চশমার সঙ্গে পরিচিত নয় এমন মানুষ খুব কমই আছে। কেউ চোখের সমস্যার জন্য চশমা ব্যবহার করেন, আবার কেউ ফ্যাশনের জন্য। ছোট, বড় বা প্রবীণ—অনেকেই ব্যবহার করেন। যাঁরা চশমা ব্যবহার করেন, তাঁদের জীবনে ঘটে চশমা নিয়ে নানান ঘটনা, যা স্মরণীয় করে রাখার মতো। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।
আমার চশমা ব্যবহার বেশিদিন নয়। এই ২০১৫ সালের শুরুর দিকের কথা। চোখের সমস্যা নিয়ে গেলাম চিকিৎসকের কাছে। চোখ দেখার পর চিকিৎসক বললেন, একটু সমস্যা আছে। তাই কিছু ওষুধ, চোখের ড্রপ ও চশমা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। কথাটা শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকেও চশমা ব্যবহার করতে হবে! কিন্তু কিছুই করার ছিল না। চিকিৎসকের পরামর্শে চশমা নিয়েই বাড়ি ফিরলাম।
গ্রামে গিয়ে চশমা পরে যখন বের হলাম, তখন সবাই আমার দিকে কেমন যেন ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার গ্রামে আমি কোনো নতুন অতিথি, নয়তো ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী, তা আমি নিজেও অনুমান করতে পারছি না। যাহোক, সবার তাকানো সহ্য করেই চলছি। কিন্তু এবার বন্ধুদের থামায় কে? আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তারা কা-না কা-না বলে হাসাহাসি করে একাকার। কে থামায় তাদের? আমি শত বলেও তাদের বোঝাতে পারছি না যে আমার চোখের সমস্যার জন্য চশমা ব্যবহার শুরু করেছি। যাহোক, তাদের কথার অত্যাচার সহ্য করতে হলো।
তখন সবে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। থাকতাম কলেজ হোস্টেলেই। এক ছুটিতে বাড়ি আসছিলাম বাসে করে। যখন বাস থেকে নেমেছি আমি আর আমার বন্ধু, তখন আমার কেমন যেন লাগছে। বাম দিতে ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছি। কেন এমনটা হচ্ছে বুঝতেই পারছি না। মনে হচ্ছে, কেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। পাশেই ছিল এক থবলা কাদা, গিয়ে পড়লাম সেই কাদায়। জুতা ও প্যান্টে কাদা লেগে একাকার। হাত দিয়ে দেখি আমার চশমার বাম পাশের গ্লাসটা উধাও। ও... হ, এই তাহলে কাহিনি! খুঁজতে লাগলাম আশপাশে, কিন্তু পাচ্ছি না। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম বাসে। বাস প্রায় চলে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে নাগাল পেলাম। দেখি বাসে আমি যে সিটে বসে ছিলাম, চশমার গ্লাসটা সেখানেই পড়ে আছে। গ্লাস চশমায় লাগিয়ে কাদামাখা জুতা ও প্যান্ট কিছুটা ধুয়ে ফিরলাম বাড়ি।
এ ছাড়া যাঁরা চশমা ব্যবহার করেন, তাঁরাই বলতে পারবেন চশমার ওপর দিয়ে যে কত রকমের ধকল যায়। এখনই একজন এসে বলবে, দেখি চশমায় কেমন লাগে আমায়। কেউ আবার জিজ্ঞাসা করবে, পাওয়ার কত? আবার কেউ চশমা লুকিয়ে রেখে বলবে কিছু না খাওয়ালে চশমা দেওয়া যাবে না। আর চশমা ভেঙে যাওয়ার ঘটনা নিত্যদিনের। যখন ছোটদের কোলে নিই, তখন তাদের প্রথম চোখ পড়ে চশমার দিকে। চশমা হাতে নিতে কত জোড়াজুড়ি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনোক্রমে হাতে নিতে পারলে দুটি ডাঁটি ধরে টান দেবে। হয় চশমা বাঁকা হয়ে যাবে নয়তো ভেঙে যাবে।
আপনারা সবাই জানেন, ছাত্রদের হাফ পাস নিয়ে বাসমালিকদের সঙ্গে বেশ ঝামেলা হয়েছিল। দেখা গেছে, ছাত্রদের কাছ থেকে সহজে হাফ ভাড়া নিতে চাইত না। আবার নিলেও সঙ্গে স্টুডেন্ট আইডি কার্ড না থাকলে কোনোক্রমেই হাফ পাস নিত না। সেই ঝামেলার মুহূর্তে আমি অনেক চড়েছি বাসে। কিন্তু কখনো আমার কাছে হাফ পাসের জন্য ঝামেলা করেনি। তার প্রধান কারণ হলো, আমার চোখের চশমা। আমার চোখে চশমা মানে হলো, আমি একজন ছাত্র। যার কারণে আমি হাফ ভাড়া দিলে সঙ্গে সঙ্গে নিয়েছে। কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেনি। বরং মামা বলে আরও হাসিমুখে ভাড়া নিয়ে গেল। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, চোখে চশমা থাকলে আলাদা একটি পরিচয় বহন করে।
চোখে চশমা থাকলে সমাজে একটু বেশি মূল্যায়ন পাওয়া যায়। কারণ, চশমাওয়ালা লোকদেরকে সবাই মনে করে অনেক শিক্ষিত। চশমার কারণে যেমন মূল্যায়ন করে, তেমনি আবার অনেকে মনে করে, সে চশমা পরে মানে তার চোখে সমস্যা আছে। তার মানে সে চোখে কম দেখতে পায়। অর্থাৎ অনেকে অন্ধও বলে থাকে। তা ছাড়া চশমা ব্যবহার একটি বিরক্তের বিষয়। যাঁরা ব্যবহার করেন, শুধু তাঁরাই বলতে পারবেন।
আমরা যে চশমা ব্যবহার করি, তার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ইতিহাসবিদেরা প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার চিত্রিত প্রমাণ হায়ারোগ্লিফিকসে মানুষের চশমার ব্যবহার আবিষ্কার করেছেন। সাধারণত কোনো জিনিসকে পরিষ্কার দেখার জন্য ওই সময় বিভিন্ন ধরনের কাচের প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য চোখে কাচের ব্যবহারের লিখিত প্রমাণ রয়েছে। রোমান সম্রাট নিরোর একজন শিক্ষক ওই সময়ের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনার সঙ্গে দূরের জিনিস পরিষ্কারভাবে দেখার জন্য জলমিশ্রিত একধরনের কাচ চোখে লাগানোর কথা বলেছেন। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরসদের লড়াই উপভোগ করতে গিয়ে নিজের আসনে বসে রোমান সম্রাট নিরো বিশেষ কাচ চোখে লাগাতেন।
সত্যিকারের চশমা বলতে যা বোঝায়, তা প্রথম প্রচলিত হয় ইতালিতে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। ওই সময় চোখে আতশি কাচ লাগিয়ে ছোট জিনিসকে দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসার জন্য চোখে চশমা ব্যবহার করার নজির রয়েছে ইতিহাসে। ১২৮৬ সালের দিকে ইতালিতে প্রথম চশমা তৈরি হয়েছিল। জিওর্দানো দা পিসা নামের এক ব্যক্তি প্রথমবারের মতো চশমা তৈরি করেছিলেন। দা পিসার তৈরি চশমার উদ্দেশ্য ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার প্রতিকার। আধুনিক চশমার উদ্ভাবক হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে গিরোলামো সাভোনারোলা নামের এক ইতালীয়কে। তিনি ১৭২৭ সালে বর্তমান সময়ের চশমার প্রাথমিক নকশাটি তৈরি করেন। তার আগে দুই চোখের দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা এড়াতে চোখের সামনে কাচ ধরা হতো। সাভেনারোলার নকশাটিকে স্থির রেখে এরপর চশমার নকশা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এটি পায় আধুনিক চেহারা।