'ফুলকবি' সুফিয়া কামাল

পাঠমগ্ন সুফিয়া কামাল। ছবি: সংগৃহীত
পাঠমগ্ন সুফিয়া কামাল। ছবি: সংগৃহীত

আবার এসেছে আষাঢ়। কবি সুফিয়া কামালের প্রিয় কদম ফুলে সুসজ্জিত হয়ে। ১০ আষাঢ়, ১৩১৮ বঙ্গাব্দে বরিশালের শায়েস্তাবাদ নওয়াব পরিবারে ‘পুণ্যাহ’ উৎসবের আনন্দ-কলরবে ভবিষ্যতের কবি সুফিয়ার জন্মক্ষণটি আলোকিত হয়ে উঠেছিল। তিনি নিজেই লিখেছেন: ‘১৯১১ সালের ২০ জুন আমার জন্মদিন।...সৈয়দা সাবেরা খাতুন আমার মা।...সৈয়দ আবদুল বারী বিএল আমার বাবা। আমরা এক ভাই এক বোন।...আমরা মাতামহের গৃহে আদর-যত্নে লালিত-পালিত।’ (একালে আমাদের কাল, ১৯৮৮)

তাঁর সুদীর্ঘ বর্ণিল জীবনের যবনিকা নেমেছিল ১৯৯৯-এর ২০ নভেম্বর।

নারীর মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রাম, শিশুদের জন্য আনন্দময় জগৎ গড়ে তোলা, সংস্কৃতির অধিকারচর্চার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পতাকা হাতে ব্রিটিশ যুগে—পশ্চিম ও পূর্ব বাংলায়—পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কত পথ যে হেঁটেছেন, লিখেছেন গল্প ও কবিতা, দিয়েছেন শতসহস্র ভাষণ। লাখ লাখ শিশু, নারী, তরুণ-তরুণীর খাতায় দিয়েছেন স্বাক্ষর-শুভাশিস। সেসব স্বাক্ষরের ধারাক্রমে সুফিয়া খাতুন, সুফিয়া এন হোসেন, সুফিয়া কামালের সূচনা ঘটেছে। জীবনের নানা উত্থান-ঘটনা-দুর্ঘটনা-শোক-আনন্দের ধারায় ‘কবি সুফিয়া’—নিজের স্থায়ী পরিচয়ে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত নারী সমিতি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’–এর কাজে যুক্ত ছিলেন সুফিয়া। রোকেয়া তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুই তো লেখাপড়া শিখলি না, কিন্তু কবি ত হয়ে গেলি।’ রোকেয়ার দুঃখ ছিল, ‘সুফিয়া যদি ম্যাট্রিকটা পাস করত!’ তিনি নিজেও তো ম্যাট্রিক পাস করার সুযোগ পাননি। হয়েছিলেন নারীসমাজের সমতার-প্রগতির আন্দোলনের অবিসংবাদী নেত্রী। ফুলের মতো প্রস্ফুটিত সুফিয়াকে তিনি ডাকতেন ‘ফুলকবি’ বলে। শামসুন্নাহার মাহমুদ যখন ম্যাট্রিক পাস করলেন, সেই একই সময়ে সুফিয়াও প্রথম অ্যারোপ্লেনে চড়লেন। তাই তখন এই দুই কৃতীকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন রোকেয়া। বলেছিলেন, ‘ফুলকবি, তুই ত এখন আসমানে উঠতে শিখেছিস।’

সুফিয়া সে সময় কবিতার পর কবিতা লিখছিলেন। তবে তাঁর সাহিত্যচর্চার প্রথম ফসল ছিল গল্প। সরল কুমার দত্ত সম্পাদিত তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’। তখন তিনি বয়সে তরুণী। বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সে। তরুণ ছাত্র নেহাল হোসেন (প্রয়াত ১৯৩২) আজীবন তাঁর স্ত্রী সুফিয়ার সাহিত্যচর্চার উৎসাহী সঙ্গী ছিলেন। সুফিয়ার সাহিত্যচর্চার সূচনাকাল ১৯১৮ থেকে ১৯২২ সাল। ছয়-সাত বছর থেকে মামা খোদাবক্সের ‘ছোটদের জন্য নিষিদ্ধ’ পাঠাগারে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যসম্ভার, কাজী নজরুল ইসলামের গল্প ‘হেনা’, রোকেয়া, সারা তাইফুর, মোতাহারা বানুদের লেখা পড়েছেন। সে সময়ই ভেবেছেন, তিনিও লিখবেন। নিজের আত্মকথনে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘শুরু হল লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায় ভীষণ লজ্জায় সেই হিজিবিজি লেখা, ছড়া, গল্প।...কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সঙ্কুচিত হয়ে উঠি।’

কবি যখন ১৯৮০-এর দশকে লিখছেন পুরোনো স্মৃতিকথা—একালে আমাদের কাল—বয়স তখন তাঁর ৭০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমার নিজের স্মৃতিতে তিনি তখন নিত্যদিনের কবি, সাহিত্যিক, বক্তা, নারী, শিশু, জনগণের, রাজনীতিবিদদের গণতান্ত্রিক মিছিলের অগ্রণী নেতা। ফতোয়াবিরোধী আন্দোলনে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্বে, আন্তর্জাতিক নারী ও শান্তি সম্মেলনে, সাহিত্য সম্মেলনে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রামে জীবন্ত হয়ে আছেন তিনি।

বারবার বিবেকের সত্যভাষণ তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন গল্পে, কবিতায়, বক্তৃতায়। হেঁটেছেন, বলেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন অসত্যের, অত্যাচারের, দমননীতির বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর প্রতিবাদ সোচ্চার ছিল মুখের ভাষায়, কলমের কালিতে এবং হৃদয়ের রক্তক্ষরণে।

সুফিয়া প্রথমে লিখতেন ‘মিসেস এসএন হোসেন’ নামে। লেখালেখির প্রথম দিকে মামা খোদাবক্স বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অদম্য ছিলেন স্বামীর সহযোগিতায়। একই সঙ্গে কৈশোরেই নারী সমিতি, শিশু মঙ্গল, শিশু সদনের কাজে যুক্ত ছিলেন বরিশালের সর্বজনশ্রদ্ধেয় সুকুমার দত্তের স্ত্রী সাবিত্রী দত্তের নেতৃত্বে। স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, ‘বরিশালের বালিকা বিদ্যালয়ের মধ্যে সভা হতো, বোরখা পরে বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি করে সাবিত্রী দিদির সঙ্গে যেতাম। কী হাস্যকর সে যাত্রা। তবুও কী অসীম তৃপ্তি লাভ করতাম অসহায়া, অশিক্ষিতা মায়েদের, শিশুদের সঙ্গে।...আমার তখনো কৈশোর কাটেনি।’

 ১৯২৫ সালে চতুর্দশী সুফিয়া এন হোসেন বরিশালে মহাত্মা গান্ধীর সংবর্ধনা সভায় যোগ দিলেন সত্যাগ্রহী কাকিমাদের সঙ্গে (রজনী দত্ত ও নলিনী দত্তের স্ত্রীদের সঙ্গে) তাঁদের মতো কাপড় পরে, সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে। গান্ধীজির হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজ হাতে চরকায় কাটা সুতো। সেদিন কী যে আনন্দ ও গৌরববোধ করেছিলেন তিনি, আমরা উত্তরসূরিরা সেই আনন্দ ও গৌরবের মূল সূত্রটি বুঝতে পারি। নারী জাগরণ ও নারী আন্দোলনের ইতিহাস তৈরিতে কিশোরী সুফিয়া এন হোসেনের হাতেখড়ি হয়েছিল সেই সময়ে।

কবির ছোট মামা সৈয়দ ফজলে রাব্বী সাহেব ঢাকার অভিযান পত্রিকায় ভাগনি সুফিয়ার কবিতা বেছে বেছে প্রকাশ করাতেন। কাজী নজরুল ইসলাম সেই পত্রিকায় কবিতা পড়ে সুফিয়াকে প্রশংসা করে ও উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। কলকাতা থেকে সে সময় প্রকাশিত হতো মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত সওগাত। এই পত্রিকায় কবিতা পাঠাতে বলেছিলেন তিনি। সওগাত–এ প্রথম ছাপা তাঁর কবিতা ‘বাসন্তী’ (চৈত্র ১৩৩৩)। কবিতাটির প্রথম চারটি লাইন হলো:

 ‘আমার এ বনের পথে

কাননে ফুল ফোটাতে

ভুলে কেউ করত না গো

কোনো দিন আসা-যাওয়া।’

কবিতা ছাপার পর বহু পাঠকের চিঠি এসেছিল। তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, ‘কে এই সুফিয়া এন হোসেন?’ এরপর রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে (১৯২৮) নিজের লেখা একটি কবিতা পাঠালেন সুফিয়া। উত্তরে বিশ্বকবি তাঁর গোরা উপন্যাসটি পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ৭ আশ্বিন তারিখটি (২ ডিসেম্বর ১৯৩৮) আজীবন মনে রেখেছিলেন সুফিয়া। কারণ, এদিনে রবিঠাকুর চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন:

 ‘কল্যাণীয়া সুফিয়া,

তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে।

বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান ঊর্ধ্বে এবং ধ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা। আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো।’

ইতি

শুভার্থী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’

(সূত্র: রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ, ভূঁইয়া ইকবাল, প্রথমা প্রকাশন, ২০১০)

দুই.

‘ফুলকবি’ সুফিয়া
‘ফুলকবি’ সুফিয়া

‘ফুলকবি’ সুফিয়া কামালের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও দূর থেকে জানার শুরু ১৯৫৩ সালে, লীলা নাগ প্রতিষ্ঠিত ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ (এখন শেরে বাংলা মহিলা মহাবিদ্যালয়) স্কুলে ভর্তির সময়ে। তিনি ছিলেন বিদ্যালয় পরিচালক কমিটির সদস্য। তাঁর ছেলে সাজেদ কামাল ছিল আমার সহপাঠী। ৯ বছর বয়স থেকেই মাঝেমধ্যে দেখেছি তাঁকে, পাঠ্যবইয়ে পড়েছি তাঁর কবিতা। ওয়ারিপাড়ায় দাঙ্গা প্রতিরোধের নেতৃত্বে, রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে (১৯৬১) এবং ক্রমশ নানা প্রতিবাদী সভায়-মিছিলে দেখেছি কী অসীম অকুতোভয় ছিলেন তিনি! ১৯৭০ থেকে এই স্বনামধন্য কবির নেতৃত্বে ক্রমান্বয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ ও ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদিকার কাজে তাঁর স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি ১৯৯০ পর্যন্ত। এরপরও ১৯৯৯ অব্দি তাঁর ভালোবাসা ও স্নেহে পূর্ণ থেকেছি। আজও তাঁর স্মৃতিমাধুর্যে রয়েছি আপ্লুত।

কবির প্রথম জীবনের ২১টি বছরের (১৯২৩-৩২) দাম্পত্য জীবনের সাথি প্রয়াত নেহাল হোসেনের সহমর্মিতার কথা তাঁর বচনে শুনেছি, সাঁঝের মায়া কাব্যে পড়েছি। কিন্তু আমার স্মৃতিসম্ভারে জীবনসাথি সুফিয়ার প্রতি শ্রদ্ধেয় কামাল উদ্দীন খানের নানা দায়িত্ব ও অফুরন্ত ভালোবাসার টুকরো টুকরো অখণ্ড ইতিবৃত্ত সঞ্চিত রয়েছে।

তাঁকে ডাকতাম খালম্মা বলে। সুফিয়া খালাম্মা রান্না করছেন এক হাতে খুন্তি নেড়ে। অন্য হাতে কলম ধরেছেন, কবিতা লিখছেন—সেসব নিত্যদিনের দৃশ্য কি ভোলা যায়? রান্নাঘরে ফেলে রাখা কবিতার কাগজগুলো তাঁর জীবনসঙ্গী কামাল উদ্দীন খান সাহেব সযত্নে তুলে এনে টেবিলে বসেছেন। তখন ফটোকপির যুগ তো ছিল না। তাই নিজ হাতে কপি করে ফাইলে রেখেছেন। সেই সব দিনের স্মৃতি কি ভোলা যায়!

সুফিয়া কামালের সন্তানেরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত। সার্থক জননী শতমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন পুরো জীবনে। রোকেয়ার আদর্শ অনুসারী সুফিয়া হয়েছেন কোটি কোটি নারী-পুরুষ-শিশুর আদর্শ। গল্প ও কবিতায় জীবনসাধনার শিকড় রোপণ করেছেন তিনি।

‘আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে’ ছিল তাঁর প্রিয় একটি গান। এই গানসহ আরও কয়েকটি গান সব সময় শুনতেন তিনি। ‘রবীন্দ্রনাথের গান উপাসনার মতো লাগে’—কথাটি বলে নিন্দা-গালমন্দ শুনেছিলেন। কিন্তু সেই গানেই ছিল তাঁর মুক্তির আনন্দ। সর্বদা মানবমুক্তির গানই গেয়েছেন সুফিয়া কামাল। বাঙালি নারী জাগরণের ইতিহাসে ‘ব্যক্তির ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে সংকোচের বিহ্বলতা বইয়ে গবেষক গোলাম মুরশিদ যাঁদের নাম বলেছেন, তাঁদের উত্তরসূরিরূপে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। এই কবির রচনাসমগ্র থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁর গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কাব্য ও গদ্য গ্রন্থসমূহ সংকলিত হয়েছে। এর বাইরেও অগ্রন্থিত অবস্থায় ছড়ানো–ছিটানো রয়েছে তাঁর আরও বহু লেখা। সেই লেখাগুলো বই আকারে সংকলিত হওয়া প্রয়োজন মনে করি। একই সঙ্গে বলতে চাই, বাংলা একাডেমির একটি কক্ষের নাম সুফিয়া কামালের নামে করা হোক।

‘ফুলকবি’র জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।