বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই খুলনায় গড়ে উঠেছিল সমুদ্রবন্দর, শিপইয়ার্ড, নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, জুটমিলসহ অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা। এ অঞ্চলে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর ‘মোংলা’। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোল এবং পৃথিবীখ্যাত জীববৈচিত্র্যের সুন্দরবন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিংড়ি উৎপাদনশিল্প খুলনা অঞ্চলেই অবস্থিত।
আগামী জুন মাসের শেষে পদ্মা সেতু চালু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি একটি নতুন দিগন্তকে উন্মোচিত করবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুলনার গুরুত্ব বাড়বে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নের এই মহাসড়কে হাঁটার মতো সক্ষমতা খুলনা অঞ্চল অর্জন করেছে কি না।
খুলনা একটি শিল্পনগরী হওয়া সত্ত্বেও আজও পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ চালু হয়নি। খানজাহান আলী বিমানবন্দর নিয়ে এখনো নানা সিদ্ধান্তহীনতা, উন্নয়নকাজও ধীরগতির। খুলনার রাস্তাঘাটের বেহাল, গড়ে ওঠেনি বড় বড় হোটেল-মোটেলসহ নাগরিক সুবিধাদি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে খুলনার চিংড়িশিল্প দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও গড়ে ওঠেনি কোনো চিংড়ি গবেষণাকেন্দ্র। চিংড়ি চাষের জন্য ল্যান্ড জোনিংটি আজও হয়ে ওঠেনি। যে কারণে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ এবং নোনা পানির ব্যবহার খুলনার প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করছে।
একসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ কর্মসংস্থানের নগরী খুলনায় ছুটে আসতেন কাজের সন্ধানে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, খুলনা মহানগরীর লোকসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। এখন বেড়ে লোকসংখ্যা হওয়া উচিত ২০ লাখ, অথচ কমে হয়েছে ১৩ লাখ। এর অন্যতম কারণ, খুলনার মিল–কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হচ্ছে, ২০২০ সালে সরকার দেশের ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে, যার ৯টি পাটকল খুলনায় অবস্থিত। এর সঙ্গে খুলনার স্থায়ী, বদলিসহ প্রায় ১৬ হাজার পাটকলশ্রমিক জড়িত। এসব শ্রমিক চাকরিহীন অবস্থায় এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেকেই নিজ নিজ জেলায় ফিরে গেছেন।
বিশ্ববাজারে যখন পাটের চাহিদা বাড়ছে, বেসরকারি মিলগুলো যখন লাভবান হচ্ছে, ঠিক এই সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা এবং পিপিপিতে পাটকল চালানোর সিদ্ধান্ত সরকারের কতটুকু যৌক্তিক, সেটা ফের আলোচনার দাবি রাখে। রাষ্ট্রীয় মিলগুলো বেসরকারীকরণ করার আগে কেন তাতে লোকসান হচ্ছে, কারণগুলো সরকারকে সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে। মাথাব্যথা মানেই মাথা কেটে ফেলে দেওয়া নয়, বরং তার সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়া। শ্রমিক–কর্মচারীদের ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সুপারিশ অনুযায়ী, লোকসানের মূলে রয়েছে কর্মকর্তাদের অনিয়ম, মাথাভারী প্রশাসন, দুর্নীতি ও পরিকল্পনাহীনতা। বিজেএমসির লালফিতার দৈরাত্ম্যের কারণে এসব মিল সময়মতো পাট কিনতে পারে না। যখন পাট কেনে, তখন পাটের মৌসুম শেষ হয়ে যায়। বেসরকারি কারখানাগুলো তার আগেই ভালো পাট কিনে নেয়।
আগামী দিনের উন্নয়নে খুলনা অঞ্চলের মানুষকে সুফল পেতে হলে খুলনার সব বন্ধ কলকারখানা চালু করতে হবে। নতুন নতুন মিল–কলকারখানা স্থাপন করতে হবে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক সুবিধা বাড়াতে হবে, দ্রুত বিমানবন্দরের কাজ শেষ করতে হবে। অর্থাৎ খুলনাকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে অতীত ঐতিহ্য।
ইতিহাস বলে, এর আগে যেসব মিল–কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে, তার একটি মিলও চলেনি। বরং স্বার্থান্বেষী মহল এসব মিল দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করেছে। এখানে যে পুনরাবৃত্তি হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আশা করব, সরকার পাটশিল্পের নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করবে এবং খুলনাসহ দেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলকে নতুন একটি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসবে। হাজার বছরের ঐতিহ্য পাটশিল্পকে তার অতীত গৌরবে ফিরিয়ে আনতে আন্তরিক ভূমিকা পালন করবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ–বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত ছয় আনা দিস্তা কাগজ পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে আমাদের এখানে দশ আনায় বিক্রি হয়। সেই নিউজপ্রিন্ট কাগজের প্রধান উৎপাদনকেন্দ্র ছিল ‘খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল’। ১৯৫৯ সালে ৮৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলটি আজ দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ হয়ে আছে। খুলনায় একটি আইটি ভিলেজ গড়ে তোলার দাবি এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের। এখানে একটি আইটি ভিলেজ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের পাশেই ৪০ একর জমির ওপর বাংলাদেশের একমাত্র হার্ডবোর্ড মিলটি বন্ধ হয়ে আছে। সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও আধুনিকায়ন করে এ মিলগুলো আবার চালু করা সম্ভব। তাহলে একদিকে যেমন এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও তাঁরা ইতিবাচক অবদান রাখতে পারবেন।
খুলনার শিপইয়ার্ড একসময় প্রচণ্ড লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। দেশের সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেটি এখন একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ, সঠিক তদারকি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা।
১৯৫০ সালে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা বন্দর স্থাপিত হওয়ার পর ১৯৬৬ সালে খুলনার অদূরে ২৬৪টি প্লট নিয়ে শিরোমণি বিসিক শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মোংলা বন্দরকে আরও ব্যবহার উপযোগী করতে উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা গড়ে তোলা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তার অধিকাংশ প্লট অব্যবহৃত পড়ে আছে।
আগামী দিনের উন্নয়নে খুলনা অঞ্চলের মানুষকে সুফল পেতে হলে খুলনার সব বন্ধ কলকারখানা চালু করতে হবে। নতুন নতুন মিল–কলকারখানা স্থাপন করতে হবে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক সুবিধা বাড়াতে হবে, দ্রুত বিমানবন্দরের কাজ শেষ করতে হবে। অর্থাৎ খুলনাকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে অতীত ঐতিহ্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৫১ বছর। ইতিমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হয়েছি। যা কিছু অন্তরায়, তা আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রহীনতা। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। তাহলে খুলনা অঞ্চলও ফিরে পাবে পুরোনো ঐতিহ্য এবং আবারও হয়ে উঠবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী।
মো. কুদরত-ই-খুদা উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মী