দড়িবাঁধা মা-মেয়ে: সময়ের দুঃসহ সংকেত

দেখব না দেখব না করেও দেখে ফেললাম ভিডিওটা। মা ও মেয়েকে কোমরে দড়ি বেঁধে মারতে মারতে নেওয়া হচ্ছে। পড়ব না পড়ব না করে পড়েও ফেললাম খবরটা। মা ও মেয়েকে গরু চুরির অভিযোগে পেটানো হয়। জানব না জানব না করেও জানা হলো নামটা। পেটানো কর্মসূচির ফিনিশিং টাচটা ছিল আরও মারাত্মক। নিজ হাতে তাঁদের মারধর করেন একজন জনপ্রতিনিধি। তিনি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম। যুবক মানুষ, তাও আবার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। মেরে অজ্ঞান করে তবে মা ও মেয়েকে পুলিশে দেওয়া হয়। এখন তাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

চেয়ারম্যান বলে নিজ হাতে পিটিয়েছেন, পোশাকি বাহিনীর হাত হলে হয়তো ক্রসফায়ার হতো। জনগণ বলে মার খেতে হয়, নেতা হলে হয়তো পুরস্কারই জুটত।
মা-মেয়েকে যখন গ্রামে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘোরানো হয়, তখন গ্রামবাসী পেছনেই ছিল। তাদের মধ্যেও মারদাতারা ছিল। অন্য কোনো দৃশ্যে হয়তো এই জনতার কেউ কেউ মার খাবেন, অন্য জনতারা এমনভাবে চেয়ে চেয়ে দেখবে, কেউ মজা নেবে। কারও হাত এতই নিশপিশ করবে যে কিল-ঘুষি দিয়ে সাধ মেটাবেন। এই জনতা বনের সেই গাছগুলোর মতো, যারা কুঠারকে তাদের বন্ধু ভেবেছিল। গাছগুলো লোহার কুঠারের কাঠের হাতল দেখে ভেবেছিল, কুঠার হয়তো তাদের বন্ধু, কারণ তার হাতলটাও তো গাছেরই কাঠ দিয়ে তৈরি। জনপ্রতিনিধির সঙ্গে জড়িত ‘জন’ কথাটা হলো কুঠারের কাঠের হাতল আর শান দেওয়া লোহার কুড়াল হলো তার ক্ষমতা।

তাই মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যিকারভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কি এমন বর্বর হতেন? জনপ্রিয়তা হারানোর ভয় কি তাঁর থাকত না? মনে আরও প্রশ্ন জাগে, আইনের শাসন জারি থাকলে কি এভাবে চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকেরা নিজেরাই আইন, নিজেরাই আদালত আর নিজেরাই শাস্তিদাতা হতে পারতেন? আইনের বাধা থাকত নাকি? আইনের হাত হিসেবে পুলিশ কি নির্যাতক আর নির্যাতিতের মাঝখানে দাঁড়াত নাকি? যদি মানবিক সমাজ হতো, তাহলে শত শত গ্রামবাসী এই নির্দয়তার নীরব সাক্ষী থাকতেন; নাকি তাঁরা বাধা দিতেন।

ওই মা ও মেয়ে সত্যিই গরু চুরি করেছেন কি করেননি, সেটা এখন আর বড় প্রশ্ন না। বড় প্রশ্ন হলো, অপরাধের দায় প্রমাণিত হয়নি তখনো, অপরাধ প্রমাণের সেই দায় জনগণেরও না, তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরও না। তাঁদের কাজ আইনের সামনে সত্যটা তুলে ধরা এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকা। কিন্তু গত দুই দশকে এই জনতা লাগাতার বিচারবহির্ভূত হত্যা দেখেছে। রাষ্ট্র, সরকার ও নেতারা যা শেখান, অনেক ক্ষেত্রে বেশির ভাগ জনগণ তা-ই শেখে। জনতা এখানে শিশু, সরকার ও নেতৃমহল হলো তাদের পথপ্রদর্শক। নিজের হাতে অপ্রমাণিত অপরাধীদের বিচারের এই তরিকা জনতা সরকার-প্রশাসনের কাছ থেকেই শিখেছে।

কিন্তু ওই গ্রামে তো বাস্তবের শিশুরাও ছিল। তারা তাদের অল্পবয়সী অবুঝ মন নিয়ে দেখেছে, তাদেরই মা-খালার মতো মানুষদের গরুর মতো দড়ি দিয়ে বেঁধে গ্রামের রাস্তায় ঘোরানো, দেখেছে তাদের মেরে রক্তাক্ত করার দৃশ্য। সহিংসতার সাক্ষী হওয়া শিশু-কিশোরেরা মানসিকভাবে পীড়িত হয়। মানুষ মানুষকে সাপের মতো পেটাচ্ছে, এই দৃশ্য তাদের মনে মানসিক আঘাত সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। এই অভিজ্ঞতা তাদেরও ভোগাবে। হয় তারা মানসিক আতঙ্কে থাকবে, নতুবা তাদের মধ্যেও এ রকম হিংসাত্মক মানসিকতা গড়ে উঠবে। তাদের সম্ভাবনা থাকবে ঘরে বা বাইরে মারপিটে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার। একটি শিশুকে চিনি যে রেগে গেলে সর্বোচ্চ গালি দিলে শুধু এটুকু বলতে পারে, ‘তুমি একটা বোকা’। কারণ, বাড়িতে এর বেশি কোনো বকা তারা কোনো দিন শোনেনি। তেমন শিশুদেরও চিনি, যারা বড়দের গালিগালাজ ও মারপিটে তুখোড় হয়ে গেছে শৈশবেই। হয়তো চারপাশে তারা এসবই দেখেছে!

মানুষ সেদিনই সভ্য হওয়া শুরু করে, যেদিন তারা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে বলপ্রয়োগের বাইরে কোনো উপায় শিখে ফেলে। মধ্যযুগে কোনো কোনো সমাজে বলপ্রয়োগ তথা মারধর-নির্যাতন-হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি ছিল সংকট সমাধানের প্রধান উপায়। দাসযুগে এভাবে দড়িবেঁধে, পিটিয়ে মানুষ মারা হতো। সেখান থেকে কত দূর এগোল আমাদের দেশের মানুষ?

ইউরোপ-আমেরিকায় ওরা অন্য দেশে গিয়ে যুদ্ধ করে; কিন্তু নিজ দেশে নাগরিকের ওপর বেআইনি সহিংসতা চালানো নিষেধ। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের মনোভাব কায়েম আছে বলেই ঘরে বা রাস্তায় বা রাষ্ট্রের কোনো সমস্যার সমাধান আমরা মারামারি ছাড়া করতে পারি না। ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধ ছাড়া অপরাধ দমনের কোনো কার্যকর পথ সম্ভবত আমরা চিনি না। গণপিটুনি তো ক্রসফায়ারেরই বেসরকারি রূপ। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে আমাদের এই একটাই ওষুধ: মারো, মেরে শিখাও, বাধ্য করো, রিমান্ডে নাও, ফাঁসি দাও, জেলে ভরো, টিসি দাও, শরীরকে কষ্ট দিয়ে সোজা করো।

কোনো সমাজ যখন আইন ও বিচারে আস্থা হারায়, তখন রাষ্ট্রনৈতিকতা লোপ পায়। কোনো গ্রাম, পাড়া, মহল্লা বা পথের মানুষ যখন গণপিটুনিতে উল্লাস করে, তখন সমাজের মৃত্যুযাত্রা নিশ্চিত হয়। সমাজ-দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় এটা ‘ডেথ অব দ্য সোশ্যাল’।

এমন দুঃসংকেত নিয়মিতই আসছে। গত জুলাই মাসে খুলনার মশিয়ালিতে স্থানীয় নেতার লোকেরা গুলি করে তিনজনকে মেরে ফেলে—সঙ্গে গণপিটুনিতে মারা যায় আরও একজন। চকরিয়ার ঘটনাটা সামান্য মনে হলেও সমাজের মৃত্যু এবং রাষ্ট্রনৈতিকতার অভাবের সংকেত দিয়ে গেল। মা ও মেয়েকে একসঙ্গে দড়িবেঁধে পেটান যে চেয়ারম্যান, তিনি আমাদের জাতীয় দুরবস্থারই আঞ্চলিক দৃশ্যায়ন ঘটিয়েছেন। সমাজ ও সভ্যতার এই মরণদশার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার না করে, জনতার মানবিকতাবোধ না জাগিয়ে কীভাবে আবার আমরা মানুষ হতে পারব?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]