চাই দুদকের দৃপ্ত পদচারণ

আকা: শিশির
আকা: শিশির

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে তাদের ক্ষমতায় কিছু সীমাবদ্ধতা এনে একটি সংশোধনী বিল সংসদে যায় বছর তিনেক আগে। দুদকের ক্ষমতা সীমিতকরণ-সংক্রান্ত প্রস্তাবটিতে দেশের সুশীল সমাজ ব্যাপক আপত্তি জানায়। আপত্তি জানায় দুদক। তদানীন্তন দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, এ সংশোধনী আনা হলে সংস্থাটি একটি নখ, দন্তহীন ব্যাঘ্রে পরিণত হবে। আইনটি দীর্ঘকাল পড়ে ছিল সংসদে। দুদকের নখ, দাঁত ছিল অক্ষত। কিন্তু সেগুলো কতটুকু, কীভাবে প্রয়োগ হয়েছে, দেশবাসীর তা জানা। হঠাৎ করে গত নভেম্বরে সংশোধনী বিলটি পাস হয়ে যায়। দুদক আইনে নতুন সংযোজিত ৩২ ধারায় বিধান করা হয়, এ আইনে কোনো জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা পাবলিক সার্ভেন্টকে অভিযুক্ত করতে হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুসরণ করতে হবে। সে বিধি অনুসারে আবশ্যক রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। এতে দুদকের স্বাধীন সত্তা সীমিত হয়। কার্যকারিতা কমে যাবে বলে আশঙ্কা করেন অনেকেই। সুশীল সমাজ এবারও তীব্র আপত্তি করতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত এ বছরের জানুয়ারি মাসে এক জনস্বার্থ মামলার রিটে হাইকোর্ট বিভাগ বিধানটি বেআইনি ও বৈষম্যমূলক বলে বাতিল করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাদের নখ আর দাঁত অক্ষতই রইল। দেশবাসী আশা করতে পারে, এ নখ আর দাঁতের ব্যবহার তারা করবে মনুষ্য রূপধারী হিংস্র কিছু দানবের প্রতি। যে দানবেরা ঘুষ, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে জনস্বার্থ বিপন্ন করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে।
এখানে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের পটভূমিকা কিছুটা আলোচনার দাবি রাখে।
আমরা অনেক চড়া মূল্যে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনাগুলোর মধ্যে ছিল আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আমাদের অর্জন ও ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করলে দেখা যাবে, শাসনব্যবস্থা কার্যকর হলে অর্জন আরও বেশি হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার আমাদের শাসনব্যবস্থার অংশ হয়ে পড়েছে—এমনটাই দেখা যায়। এ বিষয়ে আমাদের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অকার্যকর বলেই প্রতিপন্ন হয়। দাবি ওঠে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার। দাবি ওঠায় সুশীল সমাজ। পাশাপাশি দাবিটির প্রতি সমর্থন দেয় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো। এর মাঝে বাংলাদেশ জাতিসংঘের দুর্নীতি দমন কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এসব কিছুর ফলে ২০০৪ সালে সংসদে গৃহীত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন।
আইন প্রণয়নের পর কয়েক দফায় কমিশন গঠন-পুনর্গঠন হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়কার প্রথম কমিশন তো নিজদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে দিব্যি দুই বছর কাটিয়ে দিয়েছিল। নিষ্ফলা ছিল সে কমিশনটি। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক পালাবদলের পর নতুনভাবে আরেকটি কমিশন গঠিত হয়। এটার ওপর আবার তখনকার সরকারের একটি অংশের প্রবল নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে অতি সক্রিয় ছিল সে সময়কার কমিশন।
অভিযোগ আছে পক্ষপাতিত্বসহ আরও অনেক কিছুর। কিছু অভিযোগের সত্যতা থাকতেও পারে। তবে দুর্নীতি করলে কোনো না কোনো সময় আইনের আওতায় আসতে হবে—এ চরম বার্তাটি সে কমিশন সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাফল্যের সঙ্গে দেশবাসীকে দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, তবে বিভিন্ন কারণে তাদের সে প্রয়াস স্থায়ী রূপ পায়নি। বরং ২০০৯ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর একশ্রেণীর লোক দলবল নিয়ে নেমে পড়লেন দুর্নীতির মহোৎসবে। এটাই আমরা দেখলাম। আগেকার জোট সরকার থেকে ভিন্ন কিছু ঘটল—এমন দেখা গেল না। ফলে পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাঁদের কারও কারও সম্পদের নিট স্ফীতি ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক সহস্র গুণ হওয়ার অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের সামনে এল। আর তা এল নির্বাচন কমিশনে ২০০৮ ও ২০১৩ সালে তাঁদের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করেই।
প্রথমত, দুদক এ বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই বলে এড়িয়ে যেতে চাইল। পরে তীব্র সমালোচনার মুখে জানাল, তারা এই জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের উৎস নিয়ে তদন্ত করবে। দু-একটি ক্ষেত্রে তা শুরু হয়েছে বলেও মনে হয়। তবে এ ‘কৃষ্ণগহ্বর’ থেকে দুদক উল্লেখযোগ্য কিছু বের করতে পারবে—এমনটা বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না। তাদের বরাবরের মতো সরকারের সন্তুষ্টি বিধান করেই চলতে হবে। অন্তত নিকট অতীতের ঐতিহ্য তারা ভাঙতে সক্ষম হবে—এমন মনে হয় না। এ আশঙ্কা করলে আমাদের সংশয়বাদী বলে গাল দিতে পারে। কিন্তু কঠোর বাস্তবতা সামনে চোখ রাঙাচ্ছে।
২০০৯ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রথমত আগের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন। নিযুক্ত হন নতুন চেয়ারম্যান। মেয়াদ সম্পন্ন হলে কমিশনার দুজনও নতুনদের দ্বারা স্থলাভিষিক্ত হলেন। এ নতুন কমিশন সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা আছেন, তাঁদের মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে করার চেষ্টা করছে। এর বেশি কিছু নয়। ২৭০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পটি আটকে যায় মূলত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। এ অভিযোগের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই দুদক জাতির কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করেনি। বরং দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ প্রসঙ্গে সরকারের যে বক্তব্য, তার আগ বাড়িয়ে আরও জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন তদানীন্তন দুদক চেয়ারম্যান। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে অকারণে ফাঁসিয়ে দিতে কেউ বলবে না। তবে সম্ভাব্য সন্দেহের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান, মামলা দায়ের আর তদন্ত দোষের কিছু নয়। বিষয়টি নিয়ে কানাডার আদালতে কিন্তু একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই একদিন হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে দুই-তিন গুণ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে অবশিষ্টাংশের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রয়াসও পিছিয়ে গেল। এখানে মূল দায় যাদেরই হোক, স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুদকের কাছে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত দেশবাসীর কাম্য ছিল। এমন আশা করছিল উন্নয়ন সহযোগীরাও। এতে ঋণ চুক্তিটি হয়তো বা রক্ষা পেত। আইন ও অবয়বে ভিন্ন রূপ নিলেও কাজেকর্মে দুদক কিন্তু তার পূর্বসূরি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর ছায়াই অনুসরণ করে চলছে। অথচ কমিশনারদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া অনেক মর্যাদাসম্পন্ন। তাঁদের অপসারণও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মতো একটি জটিল প্রক্রিয়াসাপেক্ষ। দায়িত্ব পালনে তাঁদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সামান্য সময়ের জন্য যেটুকু আইনি জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা-ও অপসারিত। তা সত্ত্বেও সংস্থাটি তার স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার ছাপ রাখতে কিছুমাত্র সক্ষম হয়েছে—এমন দাবি করা যাবে না।
আমাদের দেশে এ-জাতীয় অবস্থা শুধু দুদকেই, তা নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই এ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার কিসে তুষ্ট হবে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে চায় অনেকে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ভেঙে পড়েছে। জাতীয় প্রয়োজনে তারা সাড়া দিতে সক্ষম হচ্ছে না। দুদক প্রসঙ্গ এখানে বারবার আসবে। দুর্নীতির ব্যাধি আজ গোটা জাতিকে গ্রাস করে ফেলছে। সংবর্ধনা সভায় সরকারের উচ্চ পদাধিকারী ‘ঠাট্টা করে’ আজ মাইক্রোফোনে ক্রেস্টের পরিবর্তে ক্যাশ চাইছেন। এ ধরনের ‘ঠাট্টা’ ক্ষমতার অপব্যবহার তথা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে কি না, তা দুদকেরই দেখার কথা। তারা কিছুটা সক্রিয় হলে এর আংশিক নিরাময়ও সম্ভব। আইনি সমর্থন, অবকাঠামো ও লোকবল সবই আছে তাদের। কোথাও অপূর্ণতা থাকলে এটা মেটাতে দাবি জানাতে পারেন। একটু নড়েচড়ে উঠলেই সতর্ক হতে শুরু করবেন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা।
তবে জানা যায়, দুদকের নিম্নপদস্থ ব্যক্তিদের হাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনাবশ্যক হয়রানির শিকার হয় কিছু ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও নিবিড় তদারকির ব্যবস্থা থাকলে এ-জাতীয় অবস্থার অবসান ঘটাতে সহায়ক হবে। আর যেসব ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ দুর্নীতি করে না, তারা কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির দ্বারা সাময়িক হয়রানি হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কমিশনের অনুমোদন ব্যতীত এ আইনে কোনো মামলা রুজু করার কোনো আইনি সুযোগ নেই। তবে নিজে লোভের বশীভূত হয়ে বা অন্যের চাপে বেআইনি কাজ করলে যথাযথ ফল ভোগ করতেই হবে।
পরিশেষে থাকছে, প্রতিষ্ঠানটিকে সবাই স্বাধীন ও সক্রিয় দেখতে চায়। আশা করে, সব জড়তা কাটিয়ে এরা আইনের বাতাবরণে এ-জাতীয় দায়িত্ব পালনে তৎপর হবে। এখন কিন্তু নখ, দাঁত সবই রয়ে গেল তাদের। তাই অক্ষমতার কোনো অজুহাত দেওয়া যাবে না। অবশ্য নখ-দন্তধারী কিছু হিংস্র প্রাণীও পোষা থাকতেই পছন্দ করে। দুদক অন্তত নিজেদের এ ধরনের সন্দিহান অবস্থা থেকে বাইরে আনতে সচেষ্ট হবে—এ প্রত্যাশা রইল।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]