গভীর রোগে দরকার শক্তিশালী ওষুধ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

এবারের দুর্গাপূজার সময় দেশের অনেক মন্দিরে যে হামলা হলো, প্রতিমা ভাঙা হলো, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর আক্রমণ হলো এবং এসব সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ঘটল, এগুলো যে হঠাৎ করেই হলো, তা তো নয়। দেখা গেল, সরকারও এই আক্রমণে অবাক হয়েছে। অথচ সবাই জানে, গণমাধ্যমে নিয়মিত উঠে আসছে, এ রকম হামলা প্রতিবছর ঘটে, কোথাও না কোথাও মন্দিরে আক্রমণ চলে। সর্বশেষ রংপুরের পীরগঞ্জে যা ঘটল, এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে।

এসব আক্রমণ ও সহিংসতার ঘটনায় শুধু দুঃখ প্রকাশ করলে এবং আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এমনকি অভিযুক্তদের আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান করলে এবং পূজার সময় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এ জন্য প্রয়োজন মূল কারণগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া এবং সেগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা।

আমি দেখতে পাচ্ছি, সহিংসতার বিষয়টি নিয়ে সরকার দুষছে বিএনপি ও তার সহযোগীদের এবং বিএনপি দুষছে সরকারকে। অথচ এই ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য একটি জরুরি বিষয়। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করলে এবং সাম্প্রদায়িকতা যে সব রাজনৈতিক দলের ভেতর কমবেশি ঢুকে পড়েছে, এ কথা স্বীকার না করলে সেই ঐকমত্যে পৌঁছানো হবে না।

ঐকমত্য কেন প্রয়োজন? প্রয়োজন এই জন্য যে সাম্প্রদায়িকতার একটি বড় কারণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বীকার করতে হবে যে দায়টা তাদেরও এবং এর মূল ধরে টান দিতে হবে। টান দিতে গেলে এর অর্থনৈতিক দিক (জমি ও ব্যবসা–বাণিজ্য দখল, লুটতরাজ ইত্যাদি) অথবা আঞ্চলিক দিকগুলো (প্রতিবেশী দেশগুলোতে চরম ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ক্ষতিকর প্রভাব) বের হয়ে আসবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা তো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, অনেক তরুণের ওপর তার প্রভাব পড়ছে। এর কারণ, আগে শিক্ষা ও সংস্কৃতি যে সুরক্ষা দিত, তা এখন দিতে পারছে না।

আমি একজন শিক্ষক এবং দেশের সংস্কৃতির চিত্তকে জাগিয়ে দেওয়ার শক্তিতে বিশ্বাসী। আমি স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি, যে শিক্ষা এখন শিশুদের দেওয়া হচ্ছে, একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে যেভাবে দেওয়া হচ্ছে—তাতে তাদের মন জাগানো সম্ভব নয়। পরিবর্তনটা সেখানেই করতে হবে। এর পাশাপাশি পরিবর্তন প্রয়োজন যাঁরা শিক্ষা দিচ্ছেন তাঁদের অনেকের মানসিকতার। প্রয়োজন পরিবারগুলোর ভেতরে এবং নানা স্তরের নেতৃত্বে এবং প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর মধ্যে সংস্কৃতিশূন্যতার কারণে সাম্প্রদায়িকতার যে প্রতিষ্ঠা ঘটছে, তার প্রতিকারের। দায়টা শেষ পর্যন্ত সবারই।

অল্প পরিসরে প্রতিকারের বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। তাই শুধু শিক্ষা কী করে পরিবর্তনটা আনতে পারে—যা শুধু কসমেটিক বা ওপর–সর্বস্ব হবে না, কাঠামোগত হবে (যার অভাবে সাম্প্রদায়িকতা আরও সর্বব্যাপী এবং হিংস্র হবে), তা অল্প কথায় দেখিয়ে দেওয়া।

আমাদের শুরু করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগ হতে হবে বহুমুখী। তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে স্কুলগুলোর অবকাঠামো ও শিক্ষকদের বেতন–ভাতা আকর্ষণীয় করা, মেধাবীদের শিক্ষায় যুক্ত করা, স্কুলগুলোতে সারা বছর খেলাধুলা, বই পড়া, বিতর্ক, সংস্কৃতি পাঠ ও সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যবস্থা করা, তাদের পরীক্ষা ও মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষা থেকে ফিরিয়ে এনে সৃজনশীল শিক্ষায় শিক্ষিত করা—যাতে মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো এবং সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে শ্রদ্ধা করার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। যদি প্রাথমিক ছাড়িয়ে মাধ্যমিকে এবং একসময় সর্বত্র এই মূল্যবোধগুলো বিকশিত করা যায়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতা আর সমস্যা থাকবে না।

এটি কোনো আদর্শবাদী চিন্তা নয়। এটি এখন একটি অপরিহার্য কাজ। এটি যত শিগগির সম্ভব, পারলে আগামীকাল থেকেই শুরু করতে হবে। শুধু একটি দেশের উদাহরণ দেব, যে দেশে বহু ধর্মের এবং বহু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে, অথচ সাম্প্রদায়িকতা যেখানে শূন্য পর্যায়ে। দেশটি সিঙ্গাপুর। দেশটি প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার ওপর বিনিয়োগ করে যাচ্ছে।

যত দিন না শিক্ষার সুফলগুলো পরিবার থেকে সমাজের ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, অর্থাৎ একটি সহনশীল ও সংস্কৃতিমান জাতি তৈরি হবে—যা এক প্রজন্মের ভেতরেই সম্ভব—তত দিন রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করে যেতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা যারা ছড়ায় তাদের চিহ্নিত করতে হবে; যেসব মাধ্যমে (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব ইত্যাদি) ছড়ায়, সেসবের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে আন্তরিক হতে হবে। রোগটা যখন শরীরের গভীরে যায়, ওষুধটাকেও শক্তিশালী হতে হয়।