গেছে এবং উঠেছে, চাঁদ আলো বিলিয়েছে এবং জোছনা ফুল এঁকেছে, বৃষ্টি ঝরিয়ে গেছে আকাশ। পেরিয়ে গেছে সাত বছরাধিক কাল। এই সাত বছরে হুমায়ূনকে নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, যত অনুষ্ঠান হয়েছে, তার সবগুলোই মূলত স্মৃতিচারণামূলক। কেউ বলেন তিনি বদমেজাজি ছিলেন, কেউ বলেন তিনি অদ্ভুত ছিলেন, কেউ বলেন তিনি আমার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন, কেউ বলেন তাঁর সমস্ত আড্ডায় তিনি নিমন্ত্রণ পেতেন, কেউ বলেন তিনি জাদু ভালোবাসতেন, কেউ বলেন তিনি মানুষকে চমক দিতে পছন্দ করতেন ইত্যাদি। কেউ বলেন না, হুমায়ূনের তিন শতাধিক বইয়ের মধ্যে এই এই এই বই পড়া জরুরি। এই এই বই তাঁকে নতুনভাবে ভাবিয়েছে কিংবা এই এই বই তাঁর জীবনদর্শন পাল্টে দিয়েছে অথবা এই এই বই পড়ে ভীষণভাবে বিরক্ত হয়েছি। এসব বলেন না বলেই হুমায়ূনের কালো পর্দা আজও অধরা।

এখন, এই নতুন সময়ে, হুমায়ূনের জনপ্রিয়তার তত্ত্ব–তালাশের জন্য হলেও অন্তত হুমায়ূনের নিবিড় ও নির্মোহপাঠ জরুরি। হুমায়ূন–সাহিত্য নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হওয়া এখন সময়ের দাবি। হুমায়ূন যে কালো পর্দার কথা বলেছেন, সেই কালো পর্দা সত্যিই তাঁর সাহিত্যে উপস্থিত কি না, তা–ও খুঁজে দেখা প্রয়োজন। বাংলা সাহিত্যের নতুন গতিপথ নির্মাণের জন্যই সেটা খুব বেশি আবশ্যক।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]