আর ফিরে আসেনি

শাফী ইমাম (রুমী)
শাফী ইমাম (রুমী)

১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ এক চিকিৎসক তাঁর তত্ত্বাবধানে সদ্য ভূমিষ্ঠ এক শিশু সম্পর্কে তার মাকে বলেছিলেন, ‘এটা ১৯৫১ সাল। ২০ বছর পরে ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।’ সেদিনের সেই শিশু ১৯৭১ সালে তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। অত্যন্ত মেধাবী, উদ্যমী ও প্রাণবন্ত তরুণটির জীবনে ডাক্তারের সেই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের পথেই ছিল। স্টার মার্কস নিয়ে ১৯৬৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে ভর্তি হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যে আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে তার ভর্তি সম্পন্ন হয়। সেপ্টেম্বর ’৭১ থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিশ্চিত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে সে পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় স্বাধীনতার বেদিমূলে।
সেই তরুণটি শাফী ইমাম (রুমী) বীর বিক্রম—স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ এবং জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ সন্তান রুমী বাবা-মায়ের সুযোগ্য পরিচালনায় হয়ে ওঠে স্পষ্টভাষী, সাহসী এবং দৃঢ়চিত্তের অধিকারী— এককথায় তারুণ্যের প্রতীকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক প্রস্ফুটিত হতে থাকে। রুমীর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা, অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, পরিপক্বতা ও নির্ভীক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধা, ডাক্তার, মেজর, ক্যাপ্টেনসহ সবার প্রশংসনীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলোতে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নিষ্ঠুর গণহত্যার আশ্রয় নেয়, তার নজির ইতিহাসে বিরল। তাদের কাপুরুষোচিত হামলার প্রতিবাদে বয়স, ধর্ম, বর্ণ ও দলমত-নির্বিশেষে বীর বাঙালি সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রুমী ছিল তাদেরই একজন। আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে যাওয়ার পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বিষয়ে মাকে রাজি করায় এই বলে: ‘আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা?’ মা জাহানারা ইমাম তাকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দেন।
বাবা-মায়ের অনুমতি-আশীর্বাদ নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৪ জুন রুমী প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মেলাঘরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে। প্রায় দেড় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে অন্যান্য গেরিলা যোদ্ধার সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করে এবং গেরিলা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। রুমীর সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক বলেন, ‘রুমী খুব বেশি দিন যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেনি। সে ঢাকা থেকে রওনা করেছিল জুন মাসের মাঝামাঝি, ট্রেনিং শেষে ঢাকায় ফিরে আসে আগস্ট মাসে। কিছু অ্যাকশনের সঙ্গে জড়িত থাকার পর ২৯ আগস্ট সে পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়ে যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা কতগুলো অ্যাকশন করছে, সেটা বড় কথা নয়। যদি একটা অ্যাকশনে সে সাহস ও বীরত্ব দিয়ে সফল হতে পারে, সেটাই বড় কথা। রুমী ঢাকার অ্যাকশনে অনেক বেশি সাহসের পরিচয় দিয়েছিল।’ এ রকমই একটি সাহসিকতাপূর্ণ অপারেশন ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ আগস্ট, যেদিন রুমীসহ আরও পাঁচজন গেরিলা সদস্যের একটি গ্রুপ ধানমন্ডির ১৮ ও ৫ নম্বর রোডে দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন চালান। গ্রুপের সদস্যরা ছিলেন হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, বদিউল আলম (শহীদ) বীর বিক্রম, মরহুম কাজী কামালউদ্দিন বীর বিক্রম, কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম, রুমী (শহীদ) বীর বিক্রম, সেলিম আকবর বীর প্রতীক। এ অপারেশনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপারেশনের একপর্যায়ে পলায়নকালে পাকিস্তানি আর্মিদের একটি জিপ তাদের গাড়ি অনুসরণ করলে রুমী তার স্টেনগানের বাঁট দিয়ে পেছনের কাচ ভেঙে প্রথমে এবং তার দুই পাশ থেকে বদি ও স্বপন ফায়ার করা শুরু করলে চালক গুলিবিদ্ধ হয়। ফলে জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। রুমীর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে সেদিন সব গেরিলা যোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। রুমীকে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই জামী, বন্ধু হাফিজ, চাচাতো ভাই মাসুমসহ তাদের বাসভবন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রুমী তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কোনো কিছু স্বীকার করতে নিষেধ করে, সব দায়ভার নিজে বহন করে। অনিবার্য পরিণতি অনুধাবন করে ধরা না পড়া অন্য সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষার জন্য সহ্য করে যায় অমানুষিক নির্যাতন। একই সময়ে ধরা পড়া রুমীর সহযোদ্ধা মাসুদ সাদেক জানান, চরম অত্যাচার সহ্য করেও রুমী কারও নাম প্রকাশ করেনি। দুই দিন ধরে অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর পরিবারের অন্য সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হলেও রুমীকে ছাড়া হয়নি। ফিরে আসার সময় বাবা শরীফ ইমাম রুমীর কথা জিজ্ঞেস করলে পাকিস্তানি কর্নেল জানায়, রুমী যাবে এক দিন পরে, ওর জবানবন্দি নেওয়া শেষ হয়নি। পরের সেই দিনটি আর আসেনি।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জাহানারা ইমাম রুমীর জীবনীগ্রন্থ লেখার কাজ শুরু করেন। শুরুতেই ১৯৫১ সালে সদ্য ভূমিষ্ঠ রুমীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ডাক্তারের মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে লেখেন—রুমী ১৯৭১ সালে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেনি, তবে কিছু একটা হয়েছিল। সে দেশের জন্য শহীদ হয়েছিল। আজ ২৯ আগস্ট। একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে রুমীসহ যাঁরা আটক হয়েছিলেন, যাঁরা কখনোই ফিরে আসেননি, সেই সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
আবিদ হোসেন: সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক, শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।