পাসপোর্টের এই পরিবর্তন কেন ইসরায়েলের জন্য উপহার

ফাইল ছবি

আশির দশকের গোড়ার দিকে আমার প্রথম পাসপোর্টে তিনটি দেশের ক্ষেত্রে তা বৈধ হবে না বলে লেখা ছিল। দেশগুলো হলো ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তাইওয়ান। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন বর্ণবাদের কারণে বৈশ্বিক বর্জনের মুখে ছিল। তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব ছিল না চীনের কারণে। আর ইসরায়েলের কথা তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্ণবাদের অবসান ঘটার পরই দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আমাদের পাসপোর্ট সেখানে ভ্রমণের জন্য বৈধ।

তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এখনো নেই, কিন্তু নীরবে পাসপোর্টের ব্যতীত (exclusion) তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এর কারণটা ছিল কতিপয় ব্যবসায়ীর বাণিজ্যিক আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা। তাঁরা এমনকি ঢাকায় তাইওয়ানের বাণিজ্যিক লিয়াজোঁ অফিস খোলার অনুমতি দিয়ে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক ঝামেলার জন্ম দিয়েছিলেন। সেই অনুমতি শেষ পর্যন্ত আর দেওয়া হয়নি। তবে পাসপোর্টের ব্যতীত তালিকায় নামটি না থাকায় তাঁদের তাইওয়ানে যাওয়া-আসায় বাধাটা দূর হয়েছে।

ইসরায়েলের বিষয়টাও খামাখা হচ্ছে, এমনটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কার বা কাদের বাণিজ্যিক আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে বাণিজ্য প্রতিবেদকেরা খোঁজ করলেই জানতে পারবেন বলে বিশ্বাস করি। আর যদি তা না হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের আগ্রহের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া যায় না। নিরাপত্তা শিল্প বা সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রিতে ইসরায়েলের যে সুনাম আছে, সেটাও এই উৎসাহের একটা কারণ হতে পারে।

কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না হলেও যে বাণিজ্যিক বা নিরাপত্তা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব, তার ভূরি ভূরি নজির বিশ্বজুড়ে পাওয়া যাবে। আব্রাহাম চুক্তির আগেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে ইসরায়েলের বাণিজ্য লিয়াজোঁ অফিস ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সেই পথে অগ্রসর হচ্ছি?

পাসপোর্টকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ কথাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে—এমন যুক্তি একেবারেই ঠুনকো। ভ্রমণের জন্য আবশ্যিক দলিল হিসেবে কোনো দেশের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বে কতটা বেশি, তার যেসব শ্রেণিবিন্যাস দেখা যায় তাতে মালয়েশিয়ার পাসপোর্টের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ কুড়িটির অন্যতম। সেই মালয়েশিয়ার পাসপোর্টে এখনো ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ লেখা আছে।

নতুন পাসপোর্টে ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ কথাগুলো যদি বাদ দেওয়ার অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে ইস্যু করা পাসপোর্টগুলো ফেরত নিয়ে তাতে ওই কথাগুলো সিল হিসেবে লাগিয়ে দেওয়া। ইসরায়েল সম্পর্কে নীতি বদলানোর সময় এখন নয়।

বাংলাদেশের পাসপোর্টে ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ কথা দুটি না থাকলে কী হবে? এর ফলে এটি ইসরায়েলের কাছে বৈধ ভ্রমণ দলিল হিসেবে গণ্য হবে এবং তৃতীয় যেকোনো দেশের ইসরায়েলি দূতাবাস থেকে এতে ভিসা নেওয়া যাবে। এই পাসপোর্টে ইসরায়েল সফরের জন্য বাংলাদেশে কোনো ধরনের আইনগত অপরাধ হবে না। এবং অনুমান করা যায় যে ইসরায়েল শুরুতে কিছুদিনের জন্য হলেও ভিসা প্রদানে উৎসাহী হবে। কেননা, তারা তখন দেখাতে পারবে যে বিশ্বের তৃতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে না হলেও নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য গড়ে উঠছে।

গত সপ্তাহের গাজার নৃশংসতার কারণে প্রথমবারের মতো ইসরায়েল যখন তার বহুকালের মিত্রদেশগুলোতেও নজিরবিহীন নিন্দার মুখোমুখি হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের এই খবর তাদের জন্য যে কতটা সুখকর, দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক উপমহাপরিচালক গিলাদ কোহেনের টুইটই তার প্রমাণ। দেশটির সব কটি পত্রিকায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর।

* কামাল আহমেদ: সাংবাদিক