ঢাকা শহরে একসময় ‘গেটলক সিটিং সার্ভিস’ লেখা বাস সার্ভিস বেশ চোখে পড়ত। এই বাস সার্ভিসের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব বাসের গেট বন্ধ থাকা, নির্দিষ্ট স্টপেজে থামা, নির্ধারিত সিটের বেশি দাঁড়িয়ে যাত্রী না নেওয়া ও যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা না করার প্রতিশ্রুতি ছিল। সাধারণ বাসের চেয়ে এই সার্ভিসের ভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি। আমাদের দেশে যা হয়, কেউ কথা রাখে না। এখানেও তা-ই হয়েছে। যাত্রীরা দেখলেন, বাসের গেট যেখানে-সেখানে খোলা হয়। যাত্রী নামানো ও ওঠানো হয়। সিটের বেশি যাত্রীরা দাঁড়িয়েও যান।
আমাদের দেশে পরিবহনের তুলনায় যাত্রীর যা চাপ, তাতে এটাই হয়তো বাস্তবতা। কিন্তু যাত্রীদের তো বিশ্বাস ভঙ্গ ঘটে গেছে। ‘গেটলক সিটিং সার্ভিস’ আর সাধারণ বাসের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য না থাকে, তবে তাঁরা বেশি ভাড়া দিয়ে উঠবেন কেন! বিশ্বাস হারিয়ে অনেক যাত্রী তখন এসব বাসে ওঠা বন্ধ করে দেন। তখন যাত্রীদের বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য কোনো এক বাস কোম্পানি নাকি লিখেছিল, ‘আল্লার কসম গেটলক সিটিং সার্ভিস’। এরপর ওই বাস সার্ভিসের প্রতি যাত্রীদের আস্থা ফিরেছিল কি না জানি না।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার ঢেউ বাংলাদেশে স্পর্শ করা থেকে শুরু করে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ার এই দেড় বছরের বেশি সময়ে ‘লকডাউন’ নিয়ে যা হয়েছে, তাতে এর প্রতি মানুষের বিশ্বাস বা আস্থার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সরকার অবশ্য একে অফিশিয়াল ঘোষণার সময় লকডাউন বলে না, বলে ‘বিধিনিষেধ’। কোরবানি ঈদের আগে যে ‘বিধিনিষেধ’ কার্যকর ছিল, তা ঈদের কারণে উঠিয়ে নেওয়া হয়। সেই বিধিনিষেধও বেশ ঘোষণা দিয়ে ও কঠোরভাবে পালন করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহারের আগেই সেই বিধিনিষেধের মৃত্যু ঘটে গেছে।
আমরা তখন শুনতে পেলাম, ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে নতুন বিধিনিষেধ আসছে। সেটা হবে ১৫ দিনের এবং তা হবে কঠোর। লকডাউন বা বিধিনিষেধ নিয়ে কারও যে কোনো বিশ্বাস বা আস্থা নেই, সেটা সম্ভবত সরকারও ভালোই জানে। সে কারণেই সম্ভবত জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ঘোষণা করলেন, শিল্প-কলকারখানা বন্ধ রেখে ‘সবচেয়ে কঠোর’ একটা লকডাউন হতে যাচ্ছে। তাঁর পরিষ্কার ঘোষণাটি ছিল এমন—‘ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট বিধিনিষেধ কঠোর হবে। এ জন্য যে সবকিছুই বন্ধ থাকবে তখন। এটা হলে আমার মনে হয় কোভিড পরিস্থিতি ভালো নিয়ন্ত্রণে আসবে।’( প্রথম আলো, ১৭ জুলাই)
বিধিনিষেধের মধ্যে শ্রমিকেরা ফিরবেন কীভাবে, সেটা কি নীতিনির্ধারকদের মাথায় আছে? ১৫ দিন সব শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে, এই ঘোষণা দিয়ে তো তাঁদের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। তাঁদের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হলো কেন?
আজ ৩১ জুলাই, আগস্টের ৫ তারিখ আসতে অনেক বাকি। গতকাল ৩০ জুলাই শুক্রবার আমরা সরকারের নতুন এক সিদ্ধান্ত শুনলাম। সরকার এ নিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। আগামীকাল ১ আগস্ট থেকে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী সব খাতের শিল্পকারখানা খোলা থাকবে। একটা ‘সবচেয়ে কঠোর’ লকডাউন ১৫ দিনও কার্যকর করা গেল না! সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার একদল ব্যবসায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে যত দ্রুত সম্ভব শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করে। এর ফলাফল হচ্ছে, আগামীকাল রোববার সকাল থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি দেশের জন্য তা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। লকডাউন বা বিধিনিষেধ মানে জনগণের জীবিকা হুমকির মুখে পড়া। জীবন না জীবিকা, কোনটিকে বড় করে দেখা হবে, এই বিভ্রান্তির কোনো সহজ উত্তর নেই। এ এক উভয়সংকট। দেশের অর্থনীতিরও টানা বিধিনিষেধ বা লকডাউনের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা নেই। ধনী দেশগুলো লকডাউন কার্যকর করে জনগণকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা প্রণোদনা দিয়েছে। বাংলাদেশের সেই সামর্থ্য নেই, সেটা জনগণ বোঝে। আর্থিক সক্ষমতা তো নেই, কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত সামর্থ্যও যে কতটা দুর্বল, সেটাও টের পাওয়া গেল। দরিদ্র জনগণের জন্য সরকারের আর্থিক সহায়তার টাকা পৌঁছাতে কত কেলেঙ্কারিই না হলো! বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব আর্থিক প্রণোদনা বা সহায়তা সরকার দিয়েছে, তার কতটুকু আসল লোকজন পাচ্ছে বা আসল কাজে লাগছে, তা এক বড় প্রশ্ন। প্রণোদনার টাকায় কী হচ্ছে, তার কিছু খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।
এটা সত্যিই বিস্ময়ের যে গত দেড় বছরের বেশি সময়ে করোনাকালীন লকডাউন হিসেবে সাধারণ ছুটি অথবা সর্বাত্মক বা কড়া বিধিনিষেধের একটিও সরকার সফল বা কার্যকর করতে পারেনি। তবে এই সময়ে লকডাউন কার্যকর করার বিষয়ে সরকার নিশ্চয়ই যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং বুঝতেও পেরেছে যে কেন এটা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি বা ভবিষ্যতেও সম্ভব নয়। অর্থাৎ সরকারের কাছে এটা এখন পরিষ্কার হওয়ার কথা যে লকডাউন কার্যকর করার সক্ষমতা তাদের নেই। হয়তো আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে এমন কিছু কার্যকর করা বাস্তবসম্মতও নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এই সব অর্থহীন লকডাউন কেন?
এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে লকডাউন কার্যকর করা যাবে না বা হবে না। এটা জেনে-বুঝেই সরকার বিভিন্ন সময়ে বিধিনিষেধ দিয়েছে। ১৭ জুলাই জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী যখন ঘোষণা করলেন যে ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শিল্পকারখানা বন্ধ রেখে ‘সবচেয়ে কঠোর’ লকডাউন হতে যাচ্ছে, তখন কি তিনি জানতেন না যে এটা কার্যকর করা সম্ভব নয়? ৯ দিনের মাথায়ই সেখান থেকে সরে আসতে হবে?
১ তারিখ থেকে তৈরি পোশাকের কারখানাসহ রপ্তানিমুখী শিল্প খুলবে। বিধিনিষেধের মধ্যে শ্রমিকেরা ফিরবেন কীভাবে, সেটা কি নীতিনির্ধারকদের মাথায় আছে? ১৫ দিন সব শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে, এই ঘোষণা দিয়ে তো তাঁদের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। তাঁদের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হলো কেন? শিমুলিয়া ফেরিঘাটে যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে। কারণ, বিধিনিষেধের কারণে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। শ্রমিক–কর্মচারিদের এই কষ্ট দেওয়ার অর্থ কী?
প্রশ্ন আরও আছে। পোশাকশিল্পের মালিক বা বড় ব্যবসায়ীদের সংগঠন আছে, তারা সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে তাদের দাবি আদায় করে। কিন্তু দিনমজুর বা মুদি দোকানদার বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে সরকারে সঙ্গে দেনদরবার করবে কে? বিধিনিষেধে তো এই শ্রেণিই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত।
এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। জবাব দেওয়ার দায়ও কারও নেই।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক