অপুষ্টি নিরসনে নতুন সম্ভাবনা পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল

বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। এ উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতসহ বিভিন্ন খাতের অবদান অগ্রগণ্য। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। তারপরও বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির সমস্যা প্রকট। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বতা, কৃশতা এবং কম ওজনের হার যথাক্রমে ৩০, ৮ ও ২২ শতাংশ। জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১১-১২ অনুযায়ী, বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু ও নারী একাধিক অনুপুষ্টি (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) ঘাটতিজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাক্‌-বিদ্যালয়ের প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন ভিটামিন এ-এর ঘাটতিতে, ৪৪ শতাংশ শিশু জিংকের ঘাটতি, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশু রক্তস্বল্পতা এবং ৭ দশমিক ২ শতাংশ শিশু আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। প্রজননক্ষম নারীদের (অন্তঃসত্ত্বা বা প্রসূতি নয়) মধ্যে ৪২ শতাংশ আয়োডিনের ঘাটতিতে এবং প্রায় প্রতি চারজনের একজন নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।

আমরা ভাতে-মাছে বাঙালি। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য, তাই এ কথা আমাদের জন্য যথার্থ। দেশের সব স্তরের মানুষ, বিশেষ করে স্বল্প বা নিম্ন আয়ের যারা, তাদের উপার্জনের বেশির ভাগটাই খরচ হয় শুধু চাল কিনতে। তাই বাঙালির কাছে ‘বেঁচে থাকা’ মানে আসলে ‘ভাত খাওয়া’। তবে ইদানীং মনে হচ্ছে আমরা যেন ভাত থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছি। বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক, অন্যান্য শর্করাজাতীয় (গম, আটা, ভুট্টা) খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ছি। দেশে বছরে প্রায় ৩৬০ কোটি টন চাল ব্যবহৃত হয় খাদ্য হিসেবে। আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় ক্যালরির প্রায় ৫০ শতাংশই আমরা পাই ভাত থেকে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্যমতে, গ্রামপর্যায়ে প্রায় ৬৮ শতাংশ পুষ্টির উৎস ভাত।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় জনগণের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিস্তর উন্নত করা, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে কোন খাবারটা আমরা বেশি খাই বা কোন খাবারটা সহজলভ্য। ভাত, ডাল, আলু, মাছ, শাকসবজি—এই খাবারগুলোই আমরা বেশি খাই। এগুলোর মধ্যে যেহেতু ভাতই আমরা বেশি খাই, সেহেতু ভাতের পুষ্টিমান বাড়ানোর চিন্তা করলে সেটা সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক। চালের মধ্যেই যদি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সংযোজন ঘটিয়ে এর পুষ্টিমান বাড়ানো যায়, তাহলে কিন্তু সহজেই জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নত করা সম্ভব। আর চাল সমৃদ্ধকরণ বাংলাদেশর জন্য নতুন কিছু নয়, বর্তমানে শিল্পজাত প্রক্রিয়ায় চালে পুষ্টি সমৃদ্ধকরণ হয়ে থাকে। এর সঙ্গে আমরা বায়োফর্টিফিকেশনের মতো অত্যাধুনিক জীবপ্রযুক্তিও ব্যবহার করতে পারি। তবে অবশ্যই আমরা অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের কথা চিন্তা করে ‘খাদ্যে বৈচিত্র্য’ নিশ্চিত করার কাজটিও একই সঙ্গে চালিয়ে যাব।

জাতীয় অনুপুষ্টি (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) ঘাটতি প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ কৌশল ২০১৫-২৪ অনুযায়ী অনুপুষ্টি ঘাটতিজনিত অপুষ্টি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যে কয়েকটি পন্থা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে খাদ্য সমৃদ্ধকরণ (ফুড ফর্টিফিকেশন) অন্যতম। খাদ্য সমৃদ্ধকরণের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত ও গ্রহণযোগ্য খাদ্যসামগ্রীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেসবের মধ্যে খাবার লবণ, ভোজ্যতেল, চাল, ডাল ইত্যাদি অন্যতম।

জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা ২০১৬-২৫-তে খাদ্য সমৃদ্ধকরণকে বাংলাদেশে অনুপুষ্টি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি কৃষি বিনিয়োগ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এবং এ বিষয়ে অধিকতর গবেষণার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, চাহিদা ও সেই মোতাবেক পুষ্টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম সমস্যা হলো বাজারে ভিটামিন এ, আয়রন এবং জিংকের মতো পুষ্টিসমৃদ্ধ চালের যথেষ্ট সরবরাহ নেই। পুষ্টিসমৃদ্ধ চালের দাম নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে কিছুদিন আগে একটি আলোচনায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে পুষ্টিসমৃদ্ধ সব চালের দাম আর দশটা সাধারণ মোটা চালের সমান। জাতীয় পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক প্রধান এবং একমাত্র নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ (বিএনএনসি)। তাই পুষ্টিসমৃদ্ধ চালের প্রসার ঘটাতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি, খাদ্য এবং পুষ্টিবিষয়ক গবেষণা এবং কার্যক্রমের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত আছেন, তাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে বিএনএনসি। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে যৌথভাবে কাজ করারও অনেক সুযোগ রয়েছে।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় জনগণের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিস্তর উন্নত করা, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে কোন খাবারটা আমরা বেশি খাই বা কোন খাবারটা সহজলভ্য। যেহেতু ভাতই আমরা বেশি খাই, সেহেতু ভাতের পুষ্টিমান বাড়ানোর চিন্তা করলে সেটা সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক।

২০১৬-২৫ সালকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পুষ্টি দশক’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি বেশ কিছু পুষ্টিবিষয়ক সূচকের নির্দেশনা দিয়েছেন, যা আমাদের ২০২৫ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ ২২টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এই সূচকগুলো অর্জন করতে হবে। এই ২২টি মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুসারে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাই আমাদের, অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের কাজ। এ ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে বলা আছে। তার মধ্যে একটা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে কৃষি বিভাগের করণীয়-সম্পর্কিত। এ লক্ষ্যে জাতীয় পুষ্টি পরিষদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে—এ আশা করছি।

২০২০ সালে যখন কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, তখন সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি জেলায় ত্রাণ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিএনএনসির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে এক সপ্তাহের জন্য একটা আদর্শ ত্রাণ প্যাকেজ কেমন হওয়া উচিত। আমরা তখন এই আদর্শ প্যাকেজ ঠিক করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যাঁরা পুষ্টি নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সমন্বয়ে একটা কমিটি করলাম। সেখানে আলোচনা হচ্ছিল যে ত্রাণ প্যাকেজে তো চাল থাকতেই হবে, কিন্তু সঙ্গে আর কী কী ধরনের পুষ্টি দেওয়া যায়। প্রথমে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে সরকারি ত্রাণের আওতায় যত চাল দেওয়া হবে, তার সবটুকুই হতে হবে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল। কিন্তু দেখা গেল সব এলাকায় পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল পাওয়া যায় না। তাই তা আর করা হয়নি।

‘রাইস বায়োফর্টিফিকেশন’ একটি নতুন প্রযুক্তি, তাই এ নিয়ে মানুষের মনে নানা রকম প্রশ্ন আছে। যেমন এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ চালের মধ্যে মানবশরীরের জন্য ক্ষতিকর কিছু আছে কি না বা কোনো কৃত্রিম উপাদান মেশানো হয় কি না ইত্যাদি। এই ভুল ধারণাগুলো ভাঙার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত বড় আকারে জনসংযোগ কর্মসূচি হাতে নেওয়া। এ ছাড়া, পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল যে দরিদ্র জনগণের কথা মাথায় রেখেই উদ্ভাবন করা হয়েছে, সে বিষয়ও সামনে আনা যেতে পারে, বিশেষ করে কোভিড-১৯-এর মতো বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে যখন একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ক্রমহ্রাসমান ক্রয়ক্ষমতা তাদের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে। তাই আমরা যদি সাশ্রয়ী দামে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিসমৃদ্ধ চালের জোগান নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে সাধারণ মানুষ তা কিনে খেতে পারবে। এমনকি যদি প্রচলিত প্রতিটি চালের জাতের মধ্যেই অনুপুষ্টি বাড়ানো যায় এবং ক্রমান্বয়ে প্রতিটি চালকেই যদি উন্নত করা যায়, তাহলে প্রতিটি চালই কোয়ালিটি চাল হবে।

২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধা ও অপুষ্টি মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের একটি অন্যতম বড় অঙ্গীকার। এ বিষয়কে ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনায় (এনপ্যান ২) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তা ছাড়া, জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নসংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী পত্র হলো খাদ্য অধিদপ্তর অনুসারিত ‘বাংলাদেশ দ্বিতীয় জাতীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা ২০১৬-২০২১ (সিআইপি ২): পুষ্টি-সংবেদনশীল খাদ্য ব্যবস্থা’। সেখানেও সুস্পষ্টভাবে পুষ্টি সংবেদনশীল এবং টেকসই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নত পুষ্টি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে জীবপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের পরামর্শ।

এসব রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরণ করেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বিশ্বের প্রথম বায়োফর্টিফাইড জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। পাশাপাশি ভিটামিন এ-সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইসের গবেষণাও শেষ হয়েছে। এ ছাড়া জিংকসমৃদ্ধ আরও চার ধরনের চাল উদ্ভাবন করেছে ব্রি। এখন সময় হয়েছে এই চালগুলো ব্যাপক আকারে দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এর সুফল ভোগ করতে পারে।

আজ আমরা পুষ্টি নিয়ে যেভাবে কথা বলতে পারছি, তার একটা বড় কারণ কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের অভাবনীয় সাফল্য। যার ফলে দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা এখন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে খাদ্য রপ্তানিও করতে পারছি। সুতরাং কৃষি বিভাগ যদি চালের পুষ্টিমান উন্নয়নে ফর্টিফিকেশন বা বায়োফর্টিফিকেশনের মতো পদ্ধতির ওপর আরও গুরুত্ব দেয়, তাহলে জনস্বাস্থ্য এবং পুষ্টিস্তর উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়ন অনেকটাই সহজতর হবে।

ডা. মো. খলিলুর রহমান মহাপরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ