জার্মান ঐক্যের ২৩ বছর

জার্মান ঐক্যের ২৩ বছর
জার্মান ঐক্যের ২৩ বছর

সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে মাত্র তিন দশক আগেও ইউরোপীয় জাতিসত্তাগুলোকে বিস্তর লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালে স্পেনের স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৭৮ সালে সংবিধান রচিত হয়। তবু ১৯৮১ সালেও জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সমর্থিত সেনাবাহিনী সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। দক্ষিণ ইউরোপের অপর দুই দেশ পর্তুগাল ও গ্রিসে সেনাবাহিনীর দাপট থেকে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে যথাক্রমে ১৯৭৪ আর ১৯৭৫ সালে। আর জার্মান জাতির ললাটে সবই ঘটেছে অর্ধশতাব্দীর মধ্য দুটি মহাযুদ্ধ, যুদ্ধ বিজয়ীদের আধিপত্য, যুদ্ধের দায়ভার ঘাড়ে নিয়ে জার্মান জাতির বিভক্তি এবং আবারও ঐক্য, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। দুই অংশ একীভূত হওয়ার ২৩ বছর পর ইউরোপে জার্মানি এখন আবারও অর্থনৈতিকভাবে সবল শক্তি।
২৩ বছর আগে জার্মান রাষ্ট্রপতি রিচার্ড ভন ভাইজকার বলেছিলেন, জার্মান জাতির ঐক্য নিয়ে ইউরোপীয় প্রতিবেশী বা বিশ্বের ভয় পাওয়ার বা সংশয়ের কিছু নেই। এই বক্তব্যের সারমর্ম অনেকটাই জার্মান জনগণ ও রাজনীতিকদের ধারায় প্রতিভাত হচ্ছে। ৪৫ বছর ধরে সমাজতান্ত্রিক আর ধনবাদী দুই ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলেছে; একীভূত হওয়ার পর এ দুটোকে এক করে এগিয়ে যাওয়া ছিল দুরূহ। পূর্ব জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনৈতিক প্রচলন থাকলেও তা ছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সেরা অর্থনীতি, যদিও পুঁজিবাদের সমর্থকেরা তা মানেন না। আর পশ্চিমের অর্থনীতি পুঁজিবাদী শ্রেণীর হলেও, সেখানে মানবিকতা ছিল। পশ্চিম জার্মানিতে একধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাজারকাঠামো ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন আবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি—এসব মৌলিক সেবার নিশ্চয়তা ছিল। ঐক্যবদ্ধ জার্মানির অর্থনীতিও এ ধাঁচেই এগোতে থাকে।
শুধুই অর্থনীতি নয়, আইন, প্রশাসন, রাস্তাঘাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয় আর এসব করতে পশ্চিমের নাগরিকদের দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ‘সংহতি ভ্যাট’ নামে এক ধরনের কর দিতে হচ্ছে। তার পরও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার বলে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে এখন ইউরোপের বড় অর্থনৈতিক শক্তি। অর্থনৈতিকভাব এই উন্নয়ন ঘটলেও ইউরোপীয় রাজনীতি বা বিশ্বরাজনীতিতে জার্মান রাজনীতিকদের নিজেদের ক্ষমতাবান বলে প্রমাণ করতে দেখা যায়নি। একই ঘটনা ঘটেছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমে ক্ষমতায় থেকেছেন মূলত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা অথবা ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় থেকেছে ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যালিস্ট, ফ্রি ডেমোক্র্যাট বা কখনো পরিবেশবাদী সবুজ দলের মতো ছোট দলগুলো। আর পূর্বে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার দল সোশ্যালিস্ট ইউনিটি অব জার্মানি দলটি। ছোট-বড় সব দলের আলাদা সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি থাকলেও দেশের মৌলিক ব্যাপারে তাদের ঐকমত্য আছে। জার্মানির গণতন্ত্র, ইউরোপীয় ঐক্য বা নাৎসিবাদবিরোধী সব বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ, ফলে জনগণের চিন্তাচেতনায়ও এই ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে। বিপরীতমুখী কর্মসূচি থাকলেও অনেক সময় গণতন্ত্রের স্বার্থে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা গড়ে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। যেমন, ২০০৫ সালে বড় দুই দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ চালিয়েছে, আবার ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা ছোট দল ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যালিস্ট এবং ফ্রি ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে দেশ চালিয়েছে। তবে দল বড় বা ছোট হোক, ক্ষমতায় গিয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করতে পারলে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের জনপ্রিয়তা কমে যাবে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে জোটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ফ্রি ডেমোক্র্যাটদের কপালে সেটাই ঘটেছে। মন্ত্রিসভায় পাঁচটি মূল্যবান পদ নিয়ে চার বছর ক্ষমতায় থেকেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বলে সরকার ও পার্লামেন্ট থেকে তারা ছিটকে পড়েছে। নিদেনপক্ষে মোট ভোটের ৫ শতাংশ ভোট না পাওয়ার কারণেই এই পরিণতি। অন্য দিকে বাম দল ক্ষমতায় না থেকেও প্রাপ্ত ভোটের বলে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদিও এই দলটির প্রতিপত্তি পূর্বাঞ্চলেই বেশি, তার পরও বলা যায়, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার দেশটি থেকে সমাজতন্ত্র একেবারে হারিয়ে যায়নি।
জার্মানির রাজনীতিকেরা বিগত বছরগুলোতে ইউরোপের অর্থনীতিকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে সবল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজ দেশে সমালোচনার মুখেও প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশ গ্রিস, পর্তুগাল ও স্পেনে অর্থ লগ্নি করেছে। এতে জার্মানির কিছুটা লাভ থাকলেও ঝুঁকিটাও কম নয়। পরিবেশ-সচেতন রাজনীতির কারণে ক্রমেই পারমাণবিক শক্তিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মোট চাহিদার ২১ শতাংশ বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে সৌরশক্তি অথবা বায়ু থেকে।
জার্মানিতে বসবাসরত অভিবাসীরা ক্রমেই মূলধারার রাজনীতিতে কিছু কিছু জায়গা করে নিচ্ছেন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ১১ জন তুর্কি এবং একজন সেনেগাল বংশোদ্ভূত সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। এ মুহূর্তে জার্মানির রাষ্ট্রপতি ইয়োখিম গাউক ও চ্যান্সেলর—দুজনেই সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষ। গত ২৩ বছরে ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে শতভাগ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য না এলেও বিভিন্ন খাতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ৪৫ বছর বিভক্ত হয়ে থাকা জার্মান জাতির নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকেরা সব ভেদাভেদ ভুলে জার্মানির রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থাকে নতুন চৌহদ্দিতে নিয়ে এসেছেন। ইউরোপ আর বিশ্বের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার মান অনেকটাই উঁচু করেছেন। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, বিভক্তি, আবার নতুন প্রত্যয়ে নতুন প্রত্যাশায় সবাইকে এক করে অগ্রসরমাণ এই জাতি বিশ্বের অন্যান্য জাতির জন্য দৃষ্টান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি, হ্যানোভার, জার্মানি।