নাইন–ইলেভেনের পর কীভাবে বদলে গেল পৃথিবী

২০০১ সালে যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শুরু, তখন জঙ্গিবাদ একটি বা দুটি দেশে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা প্রায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ হামলা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর এর জবাব হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছিলেন। বিশ বছর কেটে গেছে, কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বরং বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই কোনো না কোনভাবে সে যুদ্ধের অংশ হয়ে পড়েছে। এর ফলে বদলে গেছে পৃথিবী, বিপন্ন হয়ে পড়েছে বিশ্বের মানুষ।

এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদাকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিশোধ-হামলা দিয়ে। দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াসহ আরব বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। বিশ বছর পর এই যুদ্ধের জমাখরচ থেকে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার ঝুলিতে পড়েছে খুব সামান্যই। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের হুমকি নিশ্চিহ্ন করার বদলে পরাজয় স্বীকার করে তাকে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। সেই তালেবানই ফের সেই দেশে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। তাদের নেতৃত্বের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা সন্ত্রাসী হিসেবে আমেরিকার সন্ধান তালিকায় রয়েছেন।

অনিঃশেষ যুদ্ধ

আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের হিসাব অনুসারে, গত বিশ বছর আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধে নিহত হয়েছে প্রায় এক লাখ মানুষ, ব্যয় হয়েছে আট লাখ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থের হিসাবে এই যুদ্ধ বাবদ প্রতিদিন খরচ হয়েছে ৩০ কোটি ডলার। আর মানুষের জীবন ও জীবিকার যে ক্ষতি হয়েছে, তার লিখিত কোনো হিসাব কারও কাছে নেই।

যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬০টি দেশে এই যুদ্ধ এখনো অব্যাহত। ২০০১ সালে যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শুরু, তখন জঙ্গিবাদ একটি বা দুটি দেশে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা প্রায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধ চলছে দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে। ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের অন্যতম পরিচালক স্টেফানি সাভেল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আরও বিশ বছর পরও হয়তো এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব–নিকাশ করতে হবে।

অনেকেই মনে করেন, আল-কায়েদার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা ছিল একটি বাহানামাত্র। আসল লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে আসা আমেরিকা বিশ্বে নিজের আধিপত্য রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে ‘সর্বাধিক’ শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। অন্যান্যের মধ্যে এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন খ্যাতনামা মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি। নেশন সাপ্তাহিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তালেবান সরকার ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। বুশ সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। বুশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেছিলেন, ‘আত্মসমর্পণ নিয়ে আমরা কোনো আপস আলোচনা করি না।’ অর্থাৎ চমস্কির কথায়, আমেরিকার একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজের বাহুবল প্রদর্শন ও সবাইকে ভীত করা। (দেখুন https://truthout.org/articles/noam-chomsky-the-us-led-war-on-terror-has-devastated-much-of-the-world/)

চমস্কি প্রশ্ন করেছেন, তথাকথিত অনিঃশেষ যুদ্ধের শুরু কবে? না, তা মোটেই ২০০১ সালের ৯/১১ তারিখে নয়। এই যুদ্ধ শুরু হয় ১৭৮৩ সালে, যখন সদ্য স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তি ও সভ্যতার নামে আমেরিকার আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। চমস্কি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন, প্রথম ৯/১১ ২০০১ সালে ঘটেনি। ঘটেছিল ১৯৭৩ সালে, যেদিন মার্কিন সহায়তায় চিলিতে বামপন্থী আলেন্দে সরকারকে সরিয়ে একটি সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল।

আর জাতি গঠন নয়

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটা লক্ষ্য ছিল, বিশ্বে আমেরিকার পছন্দমতো নতুন বিশ্ব নির্মাণ। এই বিশ্বাস অথবা ঔদ্ধত্য থেকেই আফগানিস্তান ও ইরাকে প্রাথমিক বিজয়ের পর জর্জ বুশ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য জাতি নির্মাণ বা নেশন বিল্ডিং বলে ঘোষণা দিয়ে ছিলেন। এখন সেই অ্যাডভেঞ্চারের বিশ বছর পর আমেরিকা বলছে, সে আর জাতি নির্মাণে আগ্রহী নয়।

নিজের স্মৃতিকথা ডিসিশন পয়েন্টস-এ বুশ গর্ব করে বলেছিলেন, ‘একটি আদিম (বুশের কথায় ‘প্রিমিটিভ’) একনায়কতন্ত্র থেকে আমরা আফগানদের উদ্ধার করেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য, সে দেশে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠন করা। আমরা চাই আফগান জনগণের জন্য “ভালো কিছু” রেখে যেতে।’ বিশ বছর পর দেখা যাচ্ছে, ভালো বলতে সেই তালেবানের হাতেই দেশের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে এসেছে আমেরিকা। গত মাসে সে দেশ থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ঘোষণার সময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, জাতি গঠন আমাদের কাজ নয়। আমরা জাতি গঠন করতে আফগানিস্তানে যাইনি। সে দায়িত্ব আফগানদেরই নিতে হবে। নিজ দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সভ্যতার ওপর জোর করে কোনো শাসনব্যবস্থা বা রাজনৈতিক সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া যায় না, এই সহজ কথা বুঝতে আমেরিকার বিশ বছর লাগল।

প্রেসিডেন্ট বুশ চেয়েছিলেন, আমেরিকা তার পেশির জোরে বিশ্বে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দেবে। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। সন্ত্রাস শুধু বহির্গত হুমকি নয়, সে একটি অভ্যন্তরীণ হুমকি, এই যুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতা দখল করে বসেছে। রাশিয়া থেকে তুরস্ক, ফিলিপিন থেকে ভারত—সর্বত্রই এখন কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায়। সন্ত্রাস দমনের নামে এসব দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

ঘাড়ের ওপর ‘বড় ভাই’

জর্জ অরওয়েল তাঁর ১৯৮৪ গ্রন্থে ভবিষ্যতের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের যে কাল্পনিক চিত্র এঁকেছিলেন, ৯/১১–এর পর সে চিত্রই সত্যে পরিণত হলো। এখন পৃথিবীর ছোট-বড় সব দেশেই সরকার নিজ দেশের মানুষের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করেছে। মোড়ে মোড়ে ক্যামেরা, তাতে নাগরিকদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। আধুনিক মুঠোফোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আড়ি পাতা হচ্ছে। মুখে বলা হচ্ছে, এই নজরদারির লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমন। বাস্তবে মৃত্যু হচ্ছে গণতান্ত্রিক ভিন্নমতের।

উদাহরণ হিসেবে চীনের কথাই ধরা যাক। বিশ্বজুড়ে নজরদারি ব্যবস্থার ওপর একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে মোট ৭৭০ মিলিয়ন নজরদারি ক্যামেরা চালু রয়েছে, যার ৫৪ শতাংশ চীনে। শানজি প্রদেশের রাজধানী তাই-ইয়ানে প্রতি ১ হাজার নাগরিকের জন্য রয়েছে ১১৭টি ক্যামেরা। শুধু সিসিটিভি নয়, চীনে যে ব্যাপক নজরদারি অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে সমানভাবে জোর দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহার ও তথ্য নিয়ন্ত্রণের ওপর। এই ইন্টারনেট মনিটরিংয়ের প্রধান লক্ষ্য দেশের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়। তবে যেখানেই ভিন্নমতের স্বর শোনা যায়, সেখানেই থাকে এই নজরদারি ব্যবহার করে কণ্ঠরোধের ব্যবস্থা।

‘কিছু দেখলে খবর দিন’

নজরদারি ব্যবস্থায় পিছিয়ে নেই আমেরিকা। ৯/১১–এর পর মার্কিন কংগ্রেস ‘প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট’ নামে যে আইন পাস করে, তার জোরে সরকার যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি চালাতে পারে। এই নজরদারির প্রধান লক্ষ্য বহিরাগত, বিশেষত মুসলিম। এই আইন ব্যবহার করেই এখানে সরকারিভাবে দেশের মানুষকে একে অপরের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এফবিআই নিজের লোক পাঠাচ্ছে মসজিদে অথবা মুসলিমদের সভায়। সন্ত্রাসী ধরার নামে চলছে ‘স্টিং অপারেশন’। সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস এক প্রতিবেদনে বলেছে, আমেরিকার মুসলিমদের জন্য প্রার্থনায় সমবেত হওয়া বা ধর্মীয় পোশাক পরিধান করাও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে।

সবাইকে টেক্কা দিয়েছে নিউইয়র্কের পুলিশ। তাদের জনপ্রিয় স্লোগানই হলো, ‘ইফ ইউ সি সামথিং, সে সামথিং’। অর্থাৎ আপনার চোখে কিছু পড়লে পুলিশকে খবর দিন। মুসলিমরা এমনিতেই মার্কিন চোখে সন্দেহের শিকার। তার ওপর পুলিশের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশীর ওপর শুধু যে নজর রাখছেন তা–ই নয়, সামান্য সন্দেহ হলেই পুলিশকে ফোন করে খবর দিচ্ছেন। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এই ‘নাগরিক নজরদারিত্ব’ রীতিমতো সামাজিক বৈকল্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর সন্দেহজনক কিছু দেখেছে, এ কথা জানিয়ে হাজার হাজার অভিযোগ পৌঁছাচ্ছে পুলিশের কাছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ ভিত্তিহীন। কেউ একজন ভুলে নিজের ব্যাগ ফেলে গেছে, অমনি বোমা সন্দেহে ফোন। সাবওয়ে প্ল্যাটফর্মে এক বহিরাগত, সম্ভবত মুসলিম, ট্রেনে কত যাত্রী রয়েছে তা গুনছে, এমন অভিযোগে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পরে জানা গেল, লোকটি আসলে তসবিহ হাতে প্রার্থনা করছিলেন। নিউইয়র্কের সাবওয়েতে ছবি তোলার সময় খবর পেয়ে পুলিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভারতীয় ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশ নিজের ভুল স্বীকার করে জরিমানা গুনতে বাধ্য হয়।

৯/১১–এর পর বহিরাগতদের প্রতি ভীতি ও সন্দেহ ব্যবহার করে যে ঘৃণার সংস্কৃতি এ দেশে ছড়িয়ে পড়ে, ১৫ বছর পর তা-ই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক রাজনীতিকের আবির্ভাব ঘটায়। মুসলিম ও অন্য বহিরাগতদের প্রতি ঘৃণা ও প্রত্যাখানের স্লোগান ব্যবহার করেই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন। (শেষ)