খোশ আমদেদ মাহে রমজান

আহলান সাহলান মোবারক হো মাহে রমজান। রমজান মাসে রোজা রাখা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য। মাহে রমজানে রোজা পালনকারী একজন মুসলমান সত্যিকারের খাঁটি ইবাদতকারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। রহমত ও বরকতের দিক দিয়ে রমজান মাস অন্য ১১ মাস থেকে ভিন্ন। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসের প্রথমাংশে রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত অর্থাৎ ক্ষমা আর তৃতীয়াংশে নাজাত তথা দোজখ থেকে মুক্তি।’ (বুখারি)
রোজার নিয়ত: মনের ইচ্ছা পোষণকেই নিয়ত বলে। চাই মুখে কিছু বলুক বা না বলুক। রোজার জন্য নিয়ত করা ফরজ। নিয়ত না করে সারা জীবন না খেয়ে থাকলেও একটি রোজাও হবে না। মাহে রমজানের রোজার নিয়ত রাতেই করে নেওয়া উচিত। তবে যদি না করে, তাহলে সূর্য সোজা মাথার ওপর আসার দেড় ঘণ্টা আগে অথবা দিনে ১১টার আগে নিয়ত করে নেবে। শর্ত হলো, কোনো কিছু খেতে বা পান করতে পারবে না। আরবি ভাষায় নিয়ত জানা থাকলে ভালো, নতুবা বাংলায় নিয়ত করা চলে। মুখে নিয়তের শব্দ উচ্চারণ করা জরুরি নয়, কাজেই মাহে রমজানে রোজা রাখার জন্য নিয়ত করে রাতে মনে মনে শুধু বলতে হবে: ‘নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম্ মিন শাহির রামাদানাল মুবারাকি, ফারদাল লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল মাহে রমজানের রোজা রাখার নিয়ত করছি, যা তোমার পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করো, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’
তারাবির নামাজ: প্রথমে একজন মুসলমান রোজার নিয়ত ও তারাবির নামাজ আদায় করার মধ্য দিয়ে রোজা পালন করে থাকেন। রমজান মাসে দিনের রোজা আর রাতে সম্মিলিতভাবে ইবাদতের একটি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাকে ‘তারাবিহ’ বলা হয়। এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা, একজন রোজাদারকে রমজান মাসে এশার নামাজের পরে বেতের তিন রাকাত নামাজের আগে ১০ সালামে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। তারাবির নামাজ একাকীও পড়া যেতে পারে। মসজিদে জামাতের সঙ্গে পবিত্র কোরআনের খতম তারাবিতে পড়ায় অশেষ সওয়াব রয়েছে। একাকী বা জামাতের সঙ্গে সূরা তারাবিও পড়া যেতে পারে।
সেহির: সেহির মাহে রমজানের বরকতময় একটি পর্ব। সেহিরর বাহ্যিক বরকত হচ্ছে, রোজাদারের রোজা রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং মন প্রফুল্ল থাকে। আর সেহিরর অন্তর্নিহিত বরকত হচ্ছে, এ সময়ে আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয় এবং বান্দার দোয়া কবুল করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেহির খাও, এতে বরকত আছে।’ (মুসলিম)
সূর্যাস্তের পর থেকে সুবহে সাদেকের আগ পর্যন্ত সেহিরর শেষ ভাগ। তাই রাতের একটু শেষ ভাগেই সেহির খাওয়া সুন্নত। এতে অশেষ বরকত রয়েছে।
ইফতার: সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে হবে। ইফতারের জন্য খেজুর ও পানির কথা হাদিস দ্বারা সমর্থিত। ইফতার নিজে করা এবং অন্যকে করানো সওয়াবের কাজ। যে ব্যক্তি অন্যকে ইফতার করাবে, তার সওয়াবের কোনো কমতি হবে না। ইফতার করার সময় এ দোয়াটি পড়তে হয়: ‘আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া তাওয়াক্কালতু আলা রিজকিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।’ ইফতারের ক্ষণটি দোয়া কবুলের সময়। রোজাদারের জন্য আনন্দময় মুহূর্ত দুটি। একটি ইফতারের সময়, অন্যটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে: ‘রোজাদার যখন ইফতার করে, তার দোয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না।’
রোজা যেসব কারণে ভঙ্গ হয়: ১. জ্ঞাতসারে পানাহার ২. কেউ জোরপূর্বক কিছু খাইয়ে দিলে; ৩. নাকে বা কানের ভেতরে ওষুধ দিলে; ৪. কোনো খাদ্য বা বস্তু অসুখের কারণে পেটের ভেতরে দিলে; ৫. মস্তকে কোনো ওষুধের তেজ গেলে; ৬. লোহা, কাঠ, মাটিসহ এমন বস্তু গিলে ফেলা, যা সাধারণত খাওয়া হয় না; ৭. ইচ্ছা করে মুখ ভরে বমি করলে; ৮. রাত আছে বলে মনে করে সকালে সেহির খেয়ে ফেললে; ৯. সূর্যাস্ত হয়ে গেছে মনে করে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে; ১০. ভুলে খানা খাওয়ার পর রোজা ভেঙে গেছে—এই মনে করে ইচ্ছা করে কোনো কিছু খাওয়া; ১১. দিনের বেলা কুলি করতে গিয়ে গলার মধ্যে পানি গেলে; ১২. নিয়ত ছাড়া রোজা রাখার পর ইচ্ছাপূর্বক রোজা ভঙ্গ করলে; ১৩. হুক্কা, বিড়ি, তামাক বা ইচ্ছাপূর্বক ধূমপান করলে এবং ধূপ ও আগরবাতি জ্বালিয়ে পরিকল্পিতভাবে তার ধোঁয়া গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়।
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়: ১. অযথা কোনো বস্তু মুখের মধ্যে রেখে চিবানো; ২. লবণ বা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ নিয়ে থুতু করে তা আবার ফেলে দেওয়া; ৩. মাজন, কয়লা বা পেস্ট দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা; ৪. ফরজ গোসলের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সারা দিন গোসল না করে কাটানো; ৫. শিঙা লাগানো, ৬. রক্তদান করা; ৭. গিবতে লিপ্ত হওয়া; ৮. মারামারি করা, ঝগড়া করা, গালি দেওয়া।
মাহে রমজানে সহীহ শুদ্ধভাবে আবশ্যকীয় বিধিবিধান শরিয়তের মাসআলা অনুযায়ী রোজাদারদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা দরকার।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, ধর্মবিজ্ঞান অনুষদ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]