আমরা দুঃখিত, লজ্জিত, হতভম্ব

সুলতানা কামাল

আমার দেশেরই একটি জনগোষ্ঠী শুধু ধর্মপরিচয়ের কারণে তাদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘ্নে, নিরাপদে ও আনন্দের সঙ্গে উদ্‌যাপন করতে পারল না। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া এই দেশে এমন ঘটনা শুধু দুঃখজনকই নয়। এ দেশের মূল চেতনা ও নীতি ছিল—একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন ও দেশটিকে সব মানুষের দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা যাঁরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ বলে দাবি করি, তাঁদের সবার জন্য এ রকম সহিংসতার ঘটনা লজ্জাজনক।

মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষ এ রকম ন্যক্কারজনক, হীন কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত করতে পারে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরাজয়ের গ্লানি বোধ করছি।

১৩ বছর ধরে ‘কোনো রকম শক্তিশালী বিরোধী দলবিহীন’ অবস্থায় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার এ রকম ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ঘটনা প্রতিহত করতে পারল না, এটিও আমাদের হতভম্ব করে দিয়েছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির যে সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো হয়েছিল, গত ১৩ বছরে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো শক্ত ভিত তৈরি হয়নি। সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় তা আবার প্রমাণিত হলো। দুর্বৃত্তদের পরিকল্পিত সহিংসতা রুখে দিতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা।

একের পর এক হামলা হলেও এসবের কোনো বিচার হয় না। এসব হামলা প্রকৃতপক্ষে মানবতার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অপরাধ—বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সেই বোধের অভাব রয়েছে। রাষ্ট্রের মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রচিত হয়েছিল কয়েক দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুসহ অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা-কর্মীদের ত্যাগ–তিতিক্ষা এবং প্রাণের বিনিময়ে। এসব ব্যক্তি ও মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ এবং অশ্রদ্ধা প্রদর্শনও এ ধরনের হামলার নেপথ্যে কাজ করে। এসব হামলাকে দেখা হয় বড় দুই রাজনৈতিক জোটের পাল্টাপাল্টি খেলা হিসেবে। কোনো ঘটনা ঘটলেই দেখি পারস্পরিক দোষারোপ করার প্রবৃত্তি। আসল অপরাধীদের চিহ্নিত না করে একে অপরকে দায়ী করার অপচেষ্টা। তাই প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদি ২০০১ সাল থেকেও একটি সময়সীমা ধরি, তাহলে দেখা যাবে একটি সাম্প্রদায়িক আক্রমণের আজ পর্যন্ত কোনো বিচারের রায় হয়নি। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষণা, নির্দেশনা ও আশ্বাস আসা সত্ত্বেও কোনো অপরাধীর শাস্তি হয়নি। এককথায় বিচারহীনতার প্রকট দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে এই অভিজ্ঞতাগুলো।

যাঁরা জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ‘ভোট ভিক্ষা’ করে ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করেন, তাঁরা দেশের অভিভাবক। জনগণের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নিরাপত্তা বিধান করার মূল দায় তো তাঁদেরই। তবে গণতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ জনগণেরও দায়দায়িত্ব থাকে। সেই দায়িত্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে পালন করা সম্ভব হয় না।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা, তাদেরও দায়বদ্ধতার জায়গা কোনো অংশে কম নয়। একটি সংস্কৃতিমান সমাজে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বিরাজ করে। সেখানে প্রতিটি নাগরিকের দায় বর্তায় অন্যের অধিকার বা মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার ওপর। যদি ক্ষুণ্ন হয়, তার প্রতিকার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হওয়ার দায়িত্বও তাঁদের রয়েছে। দুঃখজনকভাবে এর অভাব দেখছি।

এবার দেখা গেল, আগের মতোই মোটামুটিভাবে আক্রমণকারীরা একই কৌশল অবলম্বন করেছে—নিজেরাই অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া, ধর্মীয় স্থাপনাকে ব্যবহার এবং সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে নির্বিচারে ‘টার্গেট’ জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা করা। এসব ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা বিধানে গাফিলতি, অদক্ষতা ও উদাসীনতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও নির্বাচিত প্রতিনিধি, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে না যাওয়ার রীতি এবারও বহাল। কেউ এ ঘটনায় খুব বিচলিত হয়েছেন বলে তাঁদের ভাষা বা ভাব–ভঙ্গিতে মনে হয় না।

এসব সহিংসতার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রথম করণীয় হচ্ছে, সত্যকে নিরপেক্ষভাবে দেখার মানসিকতা তৈরি করা। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির আত্মসমীক্ষার সৎ সাহস দেখানো এবং কেন আমরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে প্রতিরোধ করতে এভাবে ব্যর্থ হলাম, তার সঠিক কারণ চিহ্নিত করে নিজেদের দুর্বলতাগুলোকে অপসারণ করা দরকার। একটি মানবাধিকারবোধসম্পন্ন, পরমতসহিষ্ণু, পরিচয়নির্বিশেষে সবার অধিকার ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সমাজ গঠনে অগ্রাধিকার দিয়ে গুরুত্ব সহকারে কাজ করা দরকার। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।