আমিসহ আরব তরুণদের অনেক প্রজন্ম যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে কিংবা কাজ করতে এসে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বড় হওয়ার সম্ভাবনা এবং সামাজিক সাম্যের ঈপ্সিত স্বাদ পেয়েছে। আমাদের মতো যারা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা অথবা রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা থেকে এসেছি, তাদের জীবন দুই ধরনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। আমেরিকায় এসে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা এবং সামাজিক চাপমুক্ত জীবন যাপন করা আমাদের কাছে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল। কার্যকর গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গঠনমূলক সুশীল সমাজের গুরুত্ববিষয়ক যেসব শিক্ষা আমি এখান থেকে পেয়েছি, তা স্বদেশের মানুষের কাছে জানানোর সময় আমি খুবই উচ্ছ্বসিত হতাম।
এসবের মানে এই না যে মার্কিন ব্যবস্থাগুলোর ব্যর্থতা সম্পর্কে আমি একেবারে সচেতন ছিলাম না। বিশেষ করে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিষয়ে মার্কিন ব্যবস্থায় যেসব ব্যর্থতা আছে, তা সম্পর্কে আমি যথেষ্ট সজাগ ছিলাম। প্রাক্তন কনফেডারেট স্টেটগুলোতে চাপিয়ে দেওয়া বর্ণবাদভিত্তিক ‘জিম ক্রো ল’ নামক কালাকানুনের কথা আমি সব সময় স্মরণে রেখেছি। আফ্রিকান-আমেরিকানদের সম–অধিকারের স্বপ্ন দেখানো মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র হত্যাকাণ্ডের কথাও আমার মনে ছিল। তবে আমি সব সময়ই আশাবাদী ছিলাম, আমেরিকার হাতে এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাভিত্তিক শাসনযন্ত্র আছে, যা দিয়ে তারা নিজেদের শুধরে নিতে পারে। আমার সেই আশাবাদ এখনো অক্ষুণ্ন আছে।
যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে, সেটি হলো স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি যে দেশটি এত অনুরক্ত, সেই যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে কীভাবে এত নিষ্ঠুর ও নিবর্তনমূলক পন্থাকে স্বীকৃতি দেয়? ভিয়েতনাম ও ইরাক যুদ্ধে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সেই রূপ আমরা দেখেছি। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নীতি এক রকম এবং পররাষ্ট্রনীতি আরেক রকম—এ সাংঘর্ষিক নীতিগত অবস্থান আরব বিশ্বের দেশগুলোসহ অন্য দেশগুলোকে বিভ্রান্ত করে। অনেক আরব তরুণ আছে যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে চায় কিংবা ইতিমধ্যে নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে অপছন্দ করে।
আরব ও মুসলমানরা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণ হিসেবে প্রথমেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে সামনে এনে থাকে। ইহুদি জাতির ওপর নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছিল এবং সে কারণে তাদের প্রতি সবার সহমর্মিতা থাকা খুবই ন্যায্য বিষয়; কিন্তু তাদের সেই ঐতিহাসিক দুর্দশা দিয়ে ফিলিস্তিনের ওপর নির্যাতনকে কেন ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকে, তা আরব ও মুসলমানদের কাছে বোধগম্য নয়।
ইসরায়েলের সমর্থনে আমেরিকার নিঃশর্ত একপেশে অবস্থান নেওয়া স্বতঃসিদ্ধ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আইনপ্রণেতার কাছে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া অ্যান্টি-সেমিটিজমের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর সমার্থক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও ভয়ানক বিষয় হলো ইসরায়েল ফিলিস্তিনের সংঘাতকে মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যবোধের সংঘাত হিসেবে সামনে আনার চেষ্টা হয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া, মুসলিম দেশগুলোর নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ট্রাম্পের ‘ডিল অব সেঞ্চুরি’ নামক তথাকথিত শান্তি চুক্তি চাপিয়ে দেওয়া মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ওপর মুসলমান ও আরবদের চরম অনাস্থা তৈরি করেছে।
সর্বশেষ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ঘটনায় যেভাবে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হয়েছে এবং সে বিষয়ে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছে, তা শুধু দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে অপমানের বোধ জাগ্রত করেনি, তা ইসরায়েলি আরব দেশ থেকে শুরু করে সমগ্র আরব বিশ্বের এমনকি অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিম দেশের মানুষের মনে আঘাত হেনেছে। অনেক দিন পর সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষ নেওয়া তরুণেরা এই ইস্যুতে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিয়েছে।
সবাই আশা করেছিল ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে এসে বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু গাজায় হামলার পর সবাইকে হতবাক করে বাইডেন তাঁর পূর্বসূরিদের সেই মুখস্থ মন্ত্র আওড়ালেন, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’। এটি বলার সময় তিনি উল্লেখ করলেন না, ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড দখল করে যাচ্ছে এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন দেশ গঠনের অধিকার আছে।
গাজায় সহিংসতার আসল কারণ শনাক্ত করে সমস্যার স্থায়ী সমাধান না দিয়ে সেখানে ফের যাতে সহিংসতা না হয় সে জন্য আমেরিকা টাকা ঢেলে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন সমর্থন করার কারণে আরব ও মুসলমানদের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। এতে উগ্রপন্থী চেতনা বিস্তার লাভ করছে। সর্বশেষ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় যে ৬৭ শিশু নিহত হয়েছে, তাদের জন্য শোক প্রকাশ করা ছাড়া আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই।
এরপরও আমি আশা করি, আমেরিকায় গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের মূল্যবোধের দাম এখনো শেষ হয়ে যায়নি। জো বাইডেন যদি পররাষ্ট্রনীতিতে এই দুটি মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেন এবং তার ভিত্তিতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে অগ্রসর হন, তাহলে আবার আমেরিকা সত্যিকার অর্থে বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মোহাম্মাদ এলবারাদি শান্তিতে নোবেলজয়ী ও আন্তর্জাতিক আণবিক জ্বালানি সংস্থার ইমেরিটাস মহাপরিচালক