প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে না কেন?



প্রযুক্তির উৎকর্ষ বর্তমানে যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তার সবটাই বেসিক সায়েন্স বা মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ফলের ওপর ভিত্তি করে। প্রযুক্তির উদ্ভাবন আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়, তাই আমরা প্রযুক্তি বা টেকনোলজিকেই স্পষ্ট করে দেখি এবং তার দিকে আকৃষ্ট হই। অথচ যে বিদ্যার প্রায়োগিক দিকই হলো প্রযুক্তি, সেই বিদ্যা অর্থাৎ বেসিক সায়েন্স গহিন অন্তরালেই থেকে যায়। ফলে দিনে দিনে আমরা বিজ্ঞান থেকে সরে যাচ্ছি দূর থেকে দূরে। কোনো একটা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পেছনে মৌলিক বিজ্ঞানের যেসব তত্ত্ব এবং তথ্য জড়িত, তা কখনোই সামনে আসে না। না আসুক, কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে প্রযুক্তির পেছনে ধাবিত হতে গিয়ে আমরা মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাকে অবহেলা করছি কি না।

হুজুগ বা কারেন্ট ট্রেন্ডের পেছনে ছোটার একটা রেওয়াজ আমাদের সব সময়ই রয়েছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষা ও গবেষণার ভিত সবল করার প্রয়াসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকগুলো সাধারণ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার দুই ধরনের। একটা হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আরেকটি হলো প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া দেশে বিশেষায়িত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষভাবে ভৌত বিজ্ঞানের অন্যতম তিনটি বিষয়, পদার্থ, রসায়ন ও গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পাঠদান অব্যাহত থাকলেও প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব বিষয়ে স্নাতক শ্রেণির পাঠদান হয় না। অথচ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পদার্থ, রসায়ন ও গণিত বিষয়ে অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়েছেন, গবেষণার সুযোগও যথাসম্ভব রয়েছে এবং বিশ্বমানসম্পন্ন গবেষণাও হয়। স্নাতক শ্রেণির পাঠদানের সুযোগ না থাকায় এসব বিষয় পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। অথচ এসব বিভাগের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রতিবছর অসংখ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা সম্ভব হতো। এর ফলে দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, দেশও হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় একদল তরুণ বিজ্ঞান শিক্ষার্থীকে।

অনেকে সরলীকরণ করে মজা করে বলেন, ‘যা কিছু দেখা যায় তার সবই রসায়নবিজ্ঞানের অধিক্ষেত্র, যা দেখা যায় না তা পদার্থবিজ্ঞানের আওতায় অধীত বিষয় আর দেখা ও না-দেখা সবার হিসাব করার জন্য প্রয়োজন গণিত।’ মজা করে বললেও, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির যেকোনো উদ্যোগেই পদার্থ, রসায়ন ও গণিতের জ্ঞান নিবিড়ভাবে জড়িত। ফলে প্রকৌশল এবং প্রযুক্তিকে একমুখী প্রাধান্য দিতে গিয়ে মৌলিক বিজ্ঞানের তিন শাখাকে অবহেলা করা নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল।

সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে সিমাগো র‍্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়েছে। ফলাফল ঘাঁটাঘাঁটি করে যা দেখা গেল, তা হলো রসায়নে দেশের সেরা প্রথম চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ই সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় আর পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগ। সংবাদটি নিঃসন্দেহে সম্মানের, আনন্দের ও বড় অর্জনের এ জন্য যে দেশের অনেক প্রাচীন ও বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাপিয়ে বুয়েটের রসায়ন বিভাগ এ অনন্য ঊর্ধ্বে স্থান করে নিয়েছে। সাধুবাদ জানাই সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় শিক্ষক-গবেষকবৃন্দ ও বুয়েট কর্তৃপক্ষকে। সংশ্লিষ্টদের যৌথ প্রয়াস ও আন্তরিকতার ফলেই এ অর্জন সম্ভব হয়েছে নিঃসন্দেহে।

বুয়েটের বর্তমান প্রশাসন সম্প্রতি বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। যেমন: বিজ্ঞান অনুষদ, বিজ্ঞান-প্রকৌশল গবেষণা ও ইনোভেশন সেন্টার গঠন, কিউ-১ জার্নালে প্রকাশনার জন্য বিভাগ নির্বিশেষে প্রতি শিক্ষককে দেড় লাখ টাকা প্রণোদনা, প্রতি দুই বছরের জন্য সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকার গবেষণা অনুদান, প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের তিন বছরের জন্য সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা গবেষণা অনুদান ইত্যাদি। এটি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অনুপ্রেরণা জোগাবে।
আমরা জানি, যেকোনো র‍্যাঙ্কিংয়েই অনেকগুলো ফ্যাক্টর বা সূচক মূল্যায়ন করা হয়, যার মধ্যে একটি হচ্ছে গবেষণা। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক বিজ্ঞানের এই তিন ডিসিপ্লিনে মোটামুটি সবাই গবেষণাকর্মটি করেন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে। যেহেতু স্নাতক শ্রেণির পাঠদান নেই সেহেতু বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হতে তাদের অনেকটা সময় লেগে যায়।

এ ছাড়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক বিজ্ঞান বিভাগগুলোতে বাজেট, প্রয়োজনীয়সংখ্যক গবেষণাগার ও যন্ত্রপাতির ব্যাপক স্বল্পতা রয়েছে। ফলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা অনেকটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের গবেষণার প্রতি আন্তরিকতা, ত্যাগ ও প্রচেষ্টার ওপর। রসায়ন, পদার্থ ও গণিত বিভাগের শিক্ষকেরা বিদেশে গবেষণারত নিজেদের পরিচিত বিভিন্ন গবেষকের সঙ্গে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক কোলাবোরেশনের মাধ্যমে গবেষণা চালিয়ে যান। অথচ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক শ্রেণির পাঠদান অব্যাহত থাকলে সেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকেই আগ্রহীরা স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে গবেষণায় নিয়োজিত হতো এবং মৌলিক বিষয়ে গবেষণা আরও বেগবান হতো।

আমাদের জানা নেই বিশ্বের কোন দেশের এবং কোন কোন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিষয়ের পাশাপাশি মৌলিক বিষয়গুলোতে স্নাতক শ্রেণির পাঠদানের সুযোগ নেই। প্রকৌশল ও প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া সময়ের দাবি কিন্তু মৌলিক বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে অবশ্যই নয়। বিজ্ঞানে অনীহা নিয়ে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা জাতি টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রযুক্তি বিষয়ে পাঠদান থাকলেও বেসিক সায়েন্স বিষয়ে পাঠদান নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একই অবস্থা দৃশ্যমান। সিমাগো র‍্যাঙ্কিং লক্ষ করলে দেখা যায়, সরকারি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পদার্থ ও গণিত বিভাগগুলো তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে, যদিও তাদেরও স্নাতক এমনকি স্নাতকোত্তর শ্রেণিতেও পাঠদানের সুযোগ নেই। এদিকে রসায়নের গবেষণায় তুলনামূলক অনেক বেশি ফান্ডিং প্রয়োজন হয় এবং স্নাতক শ্রেণির ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য অনেক ল্যাব প্রয়োজন হয়, ফলে গবেষণাও হয়ে ওঠে কঠিন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির পাঠদানের ব্যবস্থা থাকলে তারা আরও ভালো করত।

যেকোনো দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নতি করতে হলে জ্ঞানের সব শাখাকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক শ্রেণির পাঠদান শুরু করতে হবে। এতে একদিকে যেমন উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে অন্যদিকে ওই সব মৌলিক বিষয়ে পঠনপাঠনে গতি বৃদ্ধি পাবে এবং মজবুত হবে প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ভিত। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন প্রকার এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু ও যৌথ গবেষণার মাধ্যমে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হবে। পাশাপাশি, ধরন-নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

ড. আল-নকীব চৌধুরী বুয়েটের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ড. মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী এআইইউবির রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।