দুর্বলতা ও সক্ষমতার হিসাব-নিকাশ

ড্যাপ: ডিটেলড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ হচ্ছে একধরনের পরিকল্পনা, যা শহরটাকে গোছানোর জন্য অর্থাৎ কোন এলাকায় কী গড়ে উঠবে, কী হলে ভালো হবে, কোথায় কী চাহিদা ইত্যাদি মাথায় রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে। একটা মাস্টারপ্ল্যান করা হয় সম্পূর্ণ শহরটাকে পরিকল্পনার আওতায় আনার জন্য, তারপর ড্যাপের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক জরিপ করে ঠিক করা হয় ওই এলাকায় কী হচ্ছে আর কী হওয়া দরকার। জরিপের সময় জানা যায় কোথায় জমি উঁচু আর কোথায় নিচু বা কোথায় জলাশয়। তাই জমিভেদে মাটি পরীক্ষা করে নিয়ে প্রকৌশলীর পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে সাধারণভাবে ভরাট করা জমিতে ঝুঁকি থেকেই যায়। যেমন রানা প্লাজার জমি।

রাজউক বনাম পৌরসভা: পৌরসভাগুলোর তুলনায় ভবন নির্মাণ অনুমোদনের ব্যাপারে রাজউক নিঃসন্দেহে যোগ্যতর। পৌরসভাগুলোতে প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল লোকই নেই। কিন্তু আমরা দেখছি আইনগতভাবে রাজউকের আওতাধীন হওয়া সত্ত্বেও পৌরসভাগুলো অনুমোদনের কাজ করছে। তবে পৌরসভাগুলোতে যদি রাজউকের মতো লোকবল থাকত বা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো কাজ হতো। স্থানীয় পর্যবেক্ষণ সব সময়ই সহজ ও নিবিড় হয়ে থাকে। রাজউক আর পৌরসভাগুলো দুই ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের বিষয়টিও জটিল। তবে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় অনুমোদিত ভবনে ব্যবসা হচ্ছে কি না, সে নথি চাইতে পারে পৌরসভাগুলো।

রাজউক অনুমোদিত হলেই কি নিরাপদ?: রাজউক অনুমোদিত হলে কারিগরি বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই মেনে চলা সম্ভব হয়। কারণ, এ ক্ষেত্রে পেশাদার স্থপতি ও প্রকৌশলীরা নিয়মকানুন মেনে নকশা প্রণয়ন করতে বাধ্য হন। রাজউকে যোগ্য লোকবল রয়েছে, যারা এই নকশাগুলো যাচাই করতে সক্ষম। তবে রাজউক কাঠামো নকশা মূল্যায়নের কাজ করে না। তাই রাজউক অনুমোদিত হলেও বিষয়টি প্রকৌশলী ও মালিকের ঘাড়েই থেকে যায়।

ব্যবহার সনদ: ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলে রাজউকের কাছে আবেদন করতে হয় ভবন ব্যবহারের ছাড়পত্রের জন্য। কেবল ছাড়পত্র পেলেই ভবনের মালিক ভবনে উঠতে পারেন বা ভাড়া দিতে পারেন। এই ছাড়পত্র পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নবায়ন করতে হয়। তবে এই ছাড়পত্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই আসলে কাজ হবে। অর্থাৎ ছাড়পত্রের কপিসহ আবেদন করতে হবে লাইন পাওয়ার জন্য।

নিরাপদ ভবন: বিএনবিসি কোড মেনে নকশা করলে আমাদের প্রকৌশলীরাই নিরাপদ ভবন নির্মাণ করতে পারেন এবং সে অনুযায়ী তদারক করলেই নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। শুধু মানসম্মত নকশা প্রণয়ন নয়, সে অনুযায়ী নির্মাণের ব্যাপারটাও নিশ্চিত করতে হবে।

ঠিকাদারের ভূমিকা: ঠিকাদারেরাই কার্যত স্থপতি ও প্রকৌশলীদের নকশা ও নির্দেশনা মোতাবেক ভবনের নির্মাণকাজ করে থাকেন। নির্মাণসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে মালিকের সম্পৃক্ততা থাকায় এ ক্ষেত্রে অনিয়মের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। এখানে রাজউকের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। ব্যাপারটা সামাল দিতে, (ক) ঠিকাদারদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, (খ) মানসম্মত ঠিকাদারদের তালিকাভুক্ত করতে হবে। যাতে যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা এবং সরঞ্জাম ছাড়া কেউ ঠিকাদারি করতে না পারে।

কর্মপরিবেশ ও ভবন তদারক: কর্মপরিবেশ ও ভবন ব্যবহারের সবগুলো বিষয় দেখার দায়িত্ব একজন স্থপতির। অগ্নিনিরাপত্তা থেকে শুরু করে ভেতরে পর্যাপ্ত টয়লেট আছে কি না, পর্যাপ্ত আলো আছে কি না, ভেতরে আরামপ্রদ ও সুস্থ পরিবেশ আছে কি না, শব্দদূষণ হচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় দেখাই তাঁর দায়িত্ব। কাঠামো প্রকৌশলীকে লোডিং প্ল্যান তৈরিতেও তথ্য-উপাত্ত দিতে হয়। তাই শুধু প্রকৌশলীকে দিয়ে ভবন করতে চাইলে অনেক বিষয় বাদ পড়ে যায়। স্থপতিরাই শ্রমিকের সব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে নকশায় সন্নিবেশ করে থাকেন।

নিরাপদ কারখানার নকশা: যে ভবনগুলোতে অনেক লোক একসঙ্গে কাজ করবেন, সেই ভবনগুলো প্রকৌশলীর নকশার পর আইইবি ও আইএবির তালিকাভুক্ত একজন প্রকৌশলী এবং স্থপতিকে দিয়ে যেন তা চেক করানো হয়। এ ক্ষেত্রে দায়ভার দুজনকেই নিতে হবে। নির্মাণ নকশা দেওয়ার পাশাপাশি প্রকৌশলীকে ক্যালকুলেশন রিপোর্ট (যা অন্যান্য দেশে প্রদান করা হয়) দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এটা না হলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় অনেক বেশি। মাঝেমধ্যে রাজউক তাদের নকশা পর্যালোচনা-মূল্যায়ন করবে, ভুল বা দোষ ধরা পড়লে প্রকৌশলী বা স্থপতিদের নিবন্ধন বাতিল করবে।

বিল্ডিং নির্মাণ কোড: বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) মধ্যে আছে বিভিন্ন রকম নিয়মকানুন, উপায়, করণীয়, মান ইত্যাদি। এটা অনুসরণ করে ভবন নির্মাণ করলে ভবনের ব্যবহারকারীরাই উপকৃত হবেন। বর্তমানে চারটি শহর এর আওতাধীন, সমগ্র দেশকেই এর আওতায় আনা দরকার। এ বিধানটির একটা বাংলা সংস্করণ করা দরকার, যাতে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত সবাই বুঝতে পারেন। আমি মনে করি, এই বিএনবিসির ওপর ভিত্তি করে আরও কঠোর নিয়ম দরকার কারখানার ক্ষেত্রে। যেমন, কারখানার বেলায় ফ্ল্যাট প্লেট ভবন নিষিদ্ধ করা, কলাম নির্মাণের সময় বিশেষ তদারক ইত্যদি।

উদ্ধারযন্ত্র: উদ্ধারকাজে সাধারণত দুই ধরনের সরঞ্জাম লাগে। হাতে বহনযোগ্য ও ভারী সরঞ্জাম যেমন—ক্রেন, সিঁড়ি ইত্যাদি। প্রশিক্ষিত লোকেরাই কেবল ওই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করেন, তা না হলে উপকারের চেয়ে অপকারের আশঙ্কা বেশি থেকে যায়। তাই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মাধ্যমেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে তাদের পরিসর বাড়ানো দরকার।

উদ্ধারকাজে ভারী যন্ত্র: ভারী যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৌশলের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ধসে যাওয়া ভবন আবারও ধসে না যায়। তাই সঠিক কৌশল অবলম্বন করতে পারলে ভারী যন্ত্র দিয়ে স্বল্প সময়ে অনেক লোককে উদ্ধার করা যায় এবং প্রায় ঝুঁকিমুক্তভাবে। বহুতল ভবনধসে ওপর থেকে সাবধানতার সঙ্গে স্ল্যাব কেটে কেটে তুলে ফেললে সময় এবং জীবন ক্ষয় দুই-ই কমানো সম্ভব। কিন্তু পাশে থাকতে হবে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর একটা দল। উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় ছোট যন্ত্রগুলো সহজেই সরকার কিনতে পারে। বড় যন্ত্রগুলো অনেক ব্যয়বহুল, তবে তা অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই আছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এবং ফায়ার সার্ভিস বিভাগ এগুলোর তালিকা রাখতে পারে, যাতে দুর্যোগের সময় কাজে লাগানো যায়।

কমপ্লায়েন্ট বনাম নিরাপত্তা: ‘কমপ্লায়েন্ট’ কারখানা হলেই যে তা সার্বিকভাবে নিরাপদ এটা বলা যায় না। কারণ, কর্মপরিবেশের অনেক দেশজ বিষয় এতে নেই। বিদেশিরা সান্ত্বনা পান কমপ্লায়েন্ট কারখানাতে প্রস্তুত পোশাক কিনে। কিন্তু তাজরীন ‘কমপ্লায়েন্ট কারখানা’ হলেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই দরকার আমাদের নিজেদের চাহিদাপত্র তৈরি করা, আমাদের কথা ভেবে।

ভবন ত্রুটিমুক্ত করার প্রযুক্তি: কোনো ভবন ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হলে তা সারানোর প্রযুক্তি বাংলাদেশে রয়েছে। কম হলেও এ কাজে পারদর্শী প্রকৌশলী দেশে রয়েছেন। নির্মিত কোনো ভবনকে মজবুত করার কাজকে ‘রেট্রোফিটিং’ বলে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভবনের অংশগুলোর (কলাম, বিম, স্ল্যাব, ভিত) লোড ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায়। এই প্রযুক্তি কিছুটা ব্যয়বহুল তবে মানুষের জীবনের দামের কাছে তা নগণ্য।

কোনো ভবনে সমস্যা দেখা দিলে...: ভবনে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা গেলে যেমন ফাটল, প্লাস্টার খসে পড়া, বিদ্যুতের ঝলক বা ধোঁয়া, বিদ্যুতের তার গরম হতে থাকলে, ভেতরের বাতাসে গন্ধ বা গুমোট ভাব, ভবনে ঝাঁকুনি বা যেকোনো বিপদজনিত সন্দেহ মনে দেখা দিলে অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। এ ব্যাপারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় একটা বিশেষ হান্টিং নম্বরের ব্যবস্থা করতে পারে, যাতে যে কেউ এসএমএস বা ফোন করে সরাসরি সমস্যাটি জানাতে পারেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তা চলে যাবে সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোতে। ফলে কেউ চাইলেও ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে পারবে না।

লোকবলের অভাব: লোকবলের অভাবের বিষয়টা আছে। সরকারের ব্যয় হঠাৎ করে না বাড়িয়েও সুপারভিশন, অডিট, ইন্সপেকশনের কাজগুলো রাজউকের বাইরে থেকে (আউটসোর্সিং) করিয়ে নেওয়া যায়, যেমনটা করছে পশ্চিমা দেশগুলো। এতে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক লোক কাজও পেতে পারেন আর শ্রমিকেরাও থাকবেন নিরাপদে। সরকার নিয়মিত তদারক করবে ওই সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, আর গাফিলতি দেখলেই শাস্তি প্রদান করবে।

রানা প্লাজার শিক্ষা: রানা প্লাজার ধস থেকে সবার অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। যেন এ রকম দুর্ঘটনা দ্বিতীয়বার না ঘটে। ভবনের নকশা, অনুমোদন, নির্মাণ, ব্যবহার, তদারক, নিরাপত্তা এবং উদ্ধারকাজের মধ্যে কখন এবং কোথায় কী করলে ভালো হতো, তা খুঁজে বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পরিবর্তন আনতে হবে। আন্তমন্ত্রণালয় দ্বন্দ্ব, দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলি বন্ধ করে সরকারকে পরিষ্কার নীতিমালা ঠিক করে দিতে হবে। এমন অবকাঠামো প্রবর্তন করতে হবে, যাতে কোনো মহলই চাইলে রানা প্লাজার মতো ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার করতে পারবে না।

খন্দকার সাব্বির আহমেদ: আধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বুয়েট; বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবান্ধব ফ্যাক্টরি ডিজাইন।