আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: আম্মার ঘরে কী ফেলে এসেছিলেন?

১৯৮৯ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ছবি তুলেছিলেন তাঁর বন্ধু কবি ওমর শামস।
১৯৮৯ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ছবি তুলেছিলেন তাঁর বন্ধু কবি ওমর শামস।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে প্রথম দেখা বৃষ্টির সন্ধ্যায়, শেষ দেখা কবরস্থানে, তখন তাঁর মুখটা ঢাকা। বগুড়ায় শুরু, বগুড়াতেই শেষ। তাঁর সঙ্গে স্মৃতি কম বলেই হয়তো সবটাই অমূল্য মনে হয়, সবটাই মনে থাকে।

১৯৯৪ সাল। তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। বাম ছাত্র রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যকর্ম, দুটোতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ফলে বিস্তর আড্ডা হতো। বন্ধুমহল, পার্টি মহল সেরে আসতাম পড়ুয়ায়। বগুড়ার থানা রোডের এই বইয়ের দোকানটি আর যথাস্থানে যথাভাবে নেই, অথচ একসময় এটাই ছিল উত্তরবঙ্গের শাহবাগ, বগুড়ার আজিজ সুপার মার্কেট। কে না আসতেন সেখানে? এ রকম এক আড্ডায় শিক্ষক ও সাহিত্যগুরু শোয়েব শাহরিয়ার বললেন, ‘এই ফারুক, জানো নাকি, ইলিয়াস ভাই আসছেন।’ বললাম, তাই নাকি? আমি দেখা করব। স্যার বললেন, ‘তুমি কাল সন্ধ্যায় ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায় আসো, আমিও আসব।’

সাতমাথা থেকে বামে নবাববাড়ি হয়ে জেল রোডের মোড়ে একটা ছোট্ট সড়কদ্বীপ। তার বামে একটা চৌচালা বাংলো বাড়ি দেখতাম। সামনে পাতাবাহার গাছসমেত পুরোনো বাড়ি। সেটাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ওরফে মঞ্জুদের বাড়ি। তিনি তখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। মাঝেমধ্যেই বগুড়া আসতেন ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাস লেখার কাজে। পুরোনো বাড়িটার পেছনেই ছিল তিন কি চারতলা এক হলুদ দালান। সেটাও ইলিয়াস পরিবারেরই বাড়ি। বাড়িটার নাক বরাবর গেলে জেলখানা ও স্টেশন ক্লাব পেরিয়ে মরা করতোয়া নদী। না জেনেই কত বছর সেখানে আড্ডা দিয়েছি। পরে বুঝেছি, তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রা গল্পের বাড়ি, রাস্তা এবং মৃত্যুদৃশ্যটা বাড়ির সামনের এই রাস্তারই।

পরদিন সন্ধ্যায় খুব ‘মনোরম মনোটোনাস’ বৃষ্টি। তার মধ্যে হাজির হলাম সেই হলুদ বাড়িতে।

তত দিনে ইলিয়াস সম্পর্কে আমি কিছুটা জানি। তাঁর গল্পের বইগুলো পড়েছি, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসও পড়া। আমার মধ্যে অন্য আরেক ভাব। ছাত্র ফেডারেশন নামে যে সংগঠনটির শাখা আমি প্রথম বগুড়ায় খুলেছি, সেটা আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংগঠন সেই বাংলাদেশ লেখক শিবির একই জোটের সদস্য। ইতিমধ্যে আমারও কয়েকখানা গল্প কামরুল হুদা পথিক ও সরকার আশরাফ সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘দ্রষ্টব্য’ ও ‘নিসর্গে’ বেরিয়েছে। হলুদ বাতির সেই সন্ধ্যায়, ইলিয়াসদের বৈঠক ঘরে এই পটুভূমিতে ভাবছি, কী বলব তাঁকে? শোয়েব শাহরিয়ার স্যার এখনো আসছেন না কেন?

এর মধ্যে ইলিয়াস এলেন। মোটা ফ্রেমের চশমা, বাসার পোশাক পরা, হাতে সেই বিখ্যাত পাইপ আর দরাজ গলা। জানতে চাইলেন কী করি। বলা হলো। কথায় কথায় উনি বললেন, ‘তোমার গল্পগুলো পড়তে দেবে? আমি পড়তে চাই।’

বালকের প্রথম অহংবোধ আমাকে মনের ভেতর খাড়া করে ফেলল। বলে ফেললাম, ‘আমরা তো আপনার লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ি। আমার লেখা যদি সত্যিই পড়তে চান তাহলে আপনিও খুঁজে নেবেন। আজিজ মার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় পত্রিকাগুলো পাওয়া যায়।’

এমন কথায় অন্য কারও হয়তো ভ্রু কুঁচকে যেত। কিন্তু ইলিয়াসের কণ্ঠে অগাধ প্রশ্রয় আর আগ্রহ। বললেন, ‘আলবৎ! তাই তো, তাই তো, আমি অবশ্যই খুঁজে নিয়ে পড়ব।’ তারিফ করতে করতে এ গল্পটা উনি ঢাকায় এসে অনেককে করেছিলেন। এক উঠতি তরুণের আত্মশ্লাঘাকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি আসলে লেখকের আত্মমর্যাদাবোধেরই জ্বালানি জুগিয়েছিলেন সেদিন।

আরেকবারের কথা। পড়ুয়ার উল্টোদিকে শ্যামলী রেস্টুরেন্টে আড্ডা হচ্ছে। কবি শোয়েব শাহরিয়ার, সাহিত্য সমালোচক ও গল্পকার বজলুল করিম বাহার, কথাসাহিত্যিক সাজাহান সাকিদার—এঁরা ছিলেন। তরুণদের মধ্যে কবি শিবলী মোকতাদির, মান্নান আরজুরা ছিলেন। রাত প্রায় ১০টায়ও সেই আড্ডা আর ফুরায় না। সবাই মিলে জেলরোডের দিকে হাঁটা দিলাম। ইলিয়াস ভাইকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। সুনসান শীতের রাতে বাংলা সাহিত্য সদরঘাটের লঞ্চের মতো গুঞ্জন করতে করতে চলছে। মাঝেমধ্যে লঞ্চের ভেঁপুর মতো ইলিয়াসের সেই বিখ্যাত হো হো হাসি—পল্টনের লেখক শিবিরের আড্ডায় যে হাসি ফাটলে নাকি ফুলার রোডের গোমড়া শিক্ষকেরাও চমকে উঠতেন। তো, আমরা তাঁর বাড়ির কাছাকাছি এসেছি, এমন সময় পেছন থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল, ‘ক্যা রে মঞ্জু উ উ’।

মঞ্জু ফিরে তাকায়। জেলখানা রোডের অন্ধকারে, গলির ভেতর থেকে মূর্তির মতো এগিয়ে আসে একটা ঢ্যাঙা চেহারার মানুষ। বয়স বোঝা যায় না, চল্লিশও হতে পারে, পঞ্চাশও হতে পারে। কাছে এসে হাত রাখে মঞ্জুর ঘাড়ে। ‘ক্যা রে, কবে অ্যালু, খবর পানু না!’।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাপুরুষ’ উপন্যাসের স্পাই আর সন্ত্রাসবাদী দস্যু ছোটবেলায় ছিল গলাগলি বন্ধু। স্পাইটির নাম ছিল রূপা। শৈশবের মাঠে দস্যুটি বন্ধুকে ডাক দিত: ‘রূপা বেন গাড়া রে!’ বন্ধুর ডাকে ইলিয়াস মঞ্জু হয়ে গেলেন। জলেশ্বরীতলার শুরুতে যেখানে ইলিয়াসদের বাড়ি, তার আগেই কালীবাড়ি মোড়। সেখানেই ছিল এই বন্ধুটির বাড়ি। আধা অপ্রকৃতিস্থ মানুষটিকে পরেও দেখেছি। এক একা হাঁটতেন আর বিড়বিড় করতেন। কেন যেন মনে হয়, ওই চরিত্রটির মধ্যে ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ গল্পের প্রদীপের ছায়া পাওয়া যায়।

শেষের দিকে...হায়, তখন কে জানত যে শেষের দিকটা কাছে চলে আসছে? শেষের দিকে ‘খোয়াবনামা’ লেখার কাজে খুব ঘুরতেন বগুড়ার গাবতলী থানার কাৎলাহার বিল, গোলাবাড়ি, মহিষবাথান, চন্দনবাইশা, ধুনট, মহাস্থান এসব জায়গায়। সারা দিন ঘুরতেন, সন্ধ্যায় দেখতাম ওই চৌচালা বাংলো বাড়ির বৈঠকখানায় গল্প করতে করতে এক হাত দিয়ে ডান ঊরু টিপছেন। খুব ব্যথা হতো। তখনো পায়ের ক্যানসারটা ধরা পড়েনি। টাইপরাইটারটা সঙ্গেই থাকত। আরেক ঘরে বসে কখনো কখনো লেখার খটাখট শব্দ পেতাম। গোলাবাড়ী বাজারে তাঁদের এক আত্মীয় নাকি জিন নামাতে পারেন। তার গল্প হতো। গাবতলীর বিখ্যাত পোড়াদহের বিলের গল্প হতো। এসবই ছিল তাঁর ‘খোয়াবনামা’ লেখার রসদ। অনেক ঘুরেছেন তিনি। ঘুরতে ঘুরতেই ডান পা-টা ক্যানসারে কাটা পড়ল।

আমার কেবল তাঁর পায়ের কথা মনে আসে। তিনি সেই ধরনের লেখক, যাঁদের মনের চোখকে প্রভাবিত করে তাঁদের পা। জোড়া পায়ে তাঁরা লোক-লোকান্তরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ান। পায়ে পায়ে তাঁরা চলে যান সেই কিনারে যেখানে জীবন ‘অনাগরিক’, ‘অসুশীল’ আর প্রকৃতি প্রায় ‘বুনো’। কিংবা এই রাজধানী, সভ্যতার এই বাংলাদেশি কেন্দ্র, তার জনসমতলেও অনেক ঘুরেছেন তিনি। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে যমুনার চর, সাতক্ষীরা-বরিশাল থেকে তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড়—সব পথের ধুলা তাঁর পায়ে লেগেছে। সেই ধুলা জানিয়েছে সামান্য মানুষের বাঁচা-মরার অসামান্য ইতিহাস। সেই সব জানা থেকে সাহিত্য হয়, শিল্প হয়। সেই সুবাদে তাঁর সটান পা জোড়ার হাঁটাহাঁটির কথা মনে পড়ে। লেখক শিবিরের সংগঠক হিসেবে জেলায় জেলায় সফর করেছেন, চলে যাচ্ছেন আরও ভেতরে, পাকা সড়ক আর বিদ্যুতের খুঁটি ছাড়িয়ে আরও ৪০-৫০ মাইল ভেতরে। কখনো কারও মোটরসাইকেলের পেছনে বসে, কখনো বা নৌকায়। পা তাঁকে টেনে নিয়ে যেত গল্পের শিকড়ের কাছে, কাহিনির বীজের কাছে।

মনে পড়ে সেই পা জোড়ার একটি কাটা যাওয়ার কথা। সেই কাটা পা নিয়ে তিনি চড়ে বসেন হুইলচেয়ারে। যেমনটা তাঁর ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে দেখি: বিদ্রোহী ফকিরদের নেতা মুনশি বায়তুল্লাহ ইংরেজের গুলি খাওয়া বুক নিয়ে মরে যাওয়ার পর চড়ে বসেছিলেন কাৎলাহারের বিলপাড়ের পাকুড়গাছের মাথায়। তাঁর অধীন মানুষ ও প্রকৃতিকে সেখান থেকেই দেখে রাখতেন। ইলিয়াসও অন্তিমে হুইলচেয়ারে করে চেষ্টা করেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর উপন্যাসটি শেষ করতে। পারেননি, হুইলচেয়ারে বসে থাকতে পারেননি, পদাতিক জীবন ভুলতে পারেননি। মরে গিয়েছিলেন অকালে, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে।

এ রকম পায়ের ব্যথাকে শাসন করতে করতেই বলেছিলেন একদিন, ‘আজ মহাস্থানগড়ে যাব, ওই উপন্যাসটার কথা ভাবা শুরু করেছি।’ প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের কৈবর্ত বিদ্রোহ আর একাত্তরের সময়কার মহাস্থানগড় এলাকার পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখতে যাচ্ছেন। করে গেলে সেটা হতো ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’র পরে তাঁর ট্রিলজির শেষ খণ্ড। জীবন শ্রেষ্ঠকে সুযোগ দেয় না প্রায়ই। ওই গোলাবাড়ি থেকে মহাস্থানের পথে এখনো ‘খোয়াবনামা’র ফকির আর সন্ন্যাসীদের দেখা যায়। ইংরেজের বিরুদ্ধে ফকির মজনু শাহ আর ভবানী পাঠকের সন্ন্যাসীদের লড়াই শেষ হলেও, ইতিহাস জীবন্ত হয়ে হাঁটে মানুষের দেহবিজড়িত আচরণে। গোলাবাড়ি বাজারে এক সাধুর দেখা পেয়েছিলাম যিনি যৌবনে যমুনা নদীর তলায় ব্যাখ্যাতীত কোনো ঘটনা দেখে কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে এখন খালি পায়ে এখানে সেখানে ঘোরেন। এই লোকটির মধ্যে কি ‘খোয়াবনামা’র তমিজের বাপকে দেখা যায় না?

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হলো ‘খোয়াবনামা’। সে বছরই লেখক শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে একটা চমৎকার আলোচনা অনুষ্ঠান করে এর ওপর। অসুস্থ থাকায় পরে তাঁকে আলোচনার রেকর্ড শোনানো হয়। এ রকমই একদিন ঢাকায় আজিমপুর কলোনির বাসায় হাজির হলাম সন্ধ্যার দিকে। গিয়ে শুনি, হুইলচেয়ারে বসে একাই গোসল করতে গিয়ে সুস্থ পা-টাতে চোট পেয়েছেন। বসার ঘরে বসে আছি। ভাবি হুইলচেয়ার ঠেলে তাঁকে গোসল করিয়ে নিয়ে আসছেন। দেখছি সেই প্রাণবান মানুষটাকে। যে মানুষটা বহির্মুখী, প্রাণবান, উদ্দাম আড্ডায় তুখোড়। তেজি সেই মানুষটার মাথাভর্তি ধূসর চুল ছিল, গলার আওয়াজ ছিল গমগমে, আর ছিল প্রাণখোলা হাসি। সেই পদাতিক প্রাণবান মানুষটা তখন যুদ্ধাহত, ক্যানসারে একটা পা কাটা। ফুসফুসেও ছড়িয়েছে মরণাত্মক কর্কট ব্যাধি। আমাকে দেখেই খেপে গেলেন। কেন জাহাঙ্গীরনগর থেকে উজিয়ে তাঁকে দেখতে এসেছি। বললাম, ‘একটা মিটিং ছিল, ঢাকায় আসতেই হতো। ভাবলাম, আপনাকে দেখে যাই।’ শুনে আরও ক্ষিপ্ত হলেন। ভাবি পেছনে হুইলচেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে। ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। ইলিয়াস ভাই তখনো বলে চলেছেন, ‘তোমার কি গোঁফ হয়েছে, তুমি কি স্ট্যালিন হয়েছ? তোমাকে ছাড়াও বিপ্লব হবে।’ এতক্ষণে রাগের কারণ বুঝলাম। তিনি জানতেন, আমার তখন ফুসফুসে পানি জমেছে, ফুটা হয়েছে। বিশ্রামে থাকার নির্দেশ আছে। এ অবস্থায় কেন আমি ছোটাছুটি করছি, এই-ই তাঁর উদ্বেগ।

হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়ে এ রকমই তোপের মুখে পড়েছিলেন তাঁর অগ্রজ বন্ধু ও সতীর্থ কথাশিল্পী শওকত আলী। পা-হীন তাঁকে দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন। ইলিয়াস নরম আবেগ সইতেন না। ধমকে উঠলেন, ‘পা গেল আমার, তুমি কাঁদছ কেন?’

পায়ের ব্যথাটা আর ছিল না। কিন্তু অন্য ব্যথা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত। যে পা নেই, সেই পায়ের সাড়া পেতেন। মনে হতো হাঁটুর কাছে চুলকাচ্ছে কিংবা ঊরুর সেই ব্যথাটা বুঝি ফেরত এসেছে। আনমনে ডান হাতটা সেখানে নিয়ে যেতেন, কিন্তু হাতে কিছু ঠেকত না, কেবলই শূন্যতা। যেখানে ব্যথা, যেখানে পা-টা থাকার কথা, সেখানে তা নেই। সেটা তিনি ফেলে এসেছেন কলকাতার হাসপাতালে। সেবার কলকাতায় যাওয়ার পথে কোনো এক ভক্ত ছবি তুলতে চাইছিল তাঁর। ইলিয়াস নিষ্ঠুর। বললেন, ‘অ্যাই, ভালো করে তোলো, দেখো দুটো পা-ই যেন ওঠে। নইলে কেউ তো বিশ্বাস করবে না যে আমার দুটো পা-ই ছিল।’ শ্লেষ ও রসিকতার আড়ালে এভাবে দুঃখ ঢাকতেন। তাঁর চরিত্রদেরও রেহাই দিতেন না এই শ্লেষ ও রসিকতা থেকে। তাদের তুচ্ছতা, অসহায়ত্ব দেখাতেন ঠিকই, কিন্তু পড়ার পর পাঠকের মনে কোথায় যেন একটা মায়ার রেশ রয়ে যেত। নিরাবেগ ভাষার তলায় যেন দরদের শিরা বয়ে যেত, সেই দরদ পাঠককেও ছুঁত।

শেষ স্মৃতিটা ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারির। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন সমাবর্তন। তার মধ্যেই সমাবর্তনের মাইকে ঘোষিত হলো, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর নেই। আমি আর কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুপুরের বাসে চড়ে বসি। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল দেশে। সাভার থেকে ঢাকার পথের দুপাশে আদিগন্ত জলরাশি। বাসের দরজায় ঝুলছি আমরা দুজন। কথা নেই কারও। কেবল অফুরান জলরাশির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, নেই আর সেই মহিম ছায়া, মাঝে মাঝে আর কার কাছে যাব? তাঁর ‘থাকা’র মতো না-থাকাটাও এতই প্রবল। তাঁর সেই কাটা পায়ের মতো, যা নেই কিন্তু ঠিকই ব্যথা দেয়।

সেদিনও বোধ হয় আকাশ মেঘলাই ছিল। বিকেলের দিকে আজিমপুর সরকারি কলোনিতে নিচতলার বাসায় পৌঁছালাম। সেই বসার ঘরে ঢুকলাম, যেখানে মহাশ্বেতা দেবীর আসা উপলক্ষে আড্ডায় কয়েক মাস আগেই হাজির হয়েছিলাম। সেই ঘর, যেখানে বদরুদ্দীন উমরের দেওয়া ক্ল্যাসিকাল সংগীতের ক্যাসেট থেকে শুনিয়েছিলেন। ঢাকার বিদায় পর্ব শেষে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে বগুড়ায়। কী মনে হলো, বললাম, আমিও যাব। একটা লাশবাহী গাড়ি আর একটা মাইক্রোবাস। ৯টা কি ১০ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম আরিচা ঘাটে। সরকারিভাবে একটা বিশেষ ফেরি রাখা ছিল।

খুব কুয়াশা আর শীত। তার মধ্যে অনেক রাতে ফেরির ছাদে উঠে এসেছি। দেখি, আরেক দিকে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আছেন ইলিয়াসের ছোট ভাই, অনুবাদক ও খ্যাতনামা অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন। ওই হিম শোকের রাতে আমরা কোনো কথা বলিনি। একমনে ফেরির উঁচু ছাদের থেকে তাকিয়ে ছিলাম ফেরির ফ্লাডলাইটের আলোয় ঘোলা স্রোতের ঘূর্ণির দিকে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। এই যমুনা নদী চলে গেছে তাঁর গ্রামের বাড়ির কাছ দিয়ে। যমুনা থেকে করতোয়া ও বাঙ্গালী নদী যার আরেক নাম মহিষাবান, তা গিয়ে মিশেছে ‘খোয়াবনামা’র কাৎলাহার বিলে, যার পাড়ে বসে পোড়াদহের মাছের মেলা, যে মেলায় বিশাল বাগাড় মাছেরা বিক্রি হয়, যারা নাকি ছিল ফকির মজনু শাহের শিষ্য মুনশি বায়তুল্লাহর শিষ্য বিদ্রোহী ফকির। মনে হলো, মৃত্যুর পরের এই ঘরে ফেরার যাত্রা যেন তাঁর সাহিত্যিক যাত্রারই অনুকরণ। উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতির যে ভাঙা সেতু জোড়া লাগাতে চেয়েছেন, ফিরতে চেয়েছেন দেশের উৎসভূমিতে; অন্তিম দিনে নদী বেয়ে বেয়ে তিনি সেখানেই ফিরে যাচ্ছেন। ক্লান্তি কি জুড়াল পথিকের? যৌবনে কবিতায় লিখেছিলেন তিনি,

‘‘ক্লান্ত চোখে ক্লান্ত চোখের পাতা’
তারো চেয়ে ক্লান্ত আমার পা
যে ঘর দেখি, “একটুখানি বসি?”
জবাব আসে, “না এখানে না।’’

পরদিন দুপুরের পর বগুড়ার ভাই পাগলা মাজার কবরস্থানে তাঁর কবর হয়। কবরস্থানের মূল দরজা দিয়ে ঢুকলেই বামের প্রথম কবরটি বাবা-পুত্রের: বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তার পরেরটি একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধার। এবং আশ্চর্য কাকতাল, তার পাশের কবরটি আমার বড় চাচার, তিনি গত হয়েছেন গত বছর। ইলিয়াসকে কবরে শোয়ানোর পর কাউকে কিছু বলতে বলা হলো। তাঁর ছেলে পার্থ এবং দুই ভাই কিছু বলতে পারছিলেন না। কেউ একজন আমাকে কিছু বলতে বললেন। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যা বলেছিলাম তা আজও বিশ্বাস করি: তাঁর অকালমৃত্যুর ক্ষতি যেমন পূরণ হওয়ার নয়, তেমনি তাঁর সৃষ্টিকর্ম সাহিত্যের মানচিত্রে বাংলাদেশকে ক্রমশ উজ্জ্বল করে যাবে।

‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। গল্পটায় ঘোরগ্রস্ত একটি যুবকের ঘুম হয় না। তার কেবলই মনে হয়, ‘আম্মার ঘরে কী যেন ফেলে এসেছি’। যুবকের নামটাও তাঁর নামের সঙ্গে মেলে, ‘রঞ্জু’। রঞ্জু কী যেন হারিয়ে ফেলেছে সে তা জানে না। কিন্তু তার ফাঁকা লাগে, একলা লাগে, শোক হয়। হারানোর এই অনুভূতি শিল্পীকে চালিত করে। আজীবনের কাজে সে তা খোঁজে। হয়তো তা মায়ের কোলের পরম শান্তি ও নিশ্চয়তা। নাড়ির সেই বন্ধন যৌবনে আমরা যা হারিয়ে ফেলি। তারপর না-বুঝেই খুঁজি অন্য কোনো মানুষে, প্রকৃতিতে, দৈবে, ইতিহাসে। ইলিয়াসও কি ‘আম্মার ঘরে হারিয়ে ফেলা’ সেই পরম বন্ধন খুঁজে গেছেন মানুষের ভেতর, ইতিহাসের মধ্যে, মিথ ও প্রবাদে এবং মনের অন্ধকার প্রদেশে?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]