প্রতিবছরের মতো এবার ‘বিশ্ব দর্শন দিবস’ উদ্যাপন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেসকো প্রথম এ দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। নিয়ম অনুযায়ী, নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার এ দিবস উদ্যাপন হয়ে থাকে। সেই হিসেবে আজ ১৮ নভেম্বর বিশ্ব দর্শন দিবস। মূলত মানবজাতির ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ সাধনে প্রতিটি সংস্কৃতি এবং ব্যক্তির মূল্যবোধ অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু পৃথিবীর মধ্যে মানবজাতিই সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত, তাই সত্যিকারের মানুষের মানবিক চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
সাধারণ অর্থে আমরা যা দেখি, যেভাবে দেখি, অথবা ইতিবাচকভাবে দেখি নাকি নেতিবাচকভাবে দেখি, আক্ষরিক অর্থে সাধারণ মানুষের কাছে সেটিই দর্শন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী চিন্তাবিদদের মতে, ইংরেজি ফিলোসফির (philosophy) বাংলা প্রতিশব্দ ‘জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা’। অতএব, এটি সুস্পষ্ট যে ব্যক্তির অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মন এবং ভাষা সম্পর্কে সাধারণ এবং মৌলিক প্রশ্নগুলোর অধ্যয়নই সার্বিক অর্থে ‘দর্শন’। আর যাঁরা এসবের চাষাবাদ করেন, তাঁরাই ‘দার্শনিক’ হিসেবে স্বীকৃত।
দর্শন কেবল কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসনই নয়; বরং আপাতদৃষ্টিতে মানবসভ্যতার প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে ‘দার্শনিক’ হিসেবে বিবেচিত। কেননা, আজকাল প্রায় প্রত্যেকেই তার জগৎ, জীবন ও দর্শনকেই নিয়েই ব্যস্ততম সময় পার করে। প্রাতিষ্ঠানিক বা অ-প্রাতিষ্ঠানিক— উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিটি মানবজাতিই তাদের স্বকীয় চিন্তা-চেতনায় বেড়ে ওঠে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে প্রায় প্রতিনিয়তই সে শেখে; অবচেতন মনেই সেই শিখনকে অনুশীলনও করে, যা একদিন সেই আদর্শ তার পরবর্তী প্রজন্মের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে থাকে। এমনি করেই তার সেই স্বয়ংক্রিয় মূল্যবোধ মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নেয়।
একটি ‘ইতিবাচক দর্শন’ যেমন পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে, রূপান্তরিত করতে পারে; ঠিক তেমনি সদালাপ, আন্তসাংস্কৃতিক সংলাপও একটি জাতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উদ্দীপিত করে তুলতে পারে। একটি ইতিবাচক দর্শন আমাদের আরও সহনশীল, শ্রদ্ধাশীল সমাজ গঠনে সহায়তা করে। আমি ও আমরা বিশ্বাস করি, ‘বিশ্ব দর্শন দিবস’ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধা জানানোর এক অন্যতম উৎসও বটে! যেহেতু আমরা বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ; তাই আমাদের সুচিন্তা ও মতপ্রকাশের মধ্য দিয়ে সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে। একটি সুন্দর জাতি গঠনের প্রত্যয় হোক আমাদের সবার।
সময়ের বিবর্তনে আমরা হয়তো একদিন হারিয়েই যাব; কালের বিবর্তনে স্মৃতিচিহ্নগুলো ইতিহাস হয়ে বলবে কথা সেদিন! আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আজকের আমাদের সেদিন মনে রাখবে তো? সেদিন কি আজকের এ আয়োজন সাক্ষ্য দেবে উত্তরসূরিদের? আমরা যদি ইতবাচক দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাত পারি, তবে আশা করা যেতেই পারে বৈকি!
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার মোক্ষম সময় আজ এসে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী হওয়ার কারণেই হিটলার যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য ঠিক তেমনি ইতিবাচক চিন্তা করেছিলেন দার্শনিক আর এম হেয়ার এবং বাট্রান্ড রাসেল এবং মানবজাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বিশ্ব সরকারের ধারণা প্রচার করেন। এ জন্যই আজও তাঁরা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
আমরা জানি, শান্তির পূর্বশর্ত হলো সত্য জ্ঞান। যার ফলে একজন ব্যক্তি আচরণগতভাবে সংযত হয়। এ জ্ঞান যদি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, তাহলে শান্তিময় হবে বিশ্বসমাজ। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতে ‘Knowledge is virtue and virtue is knowledge.’ জ্ঞানই পুণ্য এবং পুণ্যই জ্ঞান। একজন মানুষ যদি জ্ঞানী হন, তাহলে তিনি পুণ্য কাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। পক্ষান্তরে, মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতে, মানুষ যদি শান্তিতে থাকতে চায়, তাহলে একটা শক্তিশালী সংগঠন খুবই জরুরি, যার কথা শুনতে সবাই বাধ্য থাকবে। আর এ জন্য প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব, সৎ উদ্দেশ্য ও গণমানুষের সমর্থন, যা কেবল ইতিবাচক দর্শনের দ্বারাই সম্ভব।
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সাফল্যে বিশ্ব এগিয়েছে; তবে অশান্তি, অস্থিতিশীলতা, অন্যায়, সন্ত্রাস, সহিংসতা, অনৈতিকতা, নিরাপত্তাহীনতা মোটেই কমেনি। এসব থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে দর্শনের শিক্ষা ও অনুশীলন। কেননা দর্শনের জীবনবোধ, নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, নান্দনিকতা, যুক্তিবোধ ও মননশীলতা বিশ্বকে নানাবিধ সংকট ও সমস্যা থেকে মুক্ত করে মানবজাতিকে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের সন্ধান। তাই, ব্যক্তিজীবনে আমরা যে যেই পেশার মানুষ হই না কেন, ইতিবাচক দর্শনের চর্চা করা যেন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। কেননা, ইতিবাচক দর্শনেই পারে আমাদের সত্যের পথ দেখাতে! ইতিবাচক দার্শনিকদের হাত ধরেই রচিত হবে এক শান্তিকামী সমাজ! এমনি করেই এগিয়ে যাক আগামী প্রজন্ম; সার্থক হোক বিশ্ব দর্শন দিবস।
লেখক: তাপসী ইসলাম, বিভাগীয় প্রধান, দর্শন বিভাগ, মহাস্থান মাহী সওয়ার ডিগ্রি কলেজ, বগুড়া।