বাংলাদেশে সরকারি অর্থবছর জুলাই-জুন। সে অনুযায়ী সরকারি খাতের সকল ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি’ (এডিপি) বাস্তবায়িত হয়। তন্মধ্যে শেষ কোয়ার্টার, বিশেষ করে জুন মাসটি উন্নয়ন খাতে ‘জাদুর মাস’ বলা চলে। কারণ, বছরের আগের ১০-১১ মাসে যেখানে এডিপি বরাদ্দের বাস্তবায়ন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের নিচে থাকে, সেখানে জুন মাস শেষে এক অদৃশ্য জাদুবলে তা প্রায় ৯৫ শতাংশ বা তারও বেশিতে পৌঁছায়। মনে হয় দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকার পর জুন মাসে মেঘের গর্জন শুনে উন্নয়নকাজে নিয়োজিত ছোট-বড়-মাঝারি সব কুম্ভকর্ণের একসঙ্গে ঘুম ভাঙে। অতঃপর দীর্ঘ এক মাসের ‘অক্লান্ত’ চেষ্টায় এডিপির ‘সফল বাস্তবায়ন’ সম্ভব হয়। এভাবে বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ দেশ ভাসাতে পারায় ক্ষমতাসীন সরকারি নেতৃবৃন্দ যেমন আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কারণ, বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় কম হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।
পক্ষান্তরে কাজ যেভাবেই সম্পন্ন হোক না কেন, বরাদ্দকৃত ব্যয় নিঃশেষ করতে সক্ষম হলে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হতে পারেন। আবার অনেকের কাছে এডিপির টাকা বেশি বেশি ব্যয় মানেই নিজেদের পকেট ভারী করার মোক্ষম সুযোগ। অথচ সবাই জানেন, বছর শেষে এভাবে উন্নয়ন বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ বাস্তবায়নের নামে সরকারি বিভিন্ন খাত ও প্রতিষ্ঠানে বহু অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত সামগ্রী ক্রয় করা হয়, যা স্রেফ অপচয়ের নামান্তর। শুধু তা-ই নয়, সুযোগ বুঝে বাজারদর অপেক্ষা কয়েক গুণ বেশি দাম পরিশোধ করেও এসব কেনাকাটা হয়। তা ছাড়া তাড়াহুড়ার কারণে অনেক ভৌত কাজের মানও পুরোপুরি নিশ্চিত হয় না। কারণ, আমাদের দেশে জুন মাসে ভারী বর্ষণ শুরু হয় বিধায় কিছু কাজ আছে এ সময়টায় সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। বরং জোর করে সেগুলো সম্পন্ন করতে গিয়ে কাজের মান নিম্নমুখী হওয়া ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া অনেক ধরনের কাজ আছে যেগুলো প্রকৃত বাস্তবায়ন না হওয়া সত্ত্বেও কাগজে-কলমে খরচ দেখিয়ে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন তৈরি হয়। আর এভাবে উন্নয়নকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার, এমনকি সরকারি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই নানা ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ আয়ের সুযোগ পান। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়ে বড় ধরনের কোনো ত্রুটি-অনিয়ম হোক বা না হোক, বছর সমাপ্তির পর সরকারি নিরীক্ষা দলকে ‘খুশি’ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নানা ঝামেলা ও অযথা হয়রানির সম্মুখীন হবেন তা নিশ্চিত। নিজেদের স্বার্থে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আগে থেকেই উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা থেকে একটা অংশ কৌশলে সরিয়ে নিরীক্ষা দলের ‘সম্মানী’ হিসেবে রাখতে হয়।
আর সাধারণ ভুল অথবা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কোনো ধরনের পদ্ধতিগত ত্রুটি পেলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দের/ব্যয়ের পরিমাণ যত বেশি থাকে, নিরীক্ষা দলের ঘুষের মিটারও তত বাড়ে—এটা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। এডিপি বাস্তবায়নের নামে জুন মাস এলেই সরকারি খাতের এ ধরনের অপচয়, দুর্নীতি আর উদ্ভট সংস্কৃতি থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে সুষ্ঠু বিকল্প পথের সন্ধান লাভ করা যায়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
শাহীদুল আযম
উত্তর টোলারবাগ, মিরপুর, ঢাকা।