কোভিড-পরবর্তী শিক্ষাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে যে পথ ধরা যায়

কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নানা সুযোগও সৃষ্টি করেছে। অনলাইন শিক্ষার পরিসর বেড়েছে।
ছবি : প্রতীকী

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের কোনো একদিন অধ্যাপক লিজ জনসনের সঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দিয়ে হাঁটার সময় পরবর্তী প্রজন্মের লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) নিয়ে তাঁর সঙ্গে চিন্তাভাবনা বিনিময় করেছিলাম। একজন তরুণ উৎসাহী স্নাতক হিসেবে আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিং ইত্যাদি কীভাবে শিক্ষায় প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে অধিক আগ্রহী ছিলাম। তারপর তিনি আমাকে সাশ্রয়ী, লার্নিং অ্যানালিটিকস, সাপোর্ট স্টাফ, প্রাসঙ্গিক সমস্যা এবং আরও অনেক কিছুর সমন্বয়ে একটি সহজ সমাধান চিন্তা করার পরামর্শ দেন। তিনি আরও যোগ করেছিলেন যে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্লেন্ডেড (মুখোমুখি ও অনলাইনের সমন্বয়) এবং অনলাইন শিক্ষার ওপর বিশাল আর্থিক ও জনশক্তি বিনিয়োগ করে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে স্থিতিশীল এলএমএস সক্রিয় থাকে। অস্ট্রেলিয়ান, কানাডীয় বা যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ ক্ষেত্রে একই ধরনের কৌশল অনুসরণ করে।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক এবং প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপটে ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল শিক্ষায় ব্যাপক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমি ‘এলএমএস জিরো’ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করেছি। এটি এপিআইভিত্তিক লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের একীকরণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যার কোনো হোস্টিং সার্ভিস প্রয়োজন নেই। এই প্রকল্পটি প্রচলিত, অনলাইন বা ব্লেন্ডেড শিক্ষার ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর। এখন যদি আমরা প্রয়োজনীয় অনুমতি এবং সমর্থন পাই, তাহলে প্রকল্পটি ৩-৫ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের ৫ হাজার ৫০০ কলেজের সবগুলোতে স্থাপন করা যেতে পারে, এটি যে তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে, তা নিশ্চিত।
সার্বিকভাবে এলএমএস হল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ডকুমেন্টেশন, ট্র্যাকিং, রিপোর্টিং, অটোমেশন এবং শিক্ষামূলক কোর্স বা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের জন্য একটি সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। এটি মানসম্পন্ন শিক্ষার একটি হাতিয়ার, যা ১০-১৫ বছর ধরে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ক্লাসের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। এলএমএস যেকোনো ধরনের শিক্ষাকে সমর্থন করে এবং অনলাইন শিক্ষার সঙ্গে এর বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। উদাহরণস্বরূপ, ড্যাফোডিলের শেষ সেমিস্টারে আমরা বেশির ভাগই অনলাইনে পরিচালনা করেছি, তারপর প্রচলিত শিক্ষায় ফিরেছিলাম এবং এখন আবার অনলাইনে চলে গিয়েছি। আমরা এলএমএসকে নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের জন্য একটি সাধারণ মঞ্চ হিসেবে রেখেই এগুলো নিয়ে কাজ করতে পারি।

কোভিড-১৯ এখনো শেষ হয়নি এবং আমাদের এটিকে শেষ মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর ডিভাইসের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করার পরিবর্তে যা আছে তা পুঁজি করে আমাদের মহামারি এবং তার পরবর্তীকালে শিক্ষাব্যবস্থা অব্যাহত রাখা উচিত। গত এক দশকে এলএমএস সারা বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি হয়নি।

কোভিড-১৯ এখনো শেষ হয়নি এবং আমাদের এটিকে শেষ মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর ডিভাইসের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করার পরিবর্তে যা আছে তা পুঁজি করে আমাদের মহামারি এবং তার পরবর্তীকালে শিক্ষাব্যবস্থা অব্যাহত রাখা উচিত। গত এক দশকে এলএমএস সারা বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি হয়নি। আসুন, মূল কারণগুলো একটু খতিয়ে দেখি। আমাদের শিক্ষকদের ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল শিক্ষণ বিষয়ে ইতিবাচক মানসিকতা নেই, তাই এলএমএসের সঙ্গে তারা অভ্যস্ত নয়। মহামারি প্রমাণ করেছে যে এই ধরনের শিক্ষণ শিক্ষার জন্য নতুন স্বাভাবিক। প্রায়ই আমরা আমাদের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাগুলোকে অনলাইন এবং ব্লেন্ডেড শিক্ষার ওপর চাপিয়ে দিই। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।

এলএমএস এবং ডিজিটাল শিক্ষায় আর্থিক ও মানবসম্পদ বিনিয়োগে আগ্রহের অভাব আরেকটি কারণ। প্রতিটি এলএমএস সিস্টেমের জন্য সেটআপ এবং পুনরাবৃত্তিক খরচ প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ ক্যানভাস এলএমএস ব্যবহার করার জন্য প্রতিবছর ছাত্রপ্রতি ২৫ ডলার খরচ হয়। মুডল এলএমএস হোস্টিং পরিষেবা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক অর্থ এবং জনশক্তি প্রয়োজন হয়, যা আমরা খরচ করতে চাই না। এমনকি একটি এলএমএস সিস্টেম স্থাপন করার পর যদি সার্ভারের সামান্য ডাউনটাইম দেখি, তবে আমরা সিস্টেমটিকে চিরতরে খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করি, যদিও সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের কাছে যথেষ্ট সাপোর্ট স্টাফ থাকে না বললেই চলে। বেশির ভাগ উচ্চ ফিচারসম্পন্ন এলএমএস ব্যবহার করা এত সহজ নয়, বিশেষ করে বয়স্ক এবং আইটির বাইরের শিক্ষকদের জন্য।

এগুলো অনেক গবেষণা দ্বারা সমর্থিত, যেখানে দেখা গেছে যে অপারেশনাল খরচ, সাপোর্ট এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ব্যবহারের জটিলতা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এলএমএস স্থাপন এবং ব্যবহার না করার মূল কারণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এলএমএস বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য দক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন, তাই দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এই ধরনের ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কথা ভাবা অনেকটাই অযৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত নয়।

এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি ডিজিটাল শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এটি গুগল প্ল্যাটফর্মে এপিআইভিত্তিক একটি এলএমএস সমাধান যাতে রয়েছে (i) শিখন-শিক্ষণ, (ii) মূল্যায়ন, (iii) শেখার বিশ্লেষণ, (iv) গ্রেডিং এবং রিপোর্টিং, (v) ইন্টারেকটিভ ভিডিও তৈরি, (vi) বিষয়বস্তু সম্পর্কিত রিপোজিটরি, (vii) মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং আরও অনেক কিছু। এসব সুযোগ-সুবিধা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এবং যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে গ্রহণ করা যাবে। অন্যান্য বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে অসদৃশ এটি, এক জায়গায় স্কুল বা কলেজের জন্য একটি সমন্বিত ডিজিটাল সমাধান হিসেবে কাজ করবে। এই পদ্ধতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এখন এবং ভবিষ্যতের জন্য স্বনির্ভর এবং নিরবচ্ছিন্ন হতে সক্ষম করবে।

এই বিশেষ প্রকল্পটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনেক সমস্যার সমাধানপূর্বক নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোসহ একটি স্থিতিশীল এবং পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প প্রস্তাব করছে: (i) কোনো সার্ভার বা হোস্টিং পরিষেবার প্রয়োজন নেই; (ii) কোনো মাসিক, বার্ষিক বা প্রাথমিক সেটআপ খরচ নেই; (iii) প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের সঙ্গে সহজে ইন্টিগ্রেট করা যাবে; (iv) বিল্ট-ইন রেজাল্ট প্রসেসিং সিস্টেম এবং বিশ্লেষণ থাকবে; (v) সব ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইল এবং ড্রাইভ স্পেস থাকবে; (vi) সার্ভার ডাউন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম; (vii) যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় মোবাইল ডিভাইসে অ্যাক্সেসযোগ্য; (viii) তেমন কোনো রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন নেই; এবং (ix) একেবারে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ যথেষ্ট। এই প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে (প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) স্থাপনের লক্ষ্য রয়েছে।

সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র স্কুল বা কলেজ সিস্টেমটি নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।
কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নানা সুযোগও সৃষ্টি করেছে। মহামারি আবির্ভাবের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বিভিন্ন সংস্থাগুলোর তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারণে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা আজ যে অগ্রগতি করেছি তা অবিশ্বাস্য, যা অন্যথায় ৫-১০ বছর সময় নিতে পারত। এখন সব স্তরের মানুষ এর গুরুত্ব অনুভব করেছে এবং আমাদের এটিকে পুঁজি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। যদি ব্লেন্ডেড শিক্ষা যথাযথভাবে আমরা বুঝতে পারতাম, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করতে হতো না, শিক্ষকদের বেঁচে থাকার জন্য বেমানান কাজ খুঁজতে হতো না এবং শিক্ষার্থীরা হতাশ বোধ করত না। আমাদের অনলাইন এবং ডিজিটাল শিক্ষার বৈশ্বিক প্রবণতাগুলোকে অবহেলা করা উচিত নয়, যা ২০২৬ সালের মধ্যে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের হতে পারে—এটি আমাদের জন্য সহজেই রাজস্ব উপার্জনের একটি ভালো উৎস হতে পারে।

এলএমএস জিরো প্রকল্পটি সহজ, নতুন উদ্ভাবন, বাস্তবায়নযোগ্য, টেকসই ও ফলদায়ী। এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমঅধিকারভিত্তিক মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার পথ প্রশস্ত করতে পারে এবং আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। একটি মজার বিষয় হলো যে বাংলাদেশে প্রান্তিক ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪ দশমিক ৮ শতাংশের কাছে টেলিভিশন আছে, কিন্তু ৮ দশমিক ৩ শতাংশের কাছে ইন্টারনেট প্রবেশগম্যতা রয়েছে। আইটিইউ গিগা বা টেসলা স্টারলিঙ্ক প্রকল্প পুরো ইন্টারনেট দুনিয়ায় নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন আনতে পারে। যাহোক, ইন্টারনেট ক্রমবর্ধমানভাবে সব স্তরের মানুষের কাছে সহজলভ্য ও সস্তা হয়ে উঠছে। এলএমএস জিরো বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম সমর্থন করবে এবং যদি লাইব্রেরি থেকে ধার নেওয়ার ভিত্তিতেও এটি গুগল ক্রোমবুকের সঙ্গে একীভূত করা যায়, তাহলে প্রকল্পটি বিশ্বব্যাপী অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল শিক্ষার জন্য অন্যতম সেরা সমাধান হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

ড. মো. আকতারুজ্জামান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক